ধ্রুবতারার মতো পথ দেখাচ্ছেন কিবরিয়া

মেধাবী ছাত্র, রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্র সচিব, অর্থনীতিবিদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী– এসব অভিধা ছাড়িয়ে তিনি একজন প্রাজ্ঞ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।

মোনায়েম সরকারমোনায়েম সরকার
Published : 26 Jan 2023, 06:01 PM
Updated : 26 Jan 2023, 06:01 PM

২৭ জানুয়ারি এলেই মনে অনেক স্মৃতি এসে ভিড় করে কিবরিয়া ভাইকে নিয়ে। আবেগে আক্রান্ত হই, চোখের কোণে জমে ওঠে অবাধ্য অশ্রু। বহুদিন একসঙ্গে কাজ করেছি, পথ চলেছি, ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। কিবরিয়া ভাই নেই, এটা ভাবতেই মন কেমন করে ওঠে। যে দলের হাত ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, সেই আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেও কিবরিয়া হত্যার বিচার শেষ হচ্ছে না– এটাও সত্য। তবু আশায় বুক বেঁধে আছি, এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হবে, শাস্তি পাবে হত্যাকারীরা। এটুকুও কম সান্ত্বনার কথা নয়।

কিবরিয়া ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হতো না– এমন দিনের কথা মনে পড়ে না। দেখাও হতো ঘন ঘন। সেই ১৯৯১ সাল থেকে তার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক, ক্রমে তা বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছিল। বইমেলা ২০০৪-এ প্রকাশিত তার বই ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ গিফট করার সময় তিনি লিখেছিলেন– ‘পরম সুহৃদ বন্ধুবর মোনায়েম সরকারকে’। শেষবারের মতো হবিগঞ্জ যাওয়ার আগের রাতেও ফোনে আমাদের কথা হয়। আমি কিছুটা অনুযোগ করে বলেছিলাম, অসুস্থ শরীরে এত দৌড়ঝাঁপ না করলে হতো না! তিনি বললেন, ‘এই তো যাবো আর আসবো।’ ‘মোনায়েম’ বলেই ডাকতে পারতেন আমাকে, ‘তুমি’ও বলতে পারতেন বয়সের কারণে। কিন্তু আমাকে তিনি বরাবরই বলতেন ‘মোনায়েম সাহেব’। সেদিনও বললেন, ‘নির্বাচনী এলাকায় মাঝে মাঝে যেতে হয়, মোনায়েম সাহেব। সবাই প্রত্যাশা করে আমাকে। স্থানীয় নেতাকর্মীদেরও চাঙ্গা রাখতে হয়। আর আওয়ামী লীগকে তো আন্দোলন-সংগ্রামেই থাকতে হবে। নির্বাচনই তার একমাত্র পথ।’ খুব যুক্তি দিয়ে এভাবেই কথা বলতেন কিবরিয়া ভাই। মনোযোগ দিয়ে অন্যের কথা শুনতেনও। কাজ করতেন গুছিয়ে। অন্যদিকে আমি কিছুটা অগোছালো, আবেগপ্রবণ। কিবরিয়া ভাই মাঝে মাঝে ঠাট্টা করতেন আমি সংসার করিনি বলে। ভুলত্রুটি মার্জনা করতেন। আমিও ভেতরে ভেতরে তার আশ্রয় ও স্নেহের কাঙাল হয়ে পড়েছিলাম। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সূত্রে দেশের শত শত বিশিষ্টজনের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে আমার। কিন্তু কই, কারও সঙ্গে এত অল্প সময়ে এত নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। নিজ গুণে কিবরিয়া ভাই তার পরিবারের একজন সদস্যও করে নিয়েছিলেন আমাকে।

