দেশের সংবাদমাধ্যমে বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় ২০০৬ সালে ‘দ্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অ্যাক্ট ১৯৭৪’ বাতিল করার ফলে।
Published : 08 Oct 2024, 04:58 PM
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। যেকোনো সময় হতে পারে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনও। যদিও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠনের লক্ষ্যে এ বিষয়ে বেশ কিছু সেমিনার, আলোচনা ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানগুলোতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়গুলো তুলে ধরার পাশাপাশি সেগুলো দূর করার উপায় সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়। সংবাদমাধ্যমের সুবাদে ওইসব আলোচনার যতটুকু নজরে এসেছে তাতে বড় কিছু ঘাটতি বা ফাঁক থাকায় এই আলোচনার সূত্রপাত।
এটি অনস্বীকার্য যে দেশে সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে অন্তরায় হিসেবে আছে সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ বেশ কিছু আইন। ওই আইনগুলো সংশোধন বা বাতিলের পরামর্শও দিচ্ছেন বিভিন্নজন। ওই পরামর্শ নিয়ে দ্বিমত করার কিছু নেই। অন্তর্বর্তী সরকারও এ বিষয়ে একমত বলেই মনে হচ্ছে। এ ছাড়া সংবাদপত্রকে সরকারের করায়ত্তে রাখার একটি বড় হাতিয়ার হলো চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) মিডিয়া তালিকাভুক্তি এবং মনগড়া প্রচারসংখ্যা দেখিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনের মূল্যহার নির্ধারণ ও বিজ্ঞাপন বণ্টন। এ ক্ষেত্রেও সংস্কারের সুপারিশ উঠে এসেছে কোনো কোনো আলোচনায়। এ নিয়েও কেউ কোনো ভিন্নমত পোষণ করবেন বলে মনে হয় না। এসব নিয়ে আলোচনা যত হচ্ছে, ওই তুলনায় সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের চাকরির নিরাপত্তা-শৃঙ্খলা নিয়ে কথা হচ্ছে কম।
এখন প্রশ্ন হলো, শুধু আইন-কানুন আর সরকারি নিয়ন্ত্রণই কি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সংবাদমাধ্যমের মালিকানার বিষয়টি সামনে আসে। মালিকানা অনুযায়ী দেশে সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হলো দুই ধরনের— রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও করপোরেট বা ব্যক্তিমালিকানাধীন। এই দুই ধরনের সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের পথও দুই ধরনের। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান— বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ক্ষেত্রে বিবেচ্য হলো কীভাবে এগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা যায়। এ নিয়ে আগেও বিভিন্ন সময়ে আলোচনা কম হয়নি। ২০১৬ সালে ‘বিশ্ব টেলিভিশন দিবস ২০১৬’ উপলক্ষে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় ২০১৭ সালের শুরুতেই সম্প্রচার আইন ও সম্প্রচার কমিশন করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন তখনকার তথ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছিলেন, আইন ও কমিশন গঠন করার মধ্য দিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের একটি ধাপ সম্পন্ন করা হবে। কিন্তু ওই আইন বা কমিশন কিছুই হয়নি।
করপোরেট বা ব্যক্তিমালিকানাধীন টিভি-রেডিও, সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা ও অনলাইন পোর্টালকে মালিকের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করতে পারাটা খুব সহজও নয়। কারণ শুধু আইনি বাধা আর সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নিলেই ব্যক্তিমালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না। কারোরই অজানা নয় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ সংবাদমাধ্যমে বিনিয়োগ করে থাকে তাদের অন্য খাতের ব্যবসায় সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা লাভের প্রত্যাশায়। তাদের ওই প্রত্যাশা পূরণ করতেই নিজেদের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমকে সরকার-তোষণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। কাজেই আইনি বাধা আর সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নিলেই তো আর মালিকপক্ষের নিয়ন্ত্রণ থেকে ওইসব সংবাদমামাধ্যম মুক্ত হবে না। এখন শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে উদ্যোক্তারা তাদের প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দিতে রাজি হবেই বা কেন? এ ক্ষেত্রে একাধিক উপায়ের একটি হলো সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানকে মালিকের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা। বর্তমানে সংবাদমাধ্যমে বিশেষ করে ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শৃঙ্খলাই নেই। মালিক যখন যাকে খুশি যেকোনো পদে নিয়োগ দিতে পারেন আবার বাদও দিতে পারেন। সাংবাদিকতায় কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই মালিকের ইচ্ছেয় যে কেউ সম্পাদক হয়ে যেতে পারেন। ওই সুযোগে অনেক মালিক নিজেই সম্পাদক বনে যান। সংবাদমাধ্যমের জন্য সার্ভিস রুল বা চাকরিবিধি কিংবা স্বতন্ত্র আইন না থাকায় এমন বিশৃঙ্খলা চলছে।
