দীর্ঘমেয়াদী শাসনে একবার সক্ষমতা অর্জন করেছে বিধায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায় প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর ভিন্ন মতাদর্শী সরকার ক্ষমতায় এলেও এই দেশগুলো পশ্চাৎমুখী তো নয়ই, শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবনমান উন্নত করেই চলেছে। গণতান্ত্রিক ধারাও অব্যাহত রয়েছে।
Published : 15 Dec 2023, 11:49 PM
আমাদের জীবনে ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা দিবসটি অতীব তাৎপর্য ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন হলেও ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবস আনেক আবেগপূর্ণ। বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত করা বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত প্রথম দিনটিতে জড়িয়ে আছে পরাধীনতার শৃংখল ভেঙে বিশ্বের মানচিত্রে প্রথবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মের অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে পরবর্তী নয়টি মাস ধরে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তখনকার সাড়ে সাত কোটি বাঙালি প্রাণপণ যুদ্ধ করেছে। অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। শত্রুর হাতে অত্যাচারিত হয়েছে। একই সাথে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তা হয়েছে আধুনিক যুদ্ধে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র, হত্যা ও নির্যাতনের মুখে নিরস্ত্র বাঙালির মনোবল টিকে থাকবে তো?
তখনকার পশ্চিমা পত্রপত্রিকা পড়ে কখনো মনে হয়েছে আমাদের যুদ্ধটি আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো রক্তক্ষয়ী ও আট বছরের মতো দীর্ঘস্থায়ী হবে। কখনো মনে হয়েছে ষোলো বছর ধরে চলতে থাকা ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো আমাদের যুদ্ধও অদূর ভবিষ্যতে শেষ হবে না। কখনো মনে হয়েছে আমাদের উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অথবা পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মতো অথবা উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মতো মীমাংসাহীন দ্বিধাবিভক্তর পরিণতি হবে! এসব চিন্তার কারণ, আলজেরিয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কোনো দেশই সশস্ত্র সংগ্রাম করে স্বাধীনতার মুখ দেখেনি! অথচ পরম পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সেই অসম যুদ্ধটিই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা কি উল্লিখিত দৃশ্যমান ওই উদাহরণগুলোর একটি হয়ে থাকব? দুশ্চিন্তা ও ভয়ে দেহ-মন কুঁকড়ে উঠত। পাকস্তানি সেনা ও রাজাকারের স্পর্ধা ও অত্যাচারে প্রতিটি দিন কাটত অসীম উৎকণ্ঠায়। প্রতিটি ভোরের আগমন হতো নতুন, স্বাধীন একটি দিনের প্রত্যাশায়।
কিন্তু মুষ্টিমেয় ধিকৃত কিছু বিরোধী রাজাকার ছাড়া স্বাধীনতার প্রত্যয়ে দেশের প্রতিটি মানুষ অবিচল থাকায়, মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, মুজিবনগর সরকারের প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব এবং মানবিকতার হাত ধরে প্রতিবেশি ভারত ও অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে আসার ফলে বাঙালির অসংখ্য প্রাণ, সম্ভ্রম ও সম্পদহানির বিনিময়ে সেসব দুর্ভাবনার অবসান হতে চলেছে। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার ও হত্যার অবসান ঘটিয়ে আমাদের প্রতীক্ষার দিন শেষ হতে যাচ্ছে। একাত্তরের নভেম্বরে থেকে ডিসেম্বরের শুরু পর্যন্ত বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান সফল আক্রমণে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। প্রায় শত বছরের পৃথিবীর ইতিহাসে ন্যূনতম, মাত্র নয় মাসের যুদ্ধের ফলস্বরূপ ১৬ই ডিসেম্বর অবতীর্ণ হয়েছিল স্বর্গের এক দুয়ার উন্মোচন করে। