গণমাধ্যমের ব্যবসা কোন পথে যাবে?

দর্শক-পাঠকের আচরণ এবং নতুন প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে সংবামাধ্যমের খাপ খাইয়ে নেওয়ার কার্যকরী কৌশল কোনটা হবে— সেটি বোঝার জন্য ২০২৪ সাল হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জিয়াদ মুবাশ্বির ইসলামজিয়াদ মুবাশ্বির ইসলাম
Published : 19 Feb 2024, 09:57 AM
Updated : 19 Feb 2024, 09:57 AM

চৌদ্দ শতকে দিল্লির শাসনকর্তা কাগজের মুদ্রা চালুর চেষ্টা করেন। সেই সময় ব্যবসায়ী ও মহাজনরা লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে সোনার তৈরি মোহর বা দিনার ব্যবহার করতেন। তারা বেঁকে বসলেন। বাদশাহী ফরমান ব্যর্থ করে দিতে সংকল্প করলেন। জনগণও কাগজের মুদ্রায় ভরসা না করে ব্যবসায়ী ও শেঠদের পথে হাঁটল। এ দু পক্ষই বাদশাহের দরবার থেকে যে কাগজের মুদ্রা সরবরাহ করা হয়েছিল— তা বিক্রি করে আবার সোনা কিনল। ফলে রাজ্যজুড়ে বিনিময় মূল্য নিয়ে চরম অরাজকতা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে।

১৩২৫ সালে বাবার মৃত্যুর পর যে মুহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লির শাসনকর্তা হন, তার সময়ের কথাই বলছি। শাসকের নাম শুনে অপরিচিত লাগলেও তার শাসনামল নিয়ে প্রচলিত প্রবাদটি আমাদের সবারই পরিচিত—  ‘তুঘলকি কাণ্ড’। ২৬ বছরের শাসনামলে মুহম্মদ বিন তুঘলকের বড় বড় পরিকল্পনা ব্যর্থতায় রূপান্তরিত হয়ে ‘পাগলামি’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যদিও অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, সেগুলো আসলে যুগের চেয়ে এগিয়ে থাকা পদক্ষেপ ছিল।

অধুনা সংবাদ মাধ্যমেও ‘তুঘলকি কাণ্ড’ই চলে। প্রতিষ্ঠানের আয় ও খরচ উঠে আসার জন্য কোন পথে এগোতে হবে তা নিয়ে চলছে টানাপড়েন।  প্রতিষ্ঠানের আয় নিশ্চিত করতে একেবারে নতুন পথ মধ্যস্বত্বভোগী টেকজায়ান্টদের (গুগল, ফেইসবুক, টিকটক ইত্যাদি) কাছে ধরনা দেওয়া হবে, নাকি সনাতনী ব্যবস্থাকেই ভিত্তি হিসেবে ধরে নতুন কৌশল প্রণয়ন হবে? এ প্রশ্নের উত্তর সংবাদ মাধ্যম ব্যবস্থাপকদের কাছে দিনকে দিন প্যারাডক্স হয়ে উঠেছে। 

পুরোপুরি মধ্যস্বত্বভোগী টেক-জায়ান্টদের দিকে হেলে পড়া কিংবা সনাতন কৌশলকে বাছাই করতে হলে সংবাদ মাধ্যমের জন্য কোনটা ‘তুঘলকি কাণ্ড’ হবে?

রেভিনিউয়ের লড়াইয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে সংবাদমাধ্যম। ২০২৩ সালও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বরং ঘটনাপ্রবাহের ‘রোলার কোস্টারে’ চড়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে রীতিমতো খাবি খেতে হয়েছে। গণমাধ্যমকে ‘রিচ’ বাড়াতে ঝুঁকতে হয়েছে ফেইসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ নানা প্ল্যাটফর্মের দিকে। অন্যদিকে এসব সোশ্যাল মিডিয়ার নীতিমালা, অ্যালগরিদম ও মালিকানা পরিবর্তনে ধুঁকতে হয়েছে মিডিয়াকে।

ইলন মাস্কের এক্স/টুইটার অধিগ্রহণ, গণমাধ্যম ভাইস-এর দেউলিয়া হওয়া, যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র গোষ্ঠীর একটি রিচ-এর বিপুল কর্মী ছাঁটাই সংবাদমাধ্যম শিল্পের টিকে থাকা পথ করে তুলেছে ইতিহাসের যে কোনও সময়ের চেয়ে চ্যালেঞ্জিং। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে চ্যাটজিপিটি-র মতো এআই প্রযুক্তির আবির্ভাব।

