জাতীয় পুষ্টি পরিস্থিতি ধরে রাখতে ডিমের মতো পণ্যের দাম কেন তিন দফায় লাফিয়ে বাড়ল, সেটা খতিয়ে দেখা চাই। কোনো দিক থেকে ‘ম্যানিপুলেশন’ হয়ে থাকলে সেটাও বের করতে হবে।
Published : 17 Aug 2023, 04:44 PM
খামারে উৎপাদিত মুরগির ডিমের দাম হঠাৎ বেড়ে আবার কিছুটা কমে এসেছে। এ নিবন্ধ লেখার সময় মহল্লার চেনা মুদির দোকানে খোঁজ নিয়ে জানলাম, তিনি ১৫৫ টাকায় এক ডজন ডিম বেচছেন এখন। জানতে চাইলাম, আপনি কি ১৭০ টাকায় বেচেছেন এর মধ্যে? বললেন, না। তবে কোথাও কোথাও ১৭০ টাকায় এক ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। ডিমের দাম ১৭০-১৮০ টাকা হয়ে যাওয়ার খবর মিডিয়ায় এসেছিল। ডিম বলতে এখানে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বাদামি ডিমের কথাই বলা হচ্ছে।
সাদা ডিমও রয়েছে, যা সামান্য কম দামে বিক্রি হয়ে থাকে। আছে ‘দেশি মুরগির ডিম’। ‘দেশি হাঁসের ডিম’ও। কথাগুলো উদ্ধৃতি চিহ্নে রাখলাম এজন্য যে, দেশি, বিদেশি আর উদ্ভাবিত নতুন জাতের মধ্যে ক্রস হতে হতে কোনটা যে দেশি আর কোনটা বিদেশি, তা বলা এখন কঠিন। দেশি মুরগির মতো দেখতে ‘সোনালি মুরগি’ বেশ বিক্রি হচ্ছে আজকাল। এরও নানান জাত রয়েছে। তফাৎ করা কঠিন। আর সত্যিকারের দেশি মুরগির দাম অনেক বেশি। সেই মুরগির ডিম সাইজে ছোট হলেও দামে বিরাট। এর উৎপাদন কম; চাহিদাও।
আছে হাঁসের ডিম। দেশি হাঁস আজকাল কমই মেলে। নানান বাহারি নামের হাঁস পালন বেড়েছে। বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে এসবের পালন অনেক বেড়েছে এক-দেড় দশকে। বছরের দীর্ঘ সময় ওইসব এলাকা জলমগ্ন থাকায় হাঁস পালন সেখানে সুবিধাজনক বটে। ওগুলো প্রকৃতি থেকেই খেয়েদেয়ে বেড়ে ওঠে দ্রুত। ডিমও দেয় বেশি। এসব ডিম সাইজে বড়, পুষ্টিতেও বেশি। দাম বেশি হলেও এর চাহিদা আছে। ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ার এ ডামাডোলে ৭৫ টাকায় এক হালি হাঁসের ডিম কিনেছিলাম। পথে যারা সেদ্ধ ডিম বেচে, তাদের মধ্যেও খোঁজ নিয়ে দেখেছি—এ ডিম লোকে আগ্রহ নিয়েই খায়।
এক সেদ্ধ ডিম বিক্রেতা জানিয়েছেন, সার্বিকভাবে তার বিক্রি কমেছে এক বছরে। সেটাই স্বাভাবিক। গত এক বছরে ডিমের বাজার তো তিন দফায় অস্থির হলো। আট-দশ বছরে ডিমের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও গেল বছর ঠিক এই সময়ে এর দাম প্রথম বেড়েছিল লাফিয়ে। ‘লাফিয়ে’ মানে ২০ থেকে ২৫, ২৫ থেকে ৩০ টাকা ডজনপ্রতি দাম বেড়ে যাওয়া। সেটা যে কিছুটা কমে আসেনি, তা নয়। তবে প্রতিবারই দাম কিছুটা কমে এলেও আগের জায়গায় আর ফেরেনি। তাতে সেদ্ধ বিক্রি করা কিংবা রেস্তোরাঁয় ডিম মামলেটের দামও হয়ে পড়েছে উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল। ‘উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল’ কথাটা আরও বেশ কিছু নিত্যপণ্যের বেলায়ও খাটে। নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে এটা হলো কঠিনতম সংকটের জায়গা।
এখানে অবশ্য ডিমকেই ফোকাসে রাখতে চাইব। এটা এমন এক পণ্য, যা কেবল নিত্যব্যবহার্য নয়; বরং সর্বসাধারণ নানা কারণে এর ওপর নির্ভরশীল। ডিম পরিভোগের দিক দিয়ে আমরা অবশ্য উচ্চআয়ের দেশগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে। তা সত্ত্বেও এর পরিভোগ এখানে বাড়ছে এবং বেড়ে চলেছে ডিমের বিচিত্র ব্যবহার। একযোগে সুষম পুষ্টি লাভের দিক দিয়ে ডিমের তুল্য খাবার পাওয়া কঠিনও। সবচেয়ে বড় কথা, এটা প্রোটিনের সহজলভ্য উৎস। এর দামকে সর্বসাধারণের সাধ্যের মধ্যে রাখাটা তাই জরুরি। জাতীয় পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়নের সঙ্গে ডিমের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এর বাজার গত এক বছরে যেভাবে অস্থির হয়েছে, তাতে ভয় হয়—ডিম পরিভোগ কমে গিয়ে জাতীয় পুষ্টি পরিস্থিতি রক্ষাই কঠিন হয়ে পড়ে কিনা।