২৭ জানুয়ারি ২০০৫ রাত ৮টায় যখন সেই দুঃসংবাদটি এলো– বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তার তো হবিগঞ্জ থেকে ফিরে শুক্রবার সকালে আমাকে নিয়ে অফিসে বসে সাপ্তাহিক ‘মৃদুভাষণ’-এর বিষয়বস্তু ফাইনাল করার কথা। ৩১ জানুয়ারি সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিএফডিআর) আয়োজিত সেমিনারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে তার মূল প্রবন্ধ পাঠ করার কথা। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি এ নিয়ে সিরিয়াস লেখালেখি করছিলেন তখন। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানও চেয়ে নিয়ে এ বিষয়ে তার একটি লেখা ছাপালেন শেষ যাত্রার আগের দিন। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, এ বিষয়ে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটা সেমিনারও করি। তিনি রাজি হয়েছিলেন। সেমিনার পেপার তৈরি করলেন। মস্তিষ্ক খুব সক্রিয় ছিল কিবরিয়া ভাইয়ের। ওই বয়সেও দ্রুত লিখতে পারতেন। তার ইংরেজি লেখাও ছিল চমৎকার। সারাজীবন ইংরেজিতে লিখতেন দেশে-বিদেশে। অভ্যাসমতো তিনি সেমিনার পেপার ইংরেজিতেই তৈরি করে দিয়ে গেলেন। ফোনে তার সঙ্গে সেমিনারের প্রস্তুতি নিয়েও কথা হলো। কিন্তু হায়, সিরডাপ মিলনায়তনে ৩১ জানুয়ারির সেমিনারটি আর করা হয়নি। প্রসঙ্গত বলি, ১৯৯৬ সালে বিএফডিআর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কিবরিয়া ভাইয়ের নেতৃত্বে। তার ইচ্ছায় আমি ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পদের দায়িত্ব নিই। এখনো এ কাজ অব্যাহত রেখেছি।

সফল আমলা-জীবন শেষে ১৯৯১-এ কিবরিয়া ভাইয়ের আওয়ামী লীগে যোগদানের পেছনে আমারও যৎসামান্য ভূমিকা ছিল। শেখ হাসিনা তাকে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করতে দ্বিধা করেননি। তিনি সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টার পদে আসীন হন, তার মেধা ও প্রজ্ঞার গুণে। দলের পক্ষ থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে আমিও নির্বাচন পরিচালনা কাজে যুক্ত ছিলাম। ওই সময় রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে অধিকাংশ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে তার নেতৃত্বেই আমরা গিয়েছি। প্রেস মিট করেছি। তাতে দেখেছি তার বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য, বলা ও বোঝানোর ক্ষমতা। ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এসে আওয়ামী লীগ তাকে অর্থমন্ত্রী বানিয়ে যে ভুল করেনি– জাতি এখন তা স্বীকার করে। আমি অর্থনীতি ভালো বুঝি না। কিন্তু কিবরিয়া ভাই যখন বলতেন, পার্লামেন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতেন কিংবা মৃদুভাষণে বসে এর দায়িত্বপ্রাপ্তদের ব্রিফ করতেন– আমার কাছে খুব সহজবোধ্য মনে হতো।

মৃদুভাষণ পত্রিকাটি বের করার সময় তিনি আমার ওপরই নির্ভর করলেন বেশি। বললেন, যাদের নেয়া হলো, আপনিই তাদের ভালো করে চেনেন। আমি হয়তো কাজের মধ্য দিয়ে চিনব। তিনি অবশ্য অল্পদিনেই তাদের চিনলেন, তাদের যোগ্যতায় আস্থা রাখলেন। মৃদুভাষণ অফিসে এলে প্রায়ই আমাকে যেতে বলতেন। বিদেশে গেলে বলতেন, আপনি সব দেখবেন। নিজের চেয়ার দেখিয়ে বলতেন, ‘আপনি এখানে বসবেন’। আমি দেখতাম না তেমন কিছুই। যারা কাজ করত, তারাই দেখত। তারাও দ্রুত বুঝে নিয়েছিল তাদের সম্পাদককে।

