বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ক্ষমতার অপরিহার্যতা

এটি নতুন কিছু নয়। রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা ব্রিটিশ যুগে ছিল, ছিল অবিভক্ত পাকিস্তানে, রয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ প্রায় সকল গণতান্ত্রিক দেশে।

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 24 Oct 2022, 08:59 AM
Updated : 24 Oct 2022, 08:59 AM

কোনো সরকারি চাকরিজীবীকে নির্ধারিত সময়ে চাকরি জীবন শেষ হওয়ার পর জনস্বার্থে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো প্রশাসনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ারই অংশ। এটি নতুন কিছু নয়। রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা ব্রিটিশ যুগে ছিল, ছিল অবিভক্ত পাকিস্তানে, রয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ প্রায় সকল গণতান্ত্রিক দেশে।

এ বিষয়ে আমাদের আপিল বিভাগ বলেছেন “এটি ঠিক যে আপিলকারীর (সরকার) এমন ক্ষমতা থাকা উচিত যাতে তারা কোন অবাঞ্ছিত, অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ, বেয়াদব এবং অবাধ্য চাকরিজীবীকে অপসারণ করতে পারে। তবে সে ক্ষমতা ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রয়োগ করতে হয়” (বিএডিসি বনাম শামসুল হক)। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট “দিল্লী ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন বনাম ডি.টি.সি মজদুর কংগ্রেস (১৯৯১)” মামলার রায়েও একই ধরনের কথা বলেছেন। বলা বাহুল্য এ ক্ষমতা প্রশাসনের জন্য অপরিহার্য। মিনিস্টিরিয়াল রেসপনসিবিলিটি তত্ত্ব অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের অন্যায় বা অবহেলার দায়ভার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের ওপরই বর্তায়, যার জন্য তাদেরকে সংসদে জবাবদিহি করতে হয়। ওই অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালে ১৪ নম্বর প্রেসিডেন্ট-এর নির্দেশে, প্রথম বাধ্যতামূলক অবসরের বিধানে বলা হয় ২৫ বছর চাকরি করেছেন এমন কোনো সরকারি চাকরিজীবীকে সরকার কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই অবসরে পাঠাতে পারবে। এই বিধানটিই পরে ১৯৭৪ সালের পাবলিক সার্ভেন্ট রিটায়ার্মেন্ট অ্যাক্টের ৯(২) ধারায় বলবত করা হয়। তবে ১৯৭২ সনেই যে এর প্রথম প্রচলন করা হয়েছিল তা নয়, এ ধরনের আইন এবং ক্ষমতা ব্রিটিশ রাজত্বের সময় এবং পাকিস্তান আমলেও ছিল।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনকালে এই আইনের প্রয়োগের ব্যাপকতা ছিল তুঙ্গে, অপপ্রয়োগও ছিল সীমাহীন। বিএনপি-জামায়াত সরকার অযৌক্তিকভাবে বহু কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠিয়েছিল, যার মধ্যে নিকৃষ্টটি ছিল জিয়াউর রহমান কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, দেশের একজন বিরল মেধার চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. নুরুল ইসলামকে তার পদ, যথা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন ইনস্টিটিউট-এর পরিচালকের পদ থেকে ১৯৭৮ সালে অবসরে পাঠানোর ঘটনা। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর আশির্বাদপুষ্ট ছিলেন বলেই ডা. নুরুল ইসলামের ভাগ্যে এমনটি ঘটেছিল। ডা. নুরুল ইসলাম শুধু জিয়া সরকারের সিদ্ধান্তই চ্যালেঞ্জ করেননি, তিনি ১৯৭৪ সালের আইনের ৯(২) ধারা, অর্থাৎ সরকারি চাকরিজীবীদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ক্ষমতা প্রদান করা আইনের বৈধতাও চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে আপিল বিভাগ বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আইনটি এই বলে অবৈধ করে দেন যে এতে কোনো গাইডলাইন ছিল না, অর্থাৎ সরকার কোন পরিস্থিতিতে ২৫ বছর চাকরিসম্পন্ন করা ব্যক্তিকে অবসরে পাঠাতে পারবেন, তার কোনো গাইড লাইন ছিল না, শুধু বলা ছিল ২৫ বছর চাকরি শেষ করে থাকলে যে কাউকে অবসরে পাঠানো যাবে। এভাবে আইনটি বাতিল হওয়ার পর সরকার পুরানো বাতিল হওয়া আইনের সাথে ‘জনস্বার্থে’ কথাটি সংযোজন করে পার্লামেন্টে নতুন আইনের প্রস্তাব করলে তা গৃহীত হয়। নতুন আইনটিতে ‘জনস্বার্থে’ কথাটি থাকায়, আগে যা ছিল না, এটি বৈধতাপ্রাপ্ত হয়, কেননা ‘জনস্বার্থে’ কথাটি যথোপযুক্ত গাইডলাইন হিসাবে স্বীকৃতি পায়। ২০১৮ সালে যে নতুন আইন প্রবর্তন করা হয়, তার ৪৫ ধারায় ‘জনস্বার্থে’ এই ক্ষমতার উল্লেখ রয়েছে।