প্রাণিজ প্রোটিনের আরও যেসব উৎস রয়েছে, সেগুলোর দাম যদি সহনীয় থাকত, তাহলে না হয় বলা যেত, ডিমের দাম বেড়েছে তো কী হয়েছে—মুরগি খাও। মাছ খাও। গোমাংস তো সস্তা, সেটা খাও। দুধের দামও ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ডিম, দুধ, মাছ, মাংসের উৎপাদন যে বাড়েনি, তা কিন্তু নয়। সন্দেহ নেই, সেটা জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিরই প্রমাণ। কিন্তু উৎপাদন বাড়ালেই তো হয় না; এটাকে সহজলভ্যও রাখতে হয়।
ডিমের দাম বাড়বে না, এমন দাবি কিন্তু কেউ করে না। অন্যান্য জিনিসের মতো ডিমের দামও বাড়বে। অর্থনীতিবিদরা বরং বলবেন, ডিমের উৎপাদক আর বিক্রেতাদের তো এটা বেচে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হয়। সেসবের দাম যেহেতু বেড়েছে, তাই ডিমের দাম না বাড়লে তারা মারা পড়বে। তাছাড়া ডিমের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে তাদের পণ্যের দামও বাড়বে। মুরগির বাচ্চা, তার খাবার, ওষুধ, বিদ্যুৎ বিল, মজুরি ইত্যাদি বাড়লে ডিম স্বভাবতই তাদের বেচতে হবে বেশি দামে।
এক্ষেত্রে কথা হলো, স্বাভাবিকভাবে দাম বাড়লে তা নিয়ে তো প্রশ্ন ওঠে না; সেটা পুষিয়েও যায়। ২০১৩ সালে ৩৪ টাকায় এক হালি ডিম পাওয়া যেত, এটা ভাবতেই এখন অবাক লাগে। কেননা গত এক বছরে ২০-২৫-৩০ টাকা করে ডজনপ্রতি ডিমের দাম বেড়েছে দফায় দফায়। গেল করোনায় ভ্যানে করে ডিম বিক্রি হতো ১০০-১১০ টাকা দরে। সেটা বাড়তে বাড়তে ১৭০ টাকা, কোথাও কোথাও ১৮০ টাকা হয়ে রেকর্ড করে যদি ওখান থেকে নেমে এসে ১৫০ টাকায় স্থিত হয়, তাহলেও বলব—দামটা চড়া।
ছোট আর মাঝারি খামারিরা অবশ্য বলছেন, উৎপাদন ব্যয় বিবেচনায় দামটা ঠিক আছে। এটা বহাল থাকলে তারা কিছুটা লাভ করতে পারবেন। একটু লাভজনক দাম না থাকলে নতুন উদ্যোক্তাই বা আসবেন কেন? এ কথায় যুক্তি আছে। আমিও একটু আগে এটা বলতে চেয়েছি। ডিমের সঙ্গে ব্রয়লার মুরগির দামেও দেখছি একটা বৃদ্ধির প্রবণতা। এ দুটো স্বভাবতই পরস্পর সম্পর্কিত। এটাও বলব, দীর্ঘদিন বিচিত্র কারণে ব্রয়লারের দাম কিন্তু বাড়েনি। কখনও কখনও কমে যেতেও দেখা গেছে। খামারিদের লোকসানও দিতে হয়েছে নাকি। এজন্য ব্যবসাও ছেড়েছেন অনেকে। ডিমের ক্ষেত্রেও নাকি অভিজ্ঞতা কমবেশি এমন। গত এক বছরে দফায় দফায় দাম বৃদ্ধির ঘটনা বাদ দিলে তাদের অভিজ্ঞতা নাকি সুখকর নয়।
ব্রয়লার ও ডিমের দাম লাফিয়ে বাড়ার সময়—বাজার কিছুটা শান্ত হয়ে আসার আগের মাত্র কয়েকটা দিনে কারা কত অর্থকড়ি তুলে নিয়েছে, সেটা নিয়ে অবশ্য নানান কথা শোনা যায়। এর জোরালো কোনো তদন্ত হয়েছে বলে জানা যায় না। ভোক্তারা বিশ্বাসও করে না যে, এসবের রহস্যভেদ কখনও হবে। বাজার কিছুটা শান্ত হয়ে এলেই তারা খুশি। কোনো জিনিস—তা যত নিত্যব্যবহার্যই হোক, সেটার দাম কমে আগের জায়গায় কখনও ফিরবে বলে বোধহয় কেউই আশা করে না। সেটা স্বাভাবিকও নয়। এর বদলে মানুষ বাজারে স্বাভাবিকতা দেখতে পেলেই খুশি। যৌক্তিক দাম বৃদ্ধি নিয়ে তারা তো কখনও আপত্তি করেনি। হয়তো আক্ষেপ করে বলেছে—পাশাপাশি রোজগারটাও যদি বাড়ত!
