স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু যে তরুণ বয়সে ১৯৫৬ সালে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে স্টকহোম সফর করেছিলেন ওই প্রসঙ্গ কোনো আলোচনাতেই আসে না।

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 11 Oct 2022, 10:20 AM
Updated : 11 Oct 2022, 10:20 AM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্টাডি সেন্টার’ এবং ‘কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র’ যৌথভাবে অক্টোবরের ১২ তারিখে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের ধারাবাহিকতায় একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে। এই সেমিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল, কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবদুল বাছির ছাড়াও ঢাকাস্থ সুইডিশ দূতাবাসের প্রথম সচিব আনা সভান্তেসন এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্টাডি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক শিকদার মনোয়ার মোর্শেদ অংশ নেবেন। সেমিনারের বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং বঙ্গবন্ধু’। এই সেমিনারের প্রাক্কালে ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং বঙ্গবন্ধু’ প্রসঙ্গে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ আর ভাবনার কথা তুলে ধরতে চাই।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভারত পাকিস্তানের ইতিহাস ও রাজনীতির যোগসূত্র ছাড়াও রাশিয়া, চীন বা দুনিয়ার অপরাপর অংশের রাজনীতি ও জননেতার নামের ও কাজের সঙ্গে নানা প্রসঙ্গ ও যোগসূত্র বিদ্যমান। মোটাদাগে বললে আমরা বলতে পারি ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, চিলির আলেন্দে, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রো এরকম। কিন্তু স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগসূত্র এবং রাজনীতি ও দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা হয় না বললেই চলে। অথচ বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও রাজনীতির সঙ্গে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মূল্যবোধের দারুণ মিল। বঙ্গবন্ধু তার ৫৫ বছরের জীবনে অল্প কয়েকটি দেশে সফর করেছিলেন। তার মধ্যে আলজেরিয়ার জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান, বিলেত আর নেদারল্যান্ড ভ্রমণ এবং সেই সঙ্গে চীন আর রাশিয়া ভ্রমণের কথাই ঘুরেফিরে আসে। বঙ্গবন্ধু যে তরুণ বয়সে ১৯৫৬ সালে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে স্টকহোম সফর করেছিলেন ওই প্রসঙ্গ কোনো আলোচনাতেই আসে না।

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক দফতরগুলোও কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি বা ভূমিকা রাখতে তেমন কোনো উদ্যোগ বা আন্তরিকতাও দৃশ্যমান নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সেমিনারকে সামনে রেখে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশের একটি দূতাবাসে বঙ্গবন্ধুর স্টকহোম সফর নিয়ে বিস্তারিত তথ্য ও ছবির তালাশ করে একটি মেইল করেছিলাম। সংশ্লিষ্ট দূতাবাস মেইলটির উত্তর দেবার প্রয়োজনটুকুও বোধ করেনি।

এবার স্ক্যান্ডিনেভিয়া বিষয়ে একটু আলোকপাত করে এই অঞ্চলে বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কথা বলব। স্ক্যানিনেভিয়া বলতে ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং সুইডেনকে বোঝানো হয়। ভৌগোলিকভাবে এই তিনটি দেশ যেমন একে অপরের সঙ্গে লাগোয়া, অন্যদিকে দেশ তিনটির আলাদা তিনটি স্বতন্ত্র ভাষার রয়েছে ভিত্তিগত মিল। একজন দিনেমারকে সুইডিশ ভাষায় মেইল করলে তার উত্তর আসবে দিনেমার ভাষায়। একই অবস্থা নরওয়েজিয়ান ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গেও। এই তিনটি দেশের মানুষ পরস্পর যখন কথা বলেন নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা-আলাপ চালিয়ে যান। বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বা সৌহার্দ্য আর সহযোগিতার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব দৃশ্যমান। নিজস্ব স্বতন্ত্র সংস্কৃতি রক্ষা করেও বৈচিত্র্যময় সহোযোগিতা বা অংশীদারিত্বমূলক স্ক্যান্ডিনেভিয় যৌথ কার্যক্রম চালিয়ে নিতে কোনোই সমস্যা নাই।