ইউক্রেইন ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রাণঘাতি যুদ্ধ, জলবায়ু সংকট, কোভিড মহামারীর পরে অর্থনৈতিক মন্দা বিজ্ঞাপনের বাজারকে সংকুচিত করেছে। যেন মিলেমিশে গণমাধ্যমের কবর রচনা করার পরিকল্পনা করছে— সবদিক থেকে চেপে ধরে।

২০২৪ সালও কিন্তু সংবাদমাধ্যমের জন্য এখন পর্যন্ত বড় কোনও সুখবর নিয়ে আসেনি। গেল বছরের ধারাবাহিকতায় খুব বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে না। বরং সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া যেন কফিনে পেরেক ঠোকার জন্য হাতুড়ি হাতে প্রস্তুত। অ্যালগরিদম ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যম পরিবেশিত সংবাদের ‘রিচ’ কমিয়ে দিচ্ছে এসব টেক জায়ান্টরা।

তবে কি কর্মী ছাঁটাই গণমাধ্যমের নিয়তি? তবে কি ঐতিহ্যবাহী সংবাদমাধ্যমগুলো বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে? যদি টিকে যায়, যদি ঘুরে দাঁড়ায়— তাহলে কোন পথে? সারা বিশ্বের সমস্ত দুঁদে মিডিয়া ব্যবস্থাপকরাই নানা বাজার কৌশল বা স্ট্র্যাটেজির পেছনে ছুটছেন।

রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজমের জ্যেষ্ঠ সহযোগী গবেষক নিক নিউম্যানের মতে, তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা এবং মূলধারার মিডিয়ার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চ্যালেঞ্জটি ২০২৪ সালে ৪০টিরও বেশি দেশে নির্বাচন এবং চলমান সংঘাতের ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলবে।

এই পটভূমিতে, রয়টার্স ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নিউম্যানের গবেষণা যে উপসংহারে পৌঁছায় তা হলো— ২০২৬ সালের মধ্যে ইন্টারনেট কন্টেন্টের বড় অংশ ‘কৃত্রিমভাবে তৈরি’ (synthetically produced) করা হবে। খুব সহজে বলতে গেলে যা কিছু খবর, তার বাইরে সোশ্যাল মিডিয়াগুলো নতুন নতুন ট্রেন্ডকে জনপ্রিয় করার মধ্য দিয়ে বাস্তব দুনিয়ার খবরকে অনেকাংশেই বদলে বা ধামাচাপা দিতে সক্ষম হবে।

গণমাধ্যমের এ দুরাবস্থাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে না দিয়ে সাংবাদিক ও ব্যবস্থাপকদের দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। নিউম্যান তার জরিপভিত্তিক গবেষণায় প্রাসঙ্গিক আলোচনা টেনে গণমাধ্যমের আয়-রোজগার এবং টিকে থাকা নিয়ে কিছু পথও বাতলেছেন।

গণমাধ্যমের অর্থায়নে পরিবর্তন

গণমাধ্যমের পাঠক, শ্রোতা অথবা দর্শক যাই বলুন না কেন, খুব দ্রুত হারে সোশ্যাল মিডিয়ার উপর খবরের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। আবার তাদের পিছে পিছে বিজ্ঞাপনের বাজারও খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। একসময়কার শক্তিশালী মাধ্যম, টেলিভিশন স্টেশনগুলো পর্যন্ত স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে পেরে উঠছে না। আবার সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর অত্যন্ত জনপ্রিয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ভক্স এবং ভাইস-ও টেক জায়ান্টদের অ্যালগরিদম পরিবর্তনের কারণে অলাভজনক হয়ে পড়ছে। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কাঁধে ভর না করে, নিজস্ব অর্থায়ন কৌশল খুঁজে বের করার কোনও বিকল্প নেই গণমাধ্যমের।

গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকরাও তাই চালু করছেন নতুন নতুন সাবস্ক্রিপশন মডেল। যার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘কন্টেন্ট বান্ডলিং’।  মানে ভিন্ন ভিন্ন পে-ওয়াল প্যাকেজ তৈরি করা হচ্ছে ভোক্তাদের জন্য, যার মধ্যে থাকছে পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট।