বিএনপি-জামায়াত সরকার আরও যেসব ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছিল, এ ধরনের কয়েকটি ক্ষেত্রে আমাকে ভূমিকা রাখতে হয়েছিল হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে। হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে স্মরণযোগ্য যে মামলাটি আমি নিষ্পত্তি করেছিলাম, সেটি ছিল খালেদা জিয়া কর্তৃক অন্যায়ভাবে পুলিশের একজন অতিরিক্ত আইজিকে অবসরে পাঠিয়ে আইনের অপপ্রয়োগের ঘটনা। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো পুলিশের ওই অতিরিক্ত আইজি আমার নেতৃত্বের বেঞ্চে রিট মামলা করলে, আমি তার পক্ষে এ কারণে রায় দিয়েছিলাম যে সরকার উক্ত ঘটনার সমর্থনে ‘জনস্বার্থের’ কোনো উপাদানই দেখাতে পারেনি বরং তাকে অবসরে পাঠানোর পেছনে মুখ্য কারণ ছিল দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করা। আমার নির্দেশে চাকরিতে পুনর্বহাল করার পর সরকার তাকে বিআইডব্লিউটি-এর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়েছিল অতিরিক্ত সচিবের মর্যাদায়।

অন্য ঘটনাটিতে আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল পেশাজীবী ব্যারিস্টার হিসেবে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য জাতিসংঘ অধিবেশনের জন্য নিউ ইয়র্ক গমন করে সেখানে জাতিসংঘ মিশনে আমাদের উপ-প্রতিনিধি, বীর মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ সাহেবের দফতরে যান এবং সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন। বিষয়টি তারা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বললে, তিনি কালবিলম্ব না করে মহিউদ্দিন সাহেবকে অবসরে পাঠান। মহিউদ্দিন সাহেব ওই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করলে তার মুখ্য আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা সৈনিক গাজিউল হক সাহেবের জুনিয়র হিসাবে আমিও ওই মামলায় মহিউদ্দিন সাহেবকে সহায়তা প্রদানের সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল মহিউদ্দিন সাহেবের পক্ষে রায় প্রদান করে তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলে সরকার একজন পূর্ণ সচিবের পদমর্যাদায় তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুনর্বহাল করে। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় যে অত্যন্ত যৌক্তিক ছিল তা বলাই বাহুল্য, কেননা জাতির পিতার ছবি রাখা কখনো ‘জনস্বার্থ’ পরিপন্থী কাজ হতে পারে না। খালেদা জিয়ার উক্ত সিদ্ধান্ত প্রমাণ করেছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার উগ্র বিদ্বেষ। কাছাকাছি সময়ে ইতালিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব ওয়ালিউর রহমান সাহেবকেও খালেদা জিয়ার সরকার বঙ্গবন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে অপসারণ করেছিল।

সম্প্রতি বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো তথ্য সচিব মকবুল হোসেন সাহেবকে কী কারণে অবসরে পাঠানো হলো, এ প্রশ্নে এখন টেলিভিশনের পর্দা উত্তপ্ত। বহু টকশোতে বহু অভিজ্ঞ প্রাক্তন সচিবের মতামত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের অনেকের মন্তব্যই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে জনমনে। একটি টকশোতে এমনকি উপস্থাপিকা নিজেই বলে ফেলেছেন আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের চেয়ে নাকি এই ক্ষমতার প্রয়োগ অনেক বেশি হচ্ছে। তিনি এমনকি এই মর্মে আরও একটি উদ্ভট কথা বলেন যে, অবসরে পাঠানো তিন পুলিশ অফিসারের একজন নাকি ২৫ বছর চাকরি শেষ করেননি, যা কিনা সত্যি অবান্তর। ২৫ বছর চাকরি শেষ না করা কোনো চাকরিজীবীকে সংশ্লিষ্ট আইনে অবসরে পাঠানোর কোনো অবকাশই নেই। ওই উপস্থাপিকার উক্তি শুধু অমার্জনীয় অজ্ঞতার পরিচয়ই বহন করে না, এর ফলে দর্শকগণ ভ্রান্ত বার্তা পেয়েছেন।