এই তিনটি দেশের অতীতের রাজনীতি কেমন ছিল সেটা জানা যাক। ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত সুইডেনের। সুইডেনের দক্ষিণ অংশ বিশেষ করে মালমো বা স্কনে এলাকা একসময় ডেনমার্কের অংশ ছিল। এক পর্যায়ে তা সুইডেনের অংশ হয়ে গেছে। অন্যদিকে নরওয়ে একসময় ডেনমার্কের কলোনি ছিল। ওই সময় দেশটির রাজধানীর নাম পাল্টে ডেনমার্কের রাজার নামানুসারে ক্রিস্টিয়ানিয়া রাখা হয়েছিল। পরে নরওয়ে ডেনমার্কের কবলমুক্ত হয়ে সুইডেনের সঙ্গে একীভূত হয়। ওই সময় নরওয়ের দুজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হতো একজন অসলোতে আরেকজন স্টকহোমে। বহুল পরিচিত নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের ছেলে সিগরুদ ইবসেন স্টকহোমস্থ নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গিয়ে স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে নরওয়ে যাত্রা করে। আজকের যে পৃথিবীর ইতিবাচক আদর্শের নমুনা হিসেবে স্ক্যান্ডিনেভিয়া গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয় তার ভিত্তি মূলত নির্মিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, যে সময় বঙ্গবন্ধু ভারত উপমহাদেশে উদীয়মান এক তরুণ নেতা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এই অঞ্চলের কোনো দেশের অবস্থা আজকের মতো এতটা সুবিধাজনক ছিল না। এখানে উল্লেখ্য যে আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রের ধরণা প্রথম প্রবর্তিত হয় সুইডেনে ১৯৩৬ সালে। এরপর ইউরোপের অন্যান্য দেশে তা প্রসারিত হয়, ডেনমার্ক নরওয়ে তো বটেই। এই তিনটি দশের মধ্যে যে সৌভ্রাতৃত্ব তার ভিত্তিটাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কার্যকরণ পরিণতি। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নরওয়ের শরণার্থীদের বিশেষ করে শিশুদের ব্যাপকভাবে সাহায্য করে ডেনমার্ক এবং সুইডেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নরওয়ের সরকার রাজধানী অসলোতে সমুদ্র তলদেশ থেকে ৫০১ মিটার উঁচুতে হল্মেনকল্লেনে অবস্থিত ভোকসেনওশেন বা ভকসেন পাহাড়ে দুটি সংস্কৃতি সম্মেলন কমপ্লেক্স নির্মাণ করে এর একটি সুইডেনকে এবং একটি ডেনমার্ককে উপহার হিসেবে প্রদান করে। সুইডিশ কেন্দ্রের নাম ভোকসেনওশেন আর দিনেমার কেন্দ্রের নাম লিসেবু।

দেশ তিনটির মাঝে এরকম পারস্পরিক আদান-প্রদানমূলক সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণার প্রবর্তন অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধকল কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয় ও উদ্যোগে এই তিনটি দেশ একে অপরের তরে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে। পাশাপাশি পৃথিবীর ক্ষমতার মেরুকরণের দুই বলয়ের বাইরে জোটনিরপেক্ষ বা ভাবমূর্তি অর্জন করতে পেরেছিল। যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নবপ্রতিষ্ঠিত জাতিপুঞ্জ বা জাতিসংঘের প্রথম দু-জন মহাসচিবের প্রথমজন ছিলেন নরওয়ের ট্রিগভে লি আর দ্বিতীয় জন সুইডেনের বহুল পরিচিত দগ হ্যামারশোল্ড।