দারুণ প্রত্যয়ী হয়ে লিখতেন কিবরিয়া ভাই, বক্তৃতা করতেন। হবিগঞ্জে জীবনের শেষ যে বক্তৃতা করেছেন, তাতেও রয়েছে সেই প্রত্যয়ী মনোভাব। ‘বাংলাদেশের সামাজিক বিবর্তন কি পশ্চাতমুখী?’ শিরোনামে তার যে অসমাপ্ত লেখাটি পাওয়া গেছে, সেটি পড়লে বোঝা যায় দেশ নিয়ে তার উৎকণ্ঠা। অতঃপর শাহ এ এম এস কিবরিয়ার মৃত্যু ওই সময়ে গোটা জাতিকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিদেশেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তার মতো সজ্জন মানুষকেও যদি এভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে এদেশে কে নিরাপদ? দেশের ভবিষ্যৎই বা কী? এ প্রশ্ন জেগেছিল।

মেধাবী ছাত্র, রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্র সচিব, অর্থনীতিবিদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী– এসব অভিধা ছাড়িয়ে তিনি একজন প্রাজ্ঞ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে তাই উদ্বেলিত হয় জাতি ও বিশ্ব জনমত। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে আসে রাস্তায়। সরব প্রতিবাদও জানানো হয় একের পর এক কর্মসূচি পালন করে। দেশের বিশিষ্টজনেরা নেমে আসেন প্রতিবাদে। কিবরিয়ার মতো মানুষের হত্যাকাণ্ডে তারা বুঝতে পারেন, দেশ কোনদিকে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে কান্না। মানুষের শোকে-অশ্রুতে মহীয়ান হয়ে ওঠে কিবরিয়া ভাইয়ের আত্মদান। এতে তার প্রিয়জনেরাও শোক ভুলে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার অবকাশ পাই যেন।

কিবরিয়া পরিবারের সদস্য বিশেষ করে আসমা ভাবিও আজ প্রয়াত। তার দুই পুত্র-কন্যা শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশে-বিদেশে যে প্রতিবাদী ভূমিকা রাখে, তাও কিবরিয়া ভাইয়ের আপসহীন ভূমিকারই প্রতিফলন। শাহ এ এম এস কিবরিয়া স্মরণে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ সভা, সমাবেশ, মিছিল, হরতাল, মৌনমিছিল, রক্তের অক্ষরে শপথের সাক্ষর অভিযানে লক্ষ লক্ষ সাক্ষর সংগৃহীত হয়। সর্বোপরি গ্রেনেড হামলায় কিবরিয়া ভাই নিহত হওয়ার পর দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবীরা যেসব প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখেন, তার সংখ্যা আমার সংগ্রহেই রয়েছে দুই শতাধিক।

কিবরিয়া ভাই আদর্শ ও লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। কী দেশে, কী আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার মেধা, প্রজ্ঞার কথা কারও অবিদিত নয়। কর্তব্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ কিবরিয়ার বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সকল বোদ্ধা নারী-পুরুষের মনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। উত্তর আকাশের উত্তর মেরুবিন্দুর নিকটতম নক্ষত্র ধ্রুবতারার (নর্থ-স্টারের) মতো তার স্থির অবস্থান। সমাজ ও মানুষের জন্য এক অনন্য প্রেরণা। অথৈ সমুদ্রে দিকহারা নাবিক অথবা গভীর অরণ্যে পথহারা পথিক যেমন ধ্রুবতারার অবস্থান দেখে দিক নির্ণয় করে গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়, তেমনি কিবরিয়া ভাইয়ের লক্ষ্য ও আদর্শ আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

২০০৫-এর সূচনায় কিবরিয়া ভাইয়ের মৃত্যু, ক্ষণজন্মা কিবরিয়ার আত্মদান জাতিকে স্বাধীনতার মূলধারা অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে পুনঃস্থাপনে শক্তি জোগাবে, এ বিশ্বাস আমাদের নিরন্তর পথ দেখাচ্ছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসীন। এ সরকারের আমলে জাতির জনকের হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পৃথিবীব্যাপী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমাদের আশা, ২০০৪ সালের একুশে অগাস্টের নৃশংস গ্রেনেড হামলার বিচারের মতো কিবরিয়া হত্যার বিচারও সম্পন্ন করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নতুন নজির সৃষ্টি করবে।