নিউম্যানের দাবি, ‘কন্টেন্ট বান্ডলিং’ কৌশলটি কাজ করেছে। গবেষণায় তিনি দেখেছেন যে, এ ধরনের বাজার কৌশল হাতে নেওয়ায় পাঠক বা ভোক্তারা নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত ঢুঁ মারছেন।

গবেষণার জন্য নিউম্যান গণমাধ্যমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওপর জরিপ চালান। তাতে উঠে এসেছে ২০২৩ সালের দুনিয়াব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ভেতরেও ‘সাবস্ক্রিপশন’ নেওয়া থামিয়ে রাখেননি গ্রাহকরা। বিজ্ঞাপন থেকে আসা আয়ে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সাবস্ক্রিপশন বিক্রির টাকায় তা পূরণ করা যায়নি এখনো। তবে সাবস্ক্রিপশন বিক্রি প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে।

কেবল ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রই নয়, গণমাধ্যমের ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন প্রতিবেশী ভারতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে দেশটির ৭০টিরও বেশি সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন ধরনের ‘পে-ওয়াল’-এর আওতায় নিজেদের কন্টেন্ট রেখেছেন।  

বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ইআই (আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং) তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলছে, ভারতে প্রিমিয়াম ও এক্সক্লুসিভ কন্টেন্টের সাবস্ক্রিপশন গ্রাহকদের বিক্রি করে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলোর আয় ২০২৩ সালে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ১৪ মিলিয়ন ডলার।

যেসব পত্রিকা ছাপা হওয়ার পাশাপাশি অনলাইন পোর্টালও চালায়, তারা নিজেদের কন্টেন্টগুলো নিজেদের পরিবেশিত এক্সক্লুক্সিভ ও গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোকে পে-ওয়ালের আওতায় নিয়ে এসেছে। ইআই-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ভারতে ২০২৫ সালের মধ্যে সংবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট নানা ধরনের পণ্য থেকে সাবস্ক্রিপশনের আয় দাঁড়াবে ২৯ মিলিয়ন ডলারে। তবে ‘কন্টেন্ট বান্ডলিং’ কৌশলের কারণে এ আয় দাঁড়াতে প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫৮ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।

হিন্দুস্তান টাইমস গ্রুপের প্রকাশনা ‘মিন্ট’ ২০২০ সালে ডিজিটাল সাবস্ক্রিশন মডেল চালু করে। গত বছরের ইন্ডিয়ান ম্যাগাজিন কংগ্রেসে ডিজিটাল পে-ওয়াল নিয়ে এক প্যানেল আলোচনায় প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া স্ট্রিমের স্ট্র্যাটেজিস্ট নিখিল কানেকল বলছেন, ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন থেকে ‘মিন্ট’ তার আয়ের ২৫ শতাংশ উঠিয়ে আনছে। তার মতে মিন্টের ক্ষেত্রে কারও উপর নির্ভর না করে সংবাদ ওয়েবসাইট হিসেবে আয় বাড়ানোয় পে-ওয়াল দারুণ কাজ করেছে। 

২০১৮ সালে দিল্লি প্রেস গ্রুপ প্রথমবারের মতো পে-ওয়াল কৌশল প্রয়োগ শুরু করে। এই সংস্থাটির ৯টি ভাষায় ৩০টির বেশি সংবাদমাধ্যমের মালিকানা রয়েছে। ওই একই আলোচনায় দিল্লি প্রেস গ্রুপের পরিচালক অনন্ত নাথ বলেন, “সেসময় কোনো কিছুই কাজ করছিল না। আমরা বাধ্য হয়েই কন্টেন্টের জন্য পে-ওয়াল চালু করি। শুরুতে পাঠকরা দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু আমাদের কোনও উপায় ছিল না। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বিজ্ঞাপনও গণমাধ্যমের আয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলবে।”

২০২৪ সালে ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন পরে সবচেয়ে বেশি আয় হবে বিজ্ঞাপনের খাত থেকে বলে আশা করছেন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকদের লক্ষ্য থাকবে তিন বা চারটি ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়ে একাধিক আয়ের উৎস তৈরি করা, যার অনিবার্য ফল হিসেবে ইভেন্ট এবং ই-কমার্সও বিবেচিত হবে গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস হিসেবে।