দেশে সংবাদমাধ্যমে বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় ২০০৬ সালে ‘দ্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অ্যাক্ট ১৯৭৪’ বাতিল করার ফলে। ১৯৬০ সালের ‘দ্য ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অডির্ন্যান্স’-এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে আইনটি করা হয়েছিল সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থায় কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মীদের চাকরির নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য। তখন দেশে বেসরকারি খাতে কোনো ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম না থাকায় তার কর্মীদের চাকরির বিষয়গুলো ওই আইনের আওতায় আসেনি। ২০০৬ সালে তৎকালীন সরকার ক্ষমতা ছাড়ার আগমুহূর্তে কোনো আলোচনা ছাড়াই আইনটি বাতিল করে কিছু অংশ আধাখেচড়াভাবে জুড়ে দেয় শ্রম আইনের সঙ্গে। শ্রম আইনে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের গণ্য করা হয়েছে সংবাদপত্র শ্রমিক (শ্রম আইন ২০০৬-এর ৭২ ধারা) হিসেবে।
সাংবাদিক সমাজের দাবির মুখে নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অ্যাক্টের সঙ্গে ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক ও কর্মীদের চাকরির শর্তগুলো যুক্ত করে ২০১৭ সালে ‘গণমাধ্যম কর্মী (চাকুরির শর্তাবলি) আইন ২০১৭’ নামে একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করে তা মতামতের জন্য প্রকাশ করা হয়েছিল তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে আইনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদনও দিয়েছিল মন্ত্রিসভা। ২০২২ সালের ২৮ মার্চ রাতে ‘গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল, ২০২২’ শিরোনামে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয় এবং এর পরপরই বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ৬০ দিন সময় দিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। ওই বিলের কপি পাওয়ার পর দেখা যায়, ২০১৭ সালে যে খসড়াটি প্রকাশ করা হয়েছিল তার সঙ্গে সংসদে উত্থাপন করা বিলের আকাশ-পাতাল ফারাক। জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপিত আইনে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম কর্মীদের চাকরির সুরক্ষা, সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি ও অধিকার তো নিশ্চিত করাই হয়নি, উল্টো ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করা হয়। বাতিল করা হয় বিদ্যমান গ্র্যাচুয়িটি সুবিধা। এর পরিবর্তে ‘নাকের বদলে নরুন’ দেওয়ার মতো নামমাত্র ক্ষতিপূরণের (৫ বছর পর্যন্ত অব্যাহত চাকরির জন্য বছরপ্রতি ১৫ দিনের মূল বেতনের সম পরিমাণ অর্থ) ব্যবস্থা রাখা হয়। কমানো হয় অর্জিত ছুটি, বিনোদন ছুটিসহ বিদ্যমান অনেক সুবিধা। বাদ দেওয়া হয় নৈশ পালা ভাতা ও দায়িত্ব ভাতার মতো সুবিধা। বাড়ানো হয় কর্মঘণ্টা। ‘সাংবাদিক’ পরিচয়টিই কৌশলে আড়াল করা হয়। সাংবাদিক ও সম্পাদক-এর কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যাই রাখা হয়নি। গড়পড়তা সবাইকে ‘গণমাধ্যম কর্মী’ নামে পরিচয় দেওয়া হয়। সঙ্গত কারণেই সরকারপন্থী সাংবাদিকেরাও এর তীব্র বিরোধিতা করেন। পরে আর সেটি পাশ হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। ওই সময় তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানান, ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনায় রয়েছে— বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারকে দক্ষ ও জনবান্ধব করার উদ্যোগ নেওয়া, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ছাত্র-জনতা এবং তাদের পরিবার নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার। এ ছাড়া গণমাধ্যম ইস্যুতে অন্য যেসব কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়, তার অন্যতম হলো— স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠনের উদ্যোগ এবং গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া।
এখানে বলা দরকার, বিগত সরকার গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল জাতীয় সংসদে তোলার পর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আইনের শিরোনাম নিয়েও অপত্তি জানানো হয়েছিল। ‘গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন’-এর বদলে ‘সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন’ অথবা ‘সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন’ নাম প্রস্তাব করা হয়। আলোচিত এই আইনটিকে ত্রুটিমুক্ত করে সাংবাদিক ও সম্পাদকের সংজ্ঞা ও যোগ্যতা নির্ধারণের মাধ্যমে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর সুযোগ আছে। তা না হলে সম্পাদকের যোগ্যতা নির্ধারণের জন্য আলাদা আইন করতে হবে। ইদানিং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের জন্য অভিন্ন ওয়েজ বোর্ড গঠন করার দাবি তোলা হচ্ছে বেশ জোরালোভাবে। কিন্তু নতুন আইন প্রণয়ন কিংবা শ্রম আইন সংশোধন ছাড়া যে সেটি করা সম্ভব নয়, তা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্চ্য নেই। আমার মতে, শ্রম আইন সংশোধন করার চেয়ে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম কর্মীদের জন্য ১৯৭৪ সালের দ্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অ্যাক্টের আদলে নতুন আইন করাই শ্রেয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে, ১৯৭৪ সালের আইনে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের যেসব সুবিধার উল্লেখ আছে সেগুলোর কোনোটি যেন খর্ব বা বাতিল না করা হয়।
আরও পড়ুন:
'গণমাধ্যমের মালিকানায় দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে'
গণমাধ্যমের ব্যবসা কোন পথে যাবে?
মুক্ত মতের প্রকাশ ও বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস: নতুন মডেল অনুসন্ধান জরুরি