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, প্রতিটি গ্রামে, মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস। স্বজন ও সম্পদ হারানোর বেদনা ভুলে সব শ্রেণির মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা এবং সহযোগী ভারতীয় সেনাদের স্বাগত জানাতে। আমিও ছিলাম সেই মিছিলে। অস্ত্র হাতে ছুটে বেড়িয়েছি ঢাকার রাজপথে।
সে এক অবিস্মরণীয় অনুভূতি। শুধু স্বাধীন নয়, পৃথিবীতে এবার আমরা উন্নত ও গর্বিত জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াব। অনেকের মতো ১৬ই ডিসেম্বরের স্মৃতি ও আবেদন আমার কাছে তাই অমলিন ও আবেগময়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সমস্ত শহীদদের প্রতি দিনটির প্রতিশ্রুতিও অসীম। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দিনটির তাৎপর্য এবং প্রত্যাশাও অসীম।
শত্রুমুক্ত হয়ে দেশ স্বাধীন হলো। দীর্ঘদিন মোঘল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের শোষণের ফলে এই অঞ্চলের শিল্প ও কৃষির অবস্থা হয়েছিল খুবই করুণ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই সচেষ্ট হলেন দেশটিকে পুনর্গঠিত করতে, সোনার বাংলা গড়তে। ন্যূনতম সময়ে ভারতীয় সৈন্য ফেরত পাঠানো, ভারতে নির্বাসিত এক কোটি এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া পাঁচ লক্ষ বাঙালিকে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন, এবং একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মতো দুরূহ কাজ সফলভাবে শেষ করলেন। কিন্তু একশ্রেণির রাজনীতিবিদ রাতারাতি দেশের সব সমস্যা সমাধানের অবাস্তব দাবি করল। গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিরোধী শক্তিকে প্রাণ খুলে কথা বলতে দিলেন। এই সুযোগে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু, অপরিণামদর্শী কিছু বুদ্ধিজীবী এবং অত্যুৎসাহী বিপ্লবীরা সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের নামে কুৎসা রটনায় প্রবৃত্ত হলো। একপর্যায়ে নৃশংসভাবে সপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হলো।
এরপর শুরু হয়েছিল মুখে স্বাধীনতার বুলি আওড়ানো কিন্তু বাঙালি স্বার্থ ও সংস্কৃতিবিরোধী দীর্ঘ কুড়ি বছরের সামরিক ও সেনানিবাসে বসবাসকারীদের শাসন। আমাদের জাতশত্রু পাকিস্তানকে পরম মিত্রে পরিণত করে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ও নির্যাতিতাদের সাথে। সংবিধানে স্বৈরাচারী পরিবর্তন এনে দেশে স্বাধীনতার শত্রুদের পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। বিশ্বের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন হয়েছিল ভুলুন্ঠিত। ক্ষমতা, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার্থে হয়নি পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের তালিকা থেকে মাথা উঠানোর চেষ্টা। বিতর্ক সৃষ্টি করে স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসের তাৎপর্যকে করা হয়েছিল অপমান।