অবসরে পাঠানো সচিব মকবুল সাহেবের এক উক্তি থেকেই প্রশ্ন উঠেছে তিনি লন্ডনে তারেক জিয়ার সাথে দেখা করেছেন কিনা– যে প্রশ্নে তার জবাব ছিল নেতিবাচক। এ বিষয়ে এক টকশোতে একজন অতি পরিচিত, বিশাল অভিজ্ঞতার ধারক এক প্রাক্তন সচিব বলে ফেললেন তারেক জিয়ার সাথে দেখা করলেইবা কি আসে যায়? সরকারি চাকরিজীবীরা রাজনীতিকদের সাথে দেখা করতে পারবেন না, এমন তো কোনো বিধান নেই। প্রাক্তন সচিব সাহেব এটি বলার মুহূর্তে নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিলেন যে তারেক জিয়া আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত, বিদেশে পালিয়ে থাকা একজন ফেরারি আসামি, যার সাথে যে কোনো সরকারি চাকরিজীবীর দেখা করা মারাত্মক অন্যায়ই শুধু নয়, অপরাধও বটে। এমনকি কোনো সাধারণ মানুষও একজন ফেরারি আসামির সাথে গোপনে দেখা করলে পালিয়ে থাকা আসামিকে সহায়তা প্রদানের অপরাধে তার সাজা হতে পারে আমাদের দণ্ডবিধি আইনে। তারেক জিয়া দণ্ডিত ফেরারি আসামি না হলেও তার সাথে সাক্ষাৎ করলে বহু প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারত, কেননা দুনিয়া এটা জানে যে লন্ডনে বসে তারেক জিয়া কুখ্যাত জঙ্গি দাউদ ইব্রাহিম এবং পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই কর্মকর্তাদের সাথে প্রতিনিয়ত বৈঠক করছেন– বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অপসারণের জন্য। এছাড়াও বেকার এই যুবক কীভাবে বিলেতে বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন, তার অর্থের জোগান কোথা থেকে আসছে, তিনি অর্থ পাচার করছেন কিনা– এ ধরনের বহু প্রশ্নই বিরাজমান।

যারা বলছেন সরকারি চাকরিজীবীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, তারা বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন যে চাকরিজীবীদের দায়িত্ব সরকারি নির্দেশে সরকারের নীতিসমূহ বাস্তবায়িত করা। নীতিনির্ধারণ সরকারের দায়িত্ব, যার জন্য তারা সংসদ এবং দেশবাসীর কাছে দায়ী। এটি সরকারি চাকরিজীবীদের কাজ নয়, শুধু পরামর্শ দেওয়া ছাড়া। তাদের সীমিত কিছু স্টেচুটারি ক্ষমতা রয়েছে, যা তারা ন্যায্যভাবে পালন করছেন কিনা, তা তদারকি করার দায়িত্বও সরকারেরই। তাই অবাধ্য চাকরিজীবীদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ক্ষমতা অবশম্ভাবী, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া যথোপযুক্তভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য, যে কথা আমাদের মহামান্য আপিল বিভাগ এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পরিস্কার করে বলেছেন। এটা ঠিক যে চাকরিজীবীরা অবাঞ্ছিত কাজ করলে আইন অনুযায়ী তাদের বহিষ্কার করা যায়। কিন্তু একথা শুনতে যতটা সহজ, বাস্তব অবস্থা তেমনটি নয়। এর জন্য আইনি দীর্ঘসূত্রিতা ছাড়াও রয়েছে কঠিন আইনি জটিলতা, যার জন্য তাৎক্ষণিক পরিস্থিতিতে এর সমাধান নেই। মকবুল সাহেব বলেছেন একজন ফাঁসির আসামিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। একই ভাষায় সেই টকশোর অভিজ্ঞ প্রাক্তন সচিব সাহেবও বলে ফেললেন ন্যাচারাল জাস্টিসের কথা, যা বলার আগে এসব প্রচুর অভিজ্ঞতাধারী ব্যক্তিগণ ভুলে গেলেন যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয় বিধায় এসব ক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থন বা কারণ দর্শানোর নোটিশ বা ন্যাচারাল জাস্টিসের কোনো অবস্থানই নেই– যে কথা আমাদের উচ্চ আদালতসমূহ বহু রায়ে বহুবার বলেছেন। সাবেক সচিব সাহেব আরও বলেছেন এ ধরনের ক্ষমতা থাকা উচিত নয়, যে কথাটি একজন অভিজ্ঞ এবং উঁচুদরের সাবেক কর্মকর্তার মুখে শুনে অনেকেই অবাক হয়েছেন। এহেন অবস্থায় অবাধ্য চাকরিজীবীদের অবাধ্যতার কারণে সরকার যে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে, ওই কথাটি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। এ ধরনের ক্ষমতা না থাকলে মন্ত্রীরাইবা কীভাবে মিনিস্ট্রিয়াল রেসপনসিবিলিটি পালন করবেন, যে তত্ত্ব অনুযায়ী একজন মন্ত্রীর অধীনে কর্মরত চাকরিজীবীদের কৃত অঘটনের দায় মন্ত্রীকেই নিতে হয়। যুক্তরাজ্য, যে দেশকে আইনের শাসনের সুতিকাগার বলা হয়, সেখানে সরকারি চাকরিজীবীদের অবস্থা আরও অনেক বেশি বেগতিক, কেননা কিছু বিধিবদ্ধ পরিস্থিতি সাপেক্ষে সব সরকারি চাকুরজীবীর চাকরিতে স্থায়িত্ব নির্ভর করে রানীর (যা বাস্তবে সরকারের) একান্ত মর্জি বা প্রেরোগেটিভ ক্ষমতার ওপর যাকে আইনের ভাষায় ‘ডকট্রিন অব সেটিসফেকশন’ নামে পরিচিত। অবশ্য যুক্তরাজ্যে সরকারি পদ আমাদের দেশের মতো আকর্ষণীয় নয় এবং সেখানে চাকরিজীবীরাও সাধারণত অবাধ্যতা পরিহার করে দায়িত্বে থাকেন অটল। ভারতসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও অবস্থা অভিন্ন। সরকারকে দেশ চালাতে, তাদের নীতি বাস্তবায়িত করতে হয় সরকারি চাকুরজীবীদের দ্বারা, আর তারা অবাধ্য হলে, সরকারের কথা না শুনলে, সরকারের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলে, তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ক্ষমতা ছাড়া সরকারের পক্ষে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব বিধায় এই ক্ষমতা অপরিহার্য।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এমন অনেক কর্মকর্তাকেই অবসরে পাঠায়নি যাদের অবসরে পাঠানো উচিত ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের এক সময়ের প্রধান ড. মোমিনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কারণ নির্বাচনের আগে উত্তরা ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কারণে তিনি হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন। তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছিল বটে কিন্তু বহু বছর পরে, যে সময়ে সরকারি কোষাগার থেকে মোটা অংকের বেতন ভাতা দেওয়া হয়েছে।

