এক দশক পর ঢাকায় নির্বিঘ্নে জামায়াতের কর্মসূচি পালনের পর নানা প্রশ্ন ঘুরছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
Published : 12 Jun 2023, 01:46 AM
এক দশক পর পুলিশকে জানিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করল জামায়াতে ইসলামী; বাধা-বিঘ্নহীনভাবেই পালিত হল সেই কর্মসূচি; আর সেখানে পুলিশকে নেতা-কর্মীদের ফুল উপহার দেওয়ার ছবি ঘুরছে সোশাল মিডিয়ায়।
তার আগে ২০১৩ সালের পর থেকে এতদিন চিত্রটি ছিল ভিন্ন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে শীর্ষনেতাদের দণ্ডিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের তাণ্ডবের প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালের পর থেকে ঢাকায় পুলিশের অনুমতি নিয়ে সমাবেশ করতে পারেনি দলটি।
নানা সময়ে ঝটিকা মিছিল বের করলেও তাদের কোনো কার্যক্রমই নির্বিঘ্ন ছিল না। কর্মসূচি পালনে নেমে, এমনকি ঘরে সভা করতে গিয়েও গ্রেপ্তার হতে হয়েছে দলটির নেতা-কর্মীদের। দলটির আমির শফিকুর রহমান এবং সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মো. গোলাম পরওয়ারও এখন বন্দি।
এরমধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের এক বছরেরও কম সময় আগে শনিবার রাজধানীতে জামায়াতের কর্মসূচি পালন রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা কৌতূহল যেমন তৈরি করেছে, আবার বিবাদমান দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের আচরণে নানা প্রশ্নও তৈরি করে দিয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই কি জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে? না কি বিএনপি আন্দোলনের জোর বাড়াতে ভিন্ন কৌশলে নামিয়েছে জামায়াতকে? না কি জামায়াতের ভিন্ন কোনো কৌশল রয়েছে? এমন সব প্রশ্ন ঘুরছে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতকে ভোটের রাজনীতিতে বরাবরই বড় দলগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখা গেছে।
নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানোয় জামায়াত এক দশক ধরে দলীয় প্রতীকে ভোট করতে না পারলেও আগের সব নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে ধারণা পাওয়া যায়, দলটির ৫ শতাংশের মতো ভোট রয়েছে।
এই ভোট বিএনপির সঙ্গে যোগ করে ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের অংশীদারও হয়েছিল দলটি। দুই যুগ ধরে একসঙ্গে জোটে থাকার পর এখন সেই জোট আর নেই। তবে তাদের সম্পর্ক কি একেবারেই ছিন্ন হয়েছে, তা মনে করেন না আওয়ামী লীগ নেতারা। আবার বিএনপি নেতারা মনে করছেন, তাদের সঙ্গে দূরত্বের সুযোগে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে কাজে লাগাতে চাইছে।
বিএনপি চুপ, মিত্রদের সন্দেহ
জামায়াত প্রশ্নে বিএনপির রাখঢাক সব সময়ের। জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোটে আর নেই, সেই কথাটি স্পষ্টাস্পষ্টি বলতে অনেক সময় নেয় তারা।
১৯৯১ সালে সরকার গঠনে বিএনপিকে নিঃশর্ত সমর্থন জামায়াত দিলেও পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নেমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আসে।
তবে এরপর ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠন হলে সেখানে জামায়াতও যোগ দেয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি জোটের আকার বাড়িয়ে ১৮ দলীয় এবং পরে ২০ দলীয় জোট গঠন করে। তখনও জামায়াত ছিল।
তবে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই জোটের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে আরও একটি জোট গঠন করে বিএনপি। সেখানে জামায়াত না থাকলেও নির্বাচনে দলটির প্রার্থীরা বিএনপির প্রতীক নিয়ে অংশ নেয়, কেননা ততদিনে তারা ইসির নিবন্ধন হারিয়েছে।
এখন বিএনপি সব জোট বাদ দিয়ে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিলেও সেই আন্দোলনে জামায়াতকে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।
সেই জামায়াতকে এখন সরকার কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিএনপির এখনকার মিত্র নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
তিনি রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “জামায়াতের ব্যাপারটা কিন্তু বিস্ময়কর। সরকার কত খানি দেখেন দ্বিধান্বিত, দ্বিধাগ্রস্থ; বুঝতে পারছে না কী করবে? কারণ জামায়াতের লোকজন যখন পারমিশন চাইতে গেছে, তাদেরকে গ্রেপ্তার করেছে, আবার দেড় ঘণ্টার মধ্যে ছেড়েও দিয়েছে। পরে পারমিশনও দিয়েছে।”
জামায়াতকে মাঠে নামানোর জন্য বিএনপিকে দায়ী করাকে ক্ষমতাসীনদের কূটকৌশল বলে মনে করছেন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক সাইফুল হক।
তিনি বলেন, “১০ বছর তাদেরকে (জামায়াত) সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি। আবার হঠাৎ করে অনুমতি দিয়ে আবার দায় চাপানো হচ্ছে বিএনপির উপরে। এটাই হল সরকারের রাজনৈতিক কূটকৌশল.. এটা সর্বশেষ আরেকটা নজির।”
আবার জামায়াতকে দেখিয়ে চলমান আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার কৌশলও আওয়ামী লীগ নিতে পারে বলে সন্দেহ করছেন মঞ্চের নেতা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
তবে জামায়াতের সর্বশেষ অবস্থান নিয়ে বিএনপি নেতাদের কারও মুখ খোলানো যায়নি। এ বিষয়ক প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবি শুধু বিএনপি নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট যুগপৎভাবে আন্দোলন করছে।”
২০ দলীয় জোটে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা এই বিএনপি নেতা গত ফেব্রুয়ারি মাসেও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে বলেছিলেন, “জামায়াত নিয়ে আমরা কোনো কথা বলতে চাই না।”
অভিমানে দূরে জামায়াত, নেই যুগপৎ আন্দোলনে
জামায়াতের সমাবেশ: ‘রাজনৈতিক সমীকরণ’ দেখছে গণতন্ত্র মঞ্চ
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কিন্তু কেন?