নিউম্যানের গবেষণা বলছে, টেকজায়ান্টদের থেকে গণমাধ্যম যে অতিরিক্ত আয় করতো তা বাড়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই বললে চলে। তার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পেছনে কারণ হলো ইতিমধ্যে ফেইসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম সংবাদমাধ্যমগুলোকে কন্টেন্টের বদলে অর্থ দেওয়ার পথ পাল্টে ফেলার কৌশল হাতে নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকে টিকে থাকতে হলে প্রচলিত মাধ্যম থেকে কৌশলগতভাবে সর্বাধিক আয় করার উপযোগী ১০০ ভাগ ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তরিত হতে হবে।

সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রথাগত গণমাধ্যমে বড় পরিবর্তন

নিজের গবেষণায় নিউম্যান চলতি বছরে সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রথাগত গণমাধ্যমের মধ্যকার জটিল সম্পর্কের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন। ফেইসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গত এক বছরেই সংবাদের গুরুত্ব বা প্রাধান্য কমিয়ে দিয়েছে। সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের তুলনায় স্বতন্ত্র কন্টেন্ট নির্মাতাদের প্রাধান্য দিয়ে মেটা ও টিকটক নিজেদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা জারি রেখেছে। আর তাই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে পরীক্ষিত গণমাধ্যমগুলো দর্শক ও পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে কন্টেন্ট ক্রিয়েটর বা ইনফ্লুয়েন্সারদের থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।

পাশাপাশি ভিডিও-কেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্ম যেমন টিকটক ও ইউটিউব-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংবাদ পরিবেশনার পদ্ধতিতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। 

নিউম্যান গত মাসে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টস (আইসিএফজে)-এর এক ওয়েবিনারে বলেন, “তথ্য-উপাত্ত বলছে, সংবাদ পরিবেশন ও প্রচারের যে প্রক্রিয়া, তা একটি জটিল ‘ইকোসিস্টেমে’ পরিণত হয়েছে। ফেইসবুক এখন আর এই জগতের দণডমুণ্ডের কর্তা নেই।”

সংবাদ সম্প্রচারের প্রক্রিয়ায় আমূল এ পরিবর্তনের ফলে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বিশ্বজুড়ে প্রকাশক ও ব্যবস্থাপকদের নামতে হয়েছে নতুন নতুন উপায়ের সন্ধানে। যেমন, ভোক্তার পছন্দমাফিক কন্টেন্ট দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হাতিয়ার হিসেবে নিতে হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো ম্যাসেজিং অ্যাপেরও। 

সংবাদ পরিবেশনায় পরিবর্তন: বেশি বেশি অডিও-ভিডিও

বিগত দুই দশকে, অনুসন্ধান করে সংবাদের লিঙ্ক খুঁজে পাওয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মারফতে আরেকজনকে সেটি পাঠানো সহজ ছিল। বেশিরভাগ সময়েই লিখিত কন্টেন্টই ছিল গণমাধ্যমের আয়ের অন্যতম জোগানদাতা। অডিও-ভিডিওর মতো অন্যান্য কন্টেন্টগুলোকে বিবেচনা করা হতো সহকারীর ভূমিকায়।

কিন্তু গত কয়েকবছরে মানুষের হাতে থাকা মোবাইল ডিভাইসগুলোর প্রাযুক্তিক উন্নয়ন বদলে দিয়েছে পুরনো চিত্র। আবার এ সময়ের মধ্যেই, অডিও এবং ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি এবং শেয়ার করার বেশ কয়েকটি প্ল্যাটফর্মও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের গ্রাহকরা পড়ার বদলে শোনা ও দেখাকেই বেশি পছন্দ করছে।

নিউম্যানের জরিপে উঠে এসেছে, কিছু সংবাদমাধ্যম এই পরিবর্তনকে প্রথাগত বার্তাকক্ষের জন্যে ডিজিটাল বিপ্লবের ‘দ্বিতীয় পর্যায়’ হিসেবে দেখছে। টেক্সট নির্ভর কন্টেন্ট থেকে সরে এসে মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট তৈরিতে সাফল্য পেতে হলে বার্তাকক্ষগুলোকে তাদের কর্মসংস্কৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা ছাড়া কোন উপায় নেই।

২০২৪ সালে সংবাদমাধ্যমগুলো আরও বেশি ভিডিও-অডিও কন্টেন্ট তৈরি করবে, যা একই সময়ে প্রচারিত-প্রকাশিত লিখিত কন্টেন্টের সংখ্যার প্রায় সমান হবে বলে ধারণা করছেন নিউম্যান।

এআই: সর্বগ্রাসী এক শক্তি?

