ক্ষমতাসীনরা যদি বিএনপির দাবি না মানে, তাহলে কি এমন কর্মসূচি অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে? মানুষের কি এমন দায় পড়েছে, বিএনপির এই কর্মসূচি পালন করার? এভাবে না রাজনীতি চলে, না রাজনৈতিক দল চালানো যায়।
Published : 04 Dec 2023, 06:01 PM
দেশে একদিকে চলছে নির্বাচনের সমারোহ, আরেকদিকে হরতাল, অবরোধ। বিএনপি থেমে থেমে এই হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত মঙ্গলবার ফাঁকা রেখে বিএনপি দফায় দফায় হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে চলেছে। হরতাল-অবরোধের ‘ডে-অফ’ নিয়ে যথেষ্ট রসিকতার মধ্যেই ৫ নভেম্বর মঙ্গলবার অবরোধের বিরতি দিয়ে দশম দফায় আবার দুদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার ঘটনায় পরের দিন ২৯ অক্টোবর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল দেয় বিএনপি। এরপর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর থেকে সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন এবং দলের গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের মুক্তি ও হয়রানি বন্ধের দাবিতে এক-দুই দিন পরপর কখনো অবরোধ, কখনো হরতালের মতো কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে দলটি।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন। কর্মসূচি ঘোষণার সময় তিনি আন্দোলন চলতেই থাকবে বলে জানিয়েছেন।
রুহুল কবির রিজভীর এই ঘোষণা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তার মানে ক্ষমতাসীনরা মানুক না মানুক, সাধারণ মানুষের যত দুর্ভোগই হোক, আন্দোলন কোনো যৌক্তিক পরিণতি পাক বা না পাক, আন্দোলনের ফলে জানমালের যতই ক্ষতি হোক, তা চলতেই থাকবে! এ ধরনের কথা অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন। কোনো দায়িত্বশীল নেতা এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। সব কিছুর একটা কৌশল থাকা দরকার। একটা মেয়াদ, একটা সুনির্দিষ্ট টার্গেট থাকা দরকার। কোনো আন্দোলন অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না। হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বাসাত্মক ও ক্ষতিকর কর্মসূচি তো নয়ই।
বিশেষত লাখ লাখ শিক্ষার্থী যখন বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে, তখন হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাওয়া, চোরা-গুপ্তা কায়দায় যানবাহনে আগুন দেওয়ার মতো গণবিরোধী কর্মসূচি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। দেশের এই লাখ লাখ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক কতটা বিড়ম্বনা ও ভয় নিয়ে বার্ষিক পরীক্ষার দিনগুলো পার করছে, তা বলে বোঝানো যাবে না।
লাগাতার হরতাল-অবরোধের কারণে অনেক মানুষের প্রয়োজনীয় অনেক কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। মানুষ স্বাধীনভাবে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারছে না। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আটকে থাকছে। মানুষের অপরিমেয় ক্ষতি হচ্ছে। ‘আন্দোলনের কর্মসূচি চলতেই থাকবে‘ এটা কোনো যুক্তিতেই একটি দায়িত্বশীল বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য হতে পারে না।
ক্ষমতাসীনরা যদি বিএনপির দাবি না মানে, তাহলে কি এমন কর্মসূচি অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে? মানুষের কি এমন দায় পড়েছে, বিএনপির এই কর্মসূচি পালন করার? এভাবে না রাজনীতি চলে, না রাজনৈতিক দল চালানো যায়। কিন্তু বিএনপি এই কাজটিই ‘আপসহীন’ভাবে করে যাচ্ছে। বিএনপির এই হরতাল আর অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো রকম সাড়া নাই। তাহলে কেন এই আন্দোলন?
এর আগে ২০১৫ সালে সরকার পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ওই বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ ও হরতালের ডাক দেয় বিএনপি জোট। সেই হরতাল-অবরোধকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ঠিকই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। সেই সময় জামায়াত-বিএনপির লাগাতার অবরোধের ২৮০ তম দিন পার হলেও তারা সেই কর্মসূচি প্রত্যাহার করেনি। ওই কর্মসূচি এমনিতেই এক সময় অকার্যকর হয়ে যায়। এবারও তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দলটি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই কী সব সমস্যার সমাধান? এটা কি সত্যিই কোনো ভালো, টেকসই ব্যবস্থা? পৃথিবীর কোন দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত আছে? রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের আস্থাভাজন হবে না, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে না, সেই কাজটা করে দিয়ে যাবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অংশ কয়েকজন ‘দেবদূত’ সেটা কি বাস্তবসম্মত? এই ‘দেবদূত’ বাছাই নিয়েও কি কম ঝগড়া-কাজিয়া-বিতর্ক হয়েছে?
যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি এখন মাথা কুটে মরছে, সেই ব্যবস্থাটাকে প্রথম বিতর্কিত কে করেছিল? ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ তৎকালীন বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়।
এরপর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। দেশে-বিদেশে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। নির্বাচনে পরাজিত দল বিএনপি নির্বাচনে ‘পুকুর চুরির’ অভিযোগ আনলেও, তাদের সেই দাবি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাছে। সে নির্বাচনে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী জোট ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে পক্ষপাতিত্ব এবং কারচুপির অভিযোগ আনে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেটি হালে পানি পায়নি। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০১-০৬ সালের বিএনপি সরকারের একটি সিদ্ধান্ত গোটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কের মুখে ফেলে দেয়।
বিএনপি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেবার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়েছিল। এর পেছনে ছিল বিএনপির পরের সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ইচ্ছে। কারণ, তখন বিধান ছিল, সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে যে, বিএনপি তাদের পছন্দসই ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা করার জন্য নানা আয়োজন করেছে। দু’হাজার তিন সালের জুন মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কে এম হাসান। তখন অভিযোগ উঠেছিল যে, বিএনপি সরকারের পছন্দের কারণেই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কে এম হাসানকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিল ।
বিএনপির এই কারসাজির প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ তার মিত্রদের নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। বিক্ষোভ-সহিংসতার মধ্যে বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে অপারগতা প্রকাশ করলে বিএনপি সরকারের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নেন। এরপর আওয়ামী লীগসহ বিরোধীদের আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।
অস্থির ওই সময়ে সেনা হস্তক্ষেপে ভেঙে দেওয়া হয় ইয়াজউদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠন করা হয় নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা।
৯০ দিনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও জরুরি অবস্থার মধ্যে ওই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ বহু রাজনীতিককে সে সময় দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে কারাগারে যেতে হয়।
নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হয়, তাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। তারা এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাটাই বাতিল করে।
আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে যে ‘বিকলাঙ্গ ব্যবস্থা’ এক সময় এদেশে জন্ম নিয়েছিল, তা অকালপ্রয়াণের গ্যারান্টি নিয়েই জন্মেছিল। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনির্বাচিত ব্যক্তিদের কয়েকদিনের রাজা হওয়ার সুযোগ দুনিয়ার কোথাও নাই। এটা একটা অস্বাভাবিক ব্যবস্থা। আর যা কিছু অস্বাভাবিক, মূলধারাবিচ্যুত তা ক্ষণিকের মহিমা নিয়েই হাজির হয়। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তাই আমাদের দেশে কার্যকর হতে পারেনি। বিশেষ করে ২০০৬-০৮-এর অভিজ্ঞতা এই ব্যবস্থার মৃত্যু নিশ্চিত করে। আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবস্থাটাকে সমাধিস্থ করে মাত্র।
আমাদের দেশের কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য রীতিমত মরাকান্না কাঁদছেন। ওটা নাকি 'সেটেল্ড' ইস্যু ছিল। 'সেটেল্ড' ইস্যু হলে ইয়াজউদ্দিন কেন প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন? ফখরুদ্দীন-মঈন ইউ আহমেদকে কেন মঞ্চে আবির্ভূত হতে হয়েছিল? কেন তিনমাসের সরকারকে দুইবছর ক্ষমতায় থাকতে হয়েছিল? নাকি ওটাও 'সেটেল্ড' ছিল?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আমাদের দেশের ‘ক্ষমতালিপ্সু’ বুদ্ধিজীবীদের শোকের অবশ্য কারণও আছে। এই ব্যবস্থা বলবৎ থাকলে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় প্রতি পাঁচবছর অন্তর অন্তর একটু ক্ষমতা চর্চা ও ভোগের সুযোগ পেতেন। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের সমীহ করে চলতেন। এই ব্যবস্থা চলে যাওয়ায় তরা 'হরিদাস পালে' পরিণত হয়েছেন!
অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আদর্শিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার একমাত্র শর্ত নয়। ঘৃণা এবং হিংসার পরিবেশ বিদ্যমান থাকলে সেই নির্বাচন অবাধ অথবা সুষ্ঠু হবার অবকাশ থাকে না। 'আউটসোর্সিং'-এর মাধ্যমে একটা নির্বাচন করাই কি 'গণতন্ত্র'? আওয়ামী লীগের পরিবর্তে জামায়াত-বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখাটাই কী 'গণতন্ত্র'? আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনি ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা, রাজনীতিতে হিংসা-বিদ্বেষ-সহিংসতা দূর করা—রাজনীতির ময়দানে এই আলোচনাগুলো কোথায়?
বিএনপির আন্দোলনের মেয়াদই বা কতো? এসব প্রশ্নের ফয়সালা কবে হবে? কে করবে?