প্রতিবাদস্বরূপ সৈয়দ শামসুল হক লিখলেন ‘বল্লার চরে আল্লা আছে’ নামের গল্প। একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত যেসব বুদ্ধিজীবী সরকারবিরোধী রাজনীতির শিকার হয়ে তাঁদের কলম শানিয়েছিলেন, কিছুদিনের মাঝেই তাঁদের মোহভঙ্গ শুরু হলো। ‘জাসদ করে আমার জীবনের অনেকগুলো বছর’ হারানো আহমদ ছফার মতো নন্দিত চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী আরও লিখলেন ‘আমি ভুল প্রেমিকের ওপর আস্থা স্থাপন করেছিলাম’ (আহমদ ছফা নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃ-২৪০)। ‘তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান’ প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে পুনর্মূল্যায়ন করে ১৯৮৯ সালে তিনি লিখলেন ‘…এই মানুষটি বাঙালি জাতির আত্মবিকাশের সংগ্রামের পথে যে সমস্ত শক্তি বাধা দিয়ে এসেছিল সে সকল শক্তি আজ কাপালিক উল্লাসে এইখানে একটি নতুন পাকিস্তান সৃষ্টি করার আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে’ (আহমদ ছফা নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃ-২৩০-২৩২)। এইরূপ অনুশোচনাকারী আহমদ ছফা একাই ছিলেন না। কিন্তু ততদিনে দীর্ঘ কুড়িটি বছর পেরিয়ে গেছে, বাংলাদেশও তাঁর আদর্শিক স্বপ্ন ও জন্ম থেকে অনেক পিছিয়ে গেছে। সৌভাগ্যবশত অধৈর্য হওয়ার কুফল ভোগ করে পরবর্তীতে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা স্লোগানসর্বস্ব রাজনীতিবিদদের চটকদারি প্রতিশ্রুতিতে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন, যা এখনও অব্যাহত আছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রথমে ১৯৯৬ এবং পরে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই দৃঢ়তার সাথে তাঁর পিতার অসমাপ্ত কাজে হাত দিলেন। অত্যন্ত সফলতার সাথে চমকপ্রদভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা একে একে সমাধান করে চলেছেন। বাংলাদেশকে এখন আর কেউ ভিক্ষার ঝুলি বলার সাহস পায় না। তাঁর পরম শত্রুরাও তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত বাংলাদেশের আর্থ, সামাজিক ও অবকাঠামো ঊর্ধ্বগতির সুফলকে উপেক্ষা করতে পারেন না। দেশের জন্য তাঁর সফলতার ফিরিস্তি দিতে গেলে এই লেখা কখনো শেষ হবে না। তবে মাত্র দুটি উদাহরণ দিয়ে দেশের মঙ্গল নিয়ে তাঁর দূরদৃষ্টি, দীর্ঘদিনের অঙ্গীকার এবং নিষ্ঠার সাথে তা বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করতে চাই।
প্রথম ক্ষমতারোহণের দশ বছর পূর্বে, শেখ হাসিনা ১৯৮৬ সালে সাপ্তাহিক ‘রোববার’-এ প্রকাশিত ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন ‘গ্রামই আমাদের জীবন।…গ্রামোন্নয়নের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সুষ্ঠু বিদ্যুতায়ন ব্যবস্থা’। লক্ষ্যণীয় যে প্রতিজ্ঞানুযায়ী দেশকে পুরোপুরি বিদ্যুতায়নের পরিকল্পনা নিয়ে বিরোধী আন্দোলন-অভিযোগকে দৃঢ়তার সাথে পাশ কাটিয়ে ২০২১ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছেন। তেমনি ১৯৮৬ সালে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রায়’ ‘ওরা টোকাই কেন’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন “ফুটপাতে কেন শিশুরা বড় হবে? …প্রতিটি নাগরিকের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা শিক্ষা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে’। [উদ্ধৃত বাক্যগুলো ১৯৮৯ সালে আগামী প্রকাশনীর শেখ হাসিনা রচিত ‘ওরা টোকাই কেন’ বই থেকে নেয়া।] বিগত দুই বছরে আমরা দেখতে পেলাম পাঁচ লক্ষ গৃহহীন পরিবারকে জমির মালিকানা ও আয়ের ব্যবস্থা, পানি ও বিদ্যুতের আধুনিক ব্যবস্থাসহ পাকা বাড়ি তিনি করে দিয়েছেন। দেশের সমস্ত বাস্তুহারাকে এই আওতায় আনার কাজ অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান ও অতীত ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির আর কোনো দেশে জনকল্যাণকর এই ব্যবস্থার কোনো উদাহরণ খুঁজে পাবেন কি?