ডিমের দাম ‘অস্বাভাবিকভাবে’ বেড়ে যাওয়ার সময়টায় বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, প্রয়োজনে এটা আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। মাঝে কাঁচামরিচের দাম অনেক বেড়ে গেলে তখনও তিনি আমদানির ওপর জোর দিয়েছিলেন। পেঁয়াজ আমদানিতে দেরি হচ্ছিল বলে তার মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে কিছুটা অসন্তোষও প্রকাশ করা হয়েছিল এর অনুমতি প্রদানের ক্ষমতার অধিকারী কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওপর। ডিম আমদানির অনুমতি দিলে অবশ্য দিতে হবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে। তবে এর মন্ত্রী বলেছেন, উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় ডিম আমদানির প্রয়োজন হবে না। তিনি জোর দিয়েছেন সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর।
বাজারে অব্যবস্থাপনা যে রয়েছে, তাতে কারও সন্দেহ নেই। ডিম উৎপাদকদের মধ্যে ছোটরা বড়দের অভিযুক্ত করছে, এমন পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে বারবার। যারা কম উৎপাদন করে, ‘মার্কেট শেয়ার’ বড়জোর ২০ শতাংশ—তারা কীভাবে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ করে ফায়দা লুটছে, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা অবশ্য নেই। এ খাতের করপোরেট হাউজগুলোও বলে যে, তাদের মুনাফা হচ্ছে না। দাম লাফিয়ে বাড়লে ‘অতীতের লোকসান’ কিছুটা পোষানো যায় বলেও তারা বক্তব্য দিয়ে থাকে। কথাটা কতখানি সত্য, সে প্রশ্নও আছে। তবে তাদের হিসাব আলাদা। তারা হয়তো একই সঙ্গে করছে ফিড ও মুরগির বাচ্চা সরবরাহের ব্যবসা। এতে করে হয়তো ভালোই পুষিয়ে যাচ্ছে।
না পোষালে কেউ ‘জাতীয় পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়নের স্বার্থে’ এ ব্যবসায় লেগে থাকার কথা নয়। বেসরকারি উদ্যোক্তার কাছ থেকে সেটা কেউ আশাও করে না। আশাটা সরকারের কাছে। তাকে জাতীয় পুষ্টি পরিস্থিতি ধরে রাখার স্বার্থে এ খাতে জরুরি দৃষ্টি দিতে হবে। প্রথমত, ডিমের মতো পণ্যের দাম কেন তিন দফায় লাফিয়ে বাড়ল, সেটা খতিয়ে দেখা চাই। কোনো দিক থেকে ‘ম্যানিপুলেশন’ হয়ে থাকলে সেটা বের করতে হবে—ভোক্তারা তেমন দাবি না জানালেও। সঙ্গত কারণেও কিন্তু বাজার অস্থির হতে পারে। চাহিদা বৃদ্ধি বা এটা একই রকম থাকার মধ্যেও কোনো কারণে ‘সাপ্লাই চেইন’ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এমন অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। বারবার একই ঘটনা ঘটা যদিও অস্বাভাবিক। দ্বিতীয় কথা, পোল্ট্রি খাতে বড় ও ছোট উদ্যোক্তার দ্বন্দ্বের জায়গায় অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। কমবেশি অর্ধেক খামার নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। জানা দরকার, এটি কী-সব কারণে ঘটেছে। উদ্যোক্তাদের একাংশের প্রস্থান অবশ্য স্বাভাবিক। তবে অনেকের প্রস্থানে অশুভ প্রতিযোগিতার প্রভাব থাকতে পারে। আত্মকর্মসংস্থান আর কর্মসংস্থানের যুক্তিতেও এ খাতের ‘হিডেন পেইন’ অনুসন্ধান করে দেখাটা সরকারের কর্তব্য। তৃতীয়ত, এ খাতে ব্যবসার ব্যয় কমিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন, ফিড তৈরির উপকরণ আমদানি সহজীকরণ; বিদ্যুৎ বিলে ছাড় দেওয়া। যাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা স্বভাবতই কম, তাদের আলাদা করেও সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। এ খাতে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ নাকি বাড়ছে। সেটাকে স্বাগত জানিয়েও এর নীতিগত দিকগুলো সুনির্দিষ্ট করা যেতে পারে। এতে খাতটির মানোন্নয়নের পথও সহজ হবে হয়তো।
বিশেষায়িত ডিমের বাজারও কিন্তু বড় হচ্ছে। এ খাতের রপ্তানি সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বহু খামার বন্ধ হলে গেলেও গত দশ বছরে ডিমের উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়ার ঘটনা কিন্তু বলে দেয়, এ খাতে আমাদের রপ্তানি সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য মানের দিকে দিতে হবে সবিশেষ দৃষ্টি।