ঠিক এমন সময়েই ১৯৫৬ সালে স্ক্যান্ডিনেভিয়া সফর করেন তরুণ বঙ্গবন্ধু যিনি ইতোমধ্যেই দলীয় নেতা, জাতীয় পরিষদের সদস্য এমনকি মন্ত্রী হবার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অর্জন ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি। ভাষা সংস্কৃতি, পরিবার, সমাজ, সমতা আর সামগ্রিক বা একান্নবর্তী রাষ্ট্র ও সমাজ রূপান্তরের যে নমুনা স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় রচিত হচ্ছিল ধীরে ধীরে তা দেখার বোঝার এবং তা থেকে পাঠ নেবার সুযোগ এবং আগ্রহ দুটোই বঙ্গবন্ধু কাজে লাগিয়েছিলেন এমন ধারণা আমরা করতেই পারি। এর দেড় দশক পরে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং রাষ্ট্রপ্রধান তার রূপরেখায়, তার কথা ও কাজে যে প্রতিধ্বনি আমরা খেয়াল করি তা যদি দুনিয়ার ক্ষমতার বলয়ের বাইরে কেবল জনকল্যাণের নিরিখে দেখি তা অনেকটাই স্কান্ডিনেভিয় নমুনা। স্ক্যান্ডিনেভিয়া বিশেষ করে সুইডেন প্রতিটি ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে একের পর এক সংস্কার সাধন করেছে, নির্মাণ করেছে পরিকাঠামো এবং অবকাঠামো।

বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিনবছরের শাসনামলে তার সংস্কারগুলো যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে বুঝতে পারব তা কতটা স্ক্যান্ডিনেভিয় অঞ্চলের সঙ্গে মিলে যায়। ১৯৩০-এর দশকে শুরু হওয়া কল্যাণরাষ্ট্রের ধারার পক্ষে ধাপে ধাপে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমিক সংস্কার উদ্যোগে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে দেশগুলোর পেশাজীবী নেতৃত্ব বা বুদ্ধিজীবীদের সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করার মতো। বেশি উদাহরণ দিতে হবে না, বঙ্গবন্ধুর সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে তিনি কতটা স্কান্ডিনেভিয় আদলের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বা ধারণা নিয়েছিলেন। সুইডেনে চলচ্চিত্রের সংস্কার বা এর অনুকূলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিশেষ করে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তুলনা করে নিতে পারি।

সুইডেন বা স্ক্যান্ডিনেভিয় অঞ্চলের দেশগুলোতে ঘোষিত সমাজতন্ত্র না থাকলেও ওই সময় শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, পরিবহনসহ প্রায় সকল সেবাখাত জাতীয়করণের আওতাভুক্ত ছিল। তিনি শুরুর দিকে সংসদীয় গণতন্ত্রের মোড়কে বা আদলে এরকম জনকল্যাণমূলক জাতীয়করণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন। পরে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। আদতে এটিকে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের এক বৈপ্লবিক কর্মসূচি মনে করেই বঙ্গবন্ধু অগ্রসর হচ্ছিলেন।

স্ক্যান্ডিনেভিয় অঞ্চলের আধুনিক জীবনের মূল্যবোধগুলোর একটি হচ্ছে নারী শিশুর মর্যাদার স্বীকৃতি বা রক্ষাকবচ হিসেবে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে কার্যকর করা। এরকম দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ব্যক্তিগত, পারিবারিক আর জাতীয় কর্মকাণ্ডে বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছিলেন। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার সহধর্মিনী ফজিলাতুন নেসা মুজিবের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। অনেকে স্ক্যান্ডিনেভিয় অঞ্চলের সমাজ সংসার আর রাষ্ট্রকে নারী শাসিত অঞ্চল মনে করেন। বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত দেশ শাসন, প্রশাসন আর রাজনীতিতে ধাপে ধাপে নারীর অংশগ্রহণ আর তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন নারীদের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েও। এমনকি তার লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থগুলোতে এরকম নানা দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাধারার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই।