যে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে, দেখা গিয়েছে তারা সকলেই বিএনপি-জামায়াত আমলে গুরুত্বপূর্ণ জেলায় এসপি পদে বহাল ছিলেন। সেটি অবশ্য দোষের কিছু নয়, কিন্তু এটা কারও অজানা নেই ওই সময়ে জেলার এসপিদের সিংহভাগই এসপি কোহিনুরের মতো স্বেচ্ছাচারিতায় গা ভাসিয়েছিলেন। ওই তিনজন বিএনপি-জামায়াত আমলে যে সব জেলার এসপি ছিলেন, ওই সময়ে সেসব জেলার ট্র্যাক-রেকর্ড ছিল নিদারুণ বিশেষ করে পাবনার, ওখানকার মন্ত্রী ছিল কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী নিজামী। এছাড়াও বিএনপি-জামায়াত আমলে তাদের বিশেষভাবে বাছাই করা বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা যে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার সাথে জড়িত ছিল এবং ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচারের ঘটনার সাথে জড়িত ছিল– সেসব কথা তো আদালতের রায়েই উল্লেখিত হয়েছে।

প্রাক্তন সচিব সাহেব বললেন রিট মামলায় নাকি এসব সিদ্ধান্ত টেকে না। এটি ঠিক নয়। রিট করলে কেউ তবেই জয়ী হন, যদি সরকার ‘জনস্বার্থ’ দেখাতে ব্যর্থ হন বা দেখা যায় সিদ্ধান্তটি ছিল দুরভিসন্ধিমূলক। যেমনটি বিএনপি-জামায়াত সরকার বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখায় মহিউদ্দিন সাহেবের বেলায় করেছিল, রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান সাহেবের বেলায় এবং পুলিশের অতিরিক্ত আইজিসহ বহু চাকরিজীবীর বেলায় করেছিল– তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে ওই জায়গায় নিজেদের পছন্দের লোক বসানোর জন্য। যদি দেখানো যায় রিটকারী তারেক জিয়ার মতো পলাতক আসামির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে বা প্রাক্তন এসপি হিসাবে সংশ্লিষ্ট জেলায় তাণ্ডব চালিয়েছে, এখনও রয়েছে অবাধ্য এবং ষড়যন্ত্রকারী– তাহলে রিটে হেরে যাওয়াই হবে স্বাভাবিক এবং আইনসিদ্ধ। তাই সরকার সত্যিকার অর্থে ‘জনস্বার্থে’ কাউকে অবসরে পাঠালে কারও চিন্তার কারণ থাকবে না।