ক্ষমতায় না থেকেও সাতচল্লিশের পর থেকে বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক নেতা এতো সুদুরপ্রসারী চিন্তা ও পরবর্তী সুযোগেই তার বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন? একটি উদাহরণও আমরা দেখতে পাই না! বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ও দেশীয় পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শকে আমলে না নিয়ে সরকারি ভর্তুকিতে সারের দাম এক চতুর্থাংশে নামিয়ে এনে শেখ হাসিনা দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী করলেন। অতপর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে প্রমাণ করলেন বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি যেখানে শেষ হয় শেখ হাসিনা সেখান থেকে শুরু করেন! কোনো অজুহাতে আমরা তাঁকে আজ ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চাইব? আমেরিকা চায় বলেই কি? আমি চাই আগামী নির্বাচনেও তিনি তাঁর দল নিয়ে রাষ্ট্রের সেবায় নিয়োজিত থাকুন।
জানি আমার কিছু সুহৃদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমার এই অকুণ্ঠ সমর্থনে খুশি হবেন না। কারণ আমি বাংলাদেশে বাস করি না বলে প্রাত্যহিক যন্ত্রণার ভুক্তভোগী নই। কথাটি সত্যি হলেও বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দলীয় প্রতিটি ঘটনাই আমি প্রতিদিন অনুসরণ করি। স্বাধীনতার আগে ও পরের সেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই আমি আমার সিদ্ধান্তে উপনীত হই ও লিখিত আকারে বইতে প্রকাশ করেছি। তাঁদের প্রধান অভিযোগ, একনাগাড়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের অনেকেই অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়েছেন, দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করছেন, স্বাধীন মত প্রকাশের অন্তরায় হচ্ছেন এবং গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মগ্ন হয়েছেন। প্রথমত, এতে সত্যতা থাকার সমূহ সম্ভবনা থাকলেও প্রতিটি অভিযোগেরই যৌক্তিক উত্তর রয়েছে। তবে সবকিছু যোগ-বিয়োগ করার পর বছরের পর বছর যে ফল হাতে পাচ্ছি, তাতে সফলতা ও অর্জনের পাল্লা এতটাই ভারী যে আমার জীবদ্দশায় এমনটা দেখে যেতে পারব তা স্বপ্নেও ভাবিনি! এরপরও নিচের একটি আলোচনার দ্বারা আমি শেষ অভিযোগটির অসারতা প্রমাণের চেষ্টা করছি।
আধুনিক এশিয়ার যে পাঁচটি দেশকে আমরা অর্থনীতি, শিল্প, শিক্ষা, বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারণে উন্নত বলে জানি এবং প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখি, সেগুলো হচ্ছে জাপান, সিংগাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া এবং চীন। বাকি দেশগুলোর অনেকেই সম্পদশালী হলেও তাঁদের আমরা অনুকরণীয় মনে করি না। জাপানে ১৯৫৫-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ৪৩ বৎসর একটিমাত্র লিবারেল ডেমোক্রাটিক পার্টি ক্ষমতায় ছিল। মাত্র তিনজন প্রধানমন্ত্রীর শাসনে সিংগাপুরের পিপলস আকশন পার্টি ১৯৯০ সালে দেশটির স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত একনাগাড়ে ক্ষমতাসীন হয়ে আছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯৬১-১৯৭৯ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় ছিল। মহাথির বিন মোহাম্মদ মোট ২৭ বছরের ২৪ বৎসর (১৯৮১-২০০৩) একনাগাড়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। লক্ষ্য করুন ক্ষমতার উদ্দেশ্যে নয়, জনগণের কল্যাণে নিবেদিত বলে দীর্ঘকালীন ক্ষমতায় থাকা সময়েই এই চারটি দেশ উন্নত বিশ্বের দ্বারে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল বলে সেসব দেশে গণতন্ত্রের সমাধি হয়নি বরং সব সময়েই গণতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিতি পেয়েছে। অগণতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট শাসন হলেও ১৯৪৯ সালে স্বাধীনতার পর থেকে গণচীনও একটিমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। অথচ অর্থনীতি, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক বিচারে চীন আজ পৃথিবীর তৃতীয় পরাশক্তি হয়ে উঠেছে। এই সব উদাহরণ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে অনুন্নত বিশ্বে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নির্বিঘ্নে বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সরকারের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