জামায়াতের সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের কথাও একেকজনের একেক রকম। শনিবার জামায়াতের সমাবেশের পর থেকে ক্ষমতাসীন দলটির একাধিক নেতা কথা বলেছেন, কিন্তু তাদের কথার মিল পাওয়া যাচ্ছে না।
যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়তের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা যখন সরকার বলছে, তখন জামায়াতকে কর্মসূচি পালনের সুযোগ করে দেওয়া নিয়ে রোববার আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। তিনি তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেখিয়ে দেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “জামায়াত এখনও যেহেতু নিষিদ্ধ হয় নাই, রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা আবেদন করেছে, সেজন্য তাদেরকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবারই এক সভায় বলেন, বিএনপিই মাঠে নামিয়েছে জামায়াতকে।
সমাবেশে জামাত নেতাদের বক্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করে হাছান মাহমুদও বলেন, “বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রধান শরীক হচ্ছে জামায়াত। জামায়াতকে দিয়ে তারা এ কথাগুলো বলিয়েছে।”
তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক কিছুটা খোলসা করেই বলেছেন সাংবাদিকদের।
অনুমতি দেওয়া নিয়ে তিনি বলেন, “এটা রাজনৈতিক ব্যাপার। রাজনৈতিক কারণে, দেখা যাক। এটা একটা পলিটিক্যাল ডিসিশন।”
রাজনৈতিক কারণে জামায়াতকে অনুমতি: রাজ্জাক
অসৎ উদ্দেশ্যে জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে বিএনপি: কাদের
তবে কী কারণে এখন এই ধরনের ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ নেওয়া হল, তা স্পষ্ট করেননি রাজ্জাক।
তিনি শুধু বলেছেন, “তারা (জামায়াত) রাজনৈতিক দল, হাই কোর্টের রায় ছিল সংবিধানের সঙ্গে তাদের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক, গ্রহণযোগ্য না। এই প্রেক্ষিতেও তাদের তো অনেক জনগণের সমর্থন আছে। এই পরিস্থিতির আলোকে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। আপনারা একটু অপেক্ষা করেন, আরও দেখবেন কী হয়?”
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আব্দুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে বলেন, “বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশি-বিদেশি নানাজন গণতন্ত্র এবং কথা বলা অধিকার নিয়ে সোচ্চার এবং একটি বড় জনগোষ্টি তাদের সমর্থন করে। সবার কথা বিবেচনায় সরকার হয়ত সুযোগ দিয়েছে।”
জামায়াতের কাছে প্রত্যাশাও রাখছেন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী ফোরামের এই সদস্য।
“আমরা আশা করব, তারা দীর্ঘদিনের যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তি হিসেবে পরিচিত, সেটা জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে কলঙ্ক ঘোচাবে, সেই সাথে সাম্প্রদায়িক শক্তির যে ধারা তাদের দলের মধ্যে আছে, সেখান থেকেও ফিরে আসবে।”
জামায়াত কী চায়?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াত কী চায়, জানতে চাইলে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আমরা দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম করছি। আমাদের আমীরসহ অনেক নেতা-কর্মী কারাগারে, নির্যাতনের শিকার।
“কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা আমাদেরই দাবি ছিল। আমরা সেই দাবি নিয়ে এখন আন্দোলন আছি। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। এটা নিয়ে কোনো ধরনের সন্দেহ সৃষ্টির অবকাশ নেই।”
কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সমালোচনার মুখে জামায়াতকে কর্মসূচি পালন করতে দিয়ে সরকার দেখাতে চায়, বিরোধী দলকে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে সরকার।
জামায়াত নেতারাও তেমনটি মনে করছেন। দলটির মজলিশে শূরার একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কারণেই সরকার আজকে বাধ্য হয়ে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তারা বিদেশিদের দেখাতে চায়, সব রাজনৈতিক দলকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে।”
“হঠাৎ সমাবেশের অনুমতি নিয়ে যারা ভিন্ন কিছু ভাবছেন, তারা জামায়াতের পলিসি বুঝতে পারছেন না। জামায়াতে ইসলামীর উপর এত ঝড়-ঝাপটা বয়ে যাওয়ার পরও আমাদের কর্মীদের মনোবল ভাঙেনি,” বলেন তিনি।
জামায়াত নেতারা বলছেন, আপাতত তারা ‘একলা চলো’ নীতিতেই এগোচ্ছেন।
এক দশক পর ঢাকায় জামায়াতের সমাবেশ, সরকার ও বিরোধীদের নিয়ে ঐক্যের ডাক