বঙ্গবন্ধু নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অহিংস রাজনীতির দীক্ষা সোহরাওয়ার্দী এবং মহাত্মা গান্ধীর সংস্পর্শে এসে লাভ করেছিলেন। ঠিক এরকম আবহ দগ হ্যামারশোল্ডের কথা ও কাজের মধ্যে আমরা দেখতে পাই। তিনি বিশ্ব রাজনীতি ও ক্ষমতার বলয়ে কোনো দিকে অবস্থান না নিয়ে নিপীড়িত গণমানুষের দেশগুলোর পক্ষের কণ্ঠস্বর হিসেবে তার ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন। তিনি পরিষ্কার করতে চেয়েছেন জাতিসংঘ দুর্বল ও নবীন রাষ্ট্রগুলোর কণ্ঠস্বর। জাতিসংঘ বৃহৎ কোনো শক্তির প্ল্যাটফর্ম হয়ে ভূমিকা রাখুক এরকম তিনি চাননি। ঠিক একই রকম চেতনার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু যখন দুনিয়ার মানুষের উদ্দেশে, নেতৃত্বের উদ্দেশে আলোচনা করেন।

ঠিক একই রকম প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের তাৎপর্যের মাঝে। যে উদ্যোগ ও তৎপরতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জোরালো ভূমিকা ছিল। এ প্রসঙ্গে আমরা সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী ওলফ পালমের রাজনৈতিক তাৎপর্যের সঙ্গেও মিল খুঁজে পাব। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বা তার দল আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আমাকে ইউরোপের কেউ জিজ্ঞেস করলে, বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয় অঞ্চলের কোনো আলোচনায়, আমি এক কথায় তুলে ধরার জন্যে বলে থাকি আওয়ামী লীগ হচ্ছে স্কান্ডিনেভিয় অঞ্চলের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা সমাজবাদী গণতন্ত্রী পার্টি। এখানে পরিষ্কার করে দিতে চাই, এই আওয়ামী লীগ বলতে আমি বর্তমান মুক্তবাজার ধারার আওয়ামী লীগকে বোঝাতে চাচ্ছি না, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে বোঝাতে চাই।

স্ক্যান্ডিনেভিয় অঞ্চলের অনেক কিছুর সঙ্গেই বঙ্গবন্ধুর আগ্রহী হয়ে ওঠার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এর মাঝে বড় একটি কারণ হতে পারে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখালেখির প্রতি ছিলেন দারুণ আগ্রহী। সেই কবিগুরু যিনি বঙ্গবন্ধুর জন্মের আগেই ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর নিজের ছিল পারিবারিক গ্রন্থাগার, স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়ির মতো তার বাসগৃহেও ছিল বই আর পত্রপত্রিকা সম্বলিত এক আলোকিত পরিমণ্ডল। এই পরিমণ্ডলে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের সমাজ সংস্কৃতি অর্থনীতি ও রাজনীতিতে অনেক ইতিবাচক অগ্রগতি ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়– এসব তার মনোযোগ এড়িয়ে যাবার কথা নয়।

একই সঙ্গে তিনি যে অস্তিত্ববাদী দিনেমার দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্ড এবং হান্স ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসনের লেখাজোকার সঙ্গেও পরিচিত হয়ে থাকবেন, তা অনেকটাই স্বাভাবিক। কেননা তার পারিবারিক গ্রন্থাগার ছিল দেশ-বিদেশের নানা বইয়ে সমৃদ্ধ। তিনি নিজে বইয়ের সঙ্গে সময় কাটাতেন সুযোগ পেলেই।

ব্রিটিশরা ছাড়াও বঙ্গভূমির সমৃদ্ধি আর জলপথের যোগাযোগের সুবিধায় ইউরোপের বেনিয়া জাতিরাষ্ট্রগুলো আরও সাতটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই সাতটির মধ্যে স্কান্ডিনেভিয় অঞ্চলের দুটো। দিনেমারদের ড্যানিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং সুইডেনের ছিল সুইডিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বঙ্গবন্ধু রাজনীতির পাঠ ও ভিত্তি গড়ার জন্যে সোহরাওয়ার্দীর ডাকে কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তরুণ বয়সে। সেই সোহরাওয়ার্দী শিক্ষা লাভ করেছিলেন বিলেতে এবং সারা দুনিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতি প্রসঙ্গে খোঁজ খবর জানা ছিল তার। এর প্রভাব তো বঙ্গবন্ধুর উপর স্বাভাবিকভাবেই পড়ার কথা।