ইতিহাস পাঠ থেকে শেখ হাসিনা সম্ভবত উপরোক্ত শিক্ষাই পেয়েছিলেন, যা তাঁর উপরোক্ত বইতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তাই সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্ত নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জনসমর্থন নিয়েই বারবার ক্ষমতায় ফিরে প্রজ্ঞা ও ইস্পাত-দৃঢ়তার বলে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলছেন। জনসমর্থনসহ একজন মাত্র শাসক বা দল ক্রমাগত ক্ষমতায় থাকলে কিছু লোকের অধিকার অবশ্যই ক্ষুণ্ন হয় ও হবে। গণতান্ত্রিক বিশ্বে সংখ্যায় তাঁরা অনেকও হতে পারেন, কিন্তু মোট জনসংখ্যার অনুপাতে তাঁরা নগণ্য। তাঁদের আকাঙ্ক্ষা, দাবি ও উদ্দেশ্য মহৎ হয়ে থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থের তুলনায় গ্রহণযোগ্য নয়। গণতন্ত্রের সংজ্ঞার এই মূল কথাটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা ভুলে গিয়ে জ্বালাও-পোড়াওয়ে মগ্ন হই। বর্তমানে প্রতিনিয়ত তার উদাহরণ দেখছি। এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্টকারীদের প্রতিহত করা কোনোমতেই মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়!
কিন্তু ভেবে দেখুন সৎ উদ্দেশ্যকে সমুন্নত রাখলে জনসমর্থন নিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি নিঃস্ব-দরিদ্র, অশিক্ষিত ও অনুন্নত জনগোষ্ঠীকে আশাতীত কম সময়ে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড় করাতে পারে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া এবং চীন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। [এই দেশগুলোর তুলনায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক ভারত এবং আমাদের চেয়ে বহুযুগ আগে স্বাধীন হওয়া ফিলিপাইনের তথাকথিত ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে’ বিজয়ী পরিবর্তনশীল সরকার তাঁদের বিরাট জনগোষ্ঠীকে চরম দারিদ্র্য ও নিম্নজীবনমান থেকে তুলে আনতে পারছে না। অন্যদিকে মিয়ানমারে ১৯৬২ সাল থেকে একনাগাড়ে সামরিক শাসন বলবৎ থাকলেও জনসমর্থন না থাকায় উন্নতি তো নয়ই, দেশটি এখন বহুধা বিভক্তির দ্বারপ্রান্তে!] এই দীর্ঘ সময়ের প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগের ফলে অবহেলিত জনগোষ্ঠী শুধু আর্থিকভাবেই লাভবান হয় না, সনাতন চিন্তাভাবনা ত্যাগ করে উন্নত জীবনধারণের মনমানসিকতাও রপ্ত করে ফেলে। [উদাহরণস্বরূপ এই পনেরো-বিশ বছর আগেও বাংলাদেশে গেলে পেট খারাপ রোগে না ভুগে কেউ ফিরতে পারত না। জনসচেতনতার ফলে এই নিয়ে বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের দুশ্চিন্তা অনেক কমে গেছে!] আর সেই মানসিকতা থেকে জন্ম নেয়া প্রজন্ম সরকার পরিবর্তন করলেও দেশ ও জনগোষ্ঠীকে আর পশ্চাৎমুখী হতে হয় না। উদাহরণ হিসাবে আবার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। দীর্ঘমেয়াদী শাসনে একবার সক্ষমতা অর্জন করেছে বিধায় প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর ভিন্ন মতাদর্শী সরকার ক্ষমতায় এলেও এই দেশগুলো পশ্চাৎমুখী তো নয়ই, শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবনমান উন্নত করেই চলেছে। গণতান্ত্রিক ধারাও অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে আমি তেমনই এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি। এবারের বিজয় দিবসে এই আমার প্রত্যাশা।