নিউম্যানের গবেষণায় ২০২৪ সালে গণমাধ্যমের সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা এবং সুযোগ তুলে ধরার একটি প্রয়াস ছিল। নতুন প্রযুক্তি কীভাবে ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করবে— তার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন তিনি।

গবেষণায় বলা হয়, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) আবির্ভাব চলতি বছরে বিশ্বজুড়ে তীব্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সংবাদমাধ্যম খাতকেও কাঁপিয়ে দেবে।”

এআই-এর সঙ্গে সংবাদ পরিবেশনের গুণগত মান নিয়ে পেরে উঠবেন কিনা— তা নিয়ে গণমাধ্যম ও ব্যবস্থাপকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। বিশেষত, কন্টেন্ট তৈরিতে এআই-এর প্রভাব সর্বগ্রাসী হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।  নিউম্যান নিজের গবেষণাতেও এআই এর হুমকির বিষয়ে জোর দিয়েছেন। তার মতে, তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের জায়গা এআই-এর দখলে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

চলতি বছর অনলাইনে ব্রাউজার দিয়ে সার্চ করলে রেফারেল ট্রাফিক আরও কমবে বলে মনে করছেন সম্পাদক ও গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকরা। কারণ এআই সার্চ ইঞ্জিন এবং অন্যান্য মাধ্যমগুলো নিজেদের ব্যবসায়িক সুবিধায় একসঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। গুগল এবং মাইক্রোসফট ইতিমধ্যে সার্চ জেনেরেটিভ এক্সপেরিয়েন্স (এসজিই) ব্যবহার করছে। ফলে আগে যেমন সার্চ করলেই গুগল কেবল ওয়েবসাইটের লিংক দিতো, এখনও সেটি দিচ্ছে— তবে গ্রাহকের সামনে সবার প্রথমে তথ্য বা অনুসন্ধানের সরাসরি উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। ফলে অনুসন্ধানকারীর লিংকে ঢোকার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।   

চ্যাটজিপিটি-এর নির্মাতা ওপেনএআই-এর সঙ্গে যৌথভাবে রিয়েল-টাইম সংবাদ পরিবেশন শুরু করেছে মাইক্রোসফটের সার্চ ইঞ্জিন বিং। এর অ্যালগোরিদমের মডেলটি সংবাদ ওয়েবসাইটসহ বিভিন্ন সাইটের কন্টেন্ট থেকে তথ্য সেঁচে আনার ব্যাপারে পটু। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চ্যাটজিপিটি-এর আদলেই গুগল নিয়ে এসেছে ‘জেমিনাই’। ইন্টারনেট কন্টেন্ট এবং অন্যান্য উৎসগুলো থেকে তথ্য নিয়ে ‘জেমিনাই’ লেখা, ছবি, অডিও এবং ভিডিও নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারদর্শী। এর সাহায্য নিয়ে গুগল-এর এই চ্যাটবট  ইন্টারনেটে সার্চের ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে অমিত শক্তিশালী।

গতমাসের আইসিএফজে-এর ওয়েবিনারে নিউম্যান বলেছিলেন, “কিছু গণমাধ্যম ব্যবস্থাপক সত্যিই এআইকে অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেন। কেননা, তথ্য অনুসন্ধানের নতুন এই অভিজ্ঞতা গণমাধ্যমের জায়গা দখল করে নেবে।”

তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, এআই-এর প্রভাবগুলো সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। ফলে এটি গণমাধ্যম ব্যবসাকে কীভাবে প্রভাবিত করবে সে পূর্বাভাস এখনই দেওয়া যাচ্ছে না।

এ অনিশ্চয়তাও পুরনো প্রশ্নটিকেই সামনে নিয়ে আসে— এআইয়ের ক্ষমতা বাড়ার কারণে গণমাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেল কতটা অকেজো হবে?

আর তা গণমাধ্যম ব্যবস্থাপক ও নীতি নির্ধারকদের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কৌশলের ওপরই নির্ভর করছে।

দর্শক-পাঠকের আচরণ এবং নতুন প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের খাপ খাইয়ে নেওয়ার কার্যকরী কৌশল কোনটা হবে— সেটি বোঝার জন্য ২০২৪ সাল হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক কথায় বলা চলে পাঠক-দর্শকের সঙ্গে আরও শক্তিশালী, আরও সরাসরি সম্পর্ক খুঁজতে হবে গণমাধ্যমগুলোকে। হয়তো সেটাই শেষ উপায়।