তাই বাংলার সঙ্গে স্ক্যান্ডিনেভিয় অঞ্চলের যোগাযোগ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল। ধারণা করা যায় তা কয়েক শ বছরের।

বঙ্গবন্ধুর ওপর মোটাদাগে সোভিয়েত উনিয়নের রাজনৈতিক প্রভাব বা চীনের সাম্যবাদী ধারার অর্থনীতির কথা বলা হলেও, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে আমরা যদি আধুনিক কার্যকর কোনো কর্মসূচির সঙ্গে তুলনা করতে চাই তবে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের কল্যাণকর অর্থব্যবস্থার সঙ্গে অনেকাংশে মিল খুঁজে পাব। বঙ্গবন্ধু যে স্থানীয় প্রশাসনের সংস্কারের কথা ভেবেছিলেন বা উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা উত্তর ইউরোপের এই অঞ্চলের কমিউন বা ইউনিয়ন বা নগরসংস্থার ধারণা থেকে দূরবর্তী কিছু নয়।

এদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দীক্ষা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নানাভাবে মিলে যায়। চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে দগ হ্যামারশোল্ডের চীনে ছুটে যাওয়া– তখন পর্যন্ত চীন জাতিসংঘের সদস্যই হয়নি, আফ্রিকায় ছুটে গিয়ে ট্রাজেডির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করা। অন্যদিকে সুইডেনের সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ওলফ পালমে আততায়ীর হাতে প্রাণ দেয়ার ঘটনা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির যোগসূত্রকে এড়িয়ে দেয়া যাবে কি? এসব নিয়ে গভীরের চুলচেরা গবেষণা আর বিশ্লেষণ করলে অনেক সত্য বেরিয়ে আসতে পারে।

বঙ্গবন্ধুকে বা ওলফ পালমেকে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কাদের স্বার্থ কাজ করেছিল? করা এরকম নেতৃত্বের প্রতি নাখোশ ছিল? কেন নাখোশ ছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলেই বোঝা যাবে বঙ্গবন্ধু কতটা স্কান্ডিনেভিয় ছিলেন এবং ওলফ পালমে কতটা বাংলাদেশ বা ভিয়েতনামের নিপীড়িত মানুষের কাছাকাছি ছিলেন। বাংলাদেশের বুকে আমরা যেমন স্লোগান দেই, লাওসের শেখ মুজিব, ভিয়েতনামের শেখ মুজিব। এই একই স্লোগান ওলফ পালমের বেলাতেও সত্য।

এই অঞ্চলের গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধুর প্রতি মনোযোগী ভূমিকা রেখেছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং তৎপূর্বে। এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো এবং দেশের মানুষেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো সমর্থন দিয়েছিল এমনকি ওইসব স্ক্যান্ডিনেভিয়া প্রতিনিধি দল ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্যে এই ভূখণ্ড পর্যন্ত এসেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে প্রথম দিকে যে রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রতি সমর্থন দিয়েছিল তাদের মধ্যে স্কান্ডিনেভিয় অঞ্চলের দেশগুলো অন্যতম।

এমনকি ১৯৭৫ সালে ট্রাজেডির পর আন্তর্জাতিক পরিসরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রথম ডাকটি এসেছিল এই স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকেই। এই ডাকটি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, স্টকহোমের এক সমাবেশ থেকে ১৯৭৯ সালে।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ার জীবন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ভাবদর্শনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সাদৃশ্য পাদপ্রদীপে না এলেও অদৃশ্যত এর তাৎপর্য ও সুদূর প্রসারী প্রভাব উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। যা কার্যকর গবেষণা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এই কাজের ভার দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এবং জাতিরাষ্ট্র হিসেবে সর্বাগ্রে আমাদের বাংলাদেশের।