চিন্তার স্বাধীনতা, বিশ্ববিদ্যালয় ও গণমাধ্যম

আমরা মজ্জাগতভাবেই স্বাধীনচিন্তাপন্থী। আর এই শিক্ষাটা, মূখ্যত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছি। অথচ, আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেল, এ বড় বিস্ময়কর ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য!

সৌমিত জয়দ্বীপসৌমিত জয়দ্বীপ
Published : 2 April 2023, 11:00 AM
Updated : 2 April 2023, 11:00 AM

চিন্তায় ও বুদ্ধিবৃত্তিতে উন্নত হতে চায় যে সমাজ ও রাষ্ট্র, তার অবশ্য কর্তব্য হলো নাগরিকের স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করা। শুধু সুনিশ্চিত করলেই হবে না। আদর্শিকভাবে বোধ করতে হবে যেন শাসকের তরবারি কোনভাবেই, ভুলক্রমেও, এই স্বাধীনতার প্রতি অশ্রদ্ধাশীল ও নিবর্তনমূলক না হয়। আর এজন্য রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য হলো দুটি প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত স্বাধীনতা প্রদান করা এবং এদের কাজের এখতিয়ারের মধ্যে নাক না গলানো। একটি হলো, গণমাধ্যম; অপরটি, বিশ্ববিদ্যালয়।

সমাজ ও রাষ্ট্রে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দুই আধার হলো বিশ্ববিদ্যালয় ও গণমাধ্যম। ছোটবেলায় পড়তাম, ‘সংবাদপত্র তথ্যের পাওয়ারহাউজ’। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বুঝলাম, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের পাওয়ারহাউজ’। তথ্য-সংযোগের প্রতি মানুষের আগ্রহ প্রবৃত্তিগত। অবাধ তথ্য-প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে মানুষ নানা বিচার-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে চায়। সেই জ্ঞানকে কাঠামোবদ্ধ বৈজ্ঞানিকভিত্তিতে প্রকাশ করার স্বাধীনতা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে, দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও গণমাধ্যমের সম্পর্ক মূলত একটি সম্পূরক-সম্পর্ক।

বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ তথা পুরো পৃথিবীর জন্যই নিত্যনতুন জ্ঞান সৃজনে ব্রত থাকবে; তার কাজটা প্রাত্যহিক গবেষণার, তবে ফলাফলটা সুদূরপ্রসারী। গণমাধ্যম জনগণের নৈমিত্তিক আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংকট ও সম্ভাবনার কণ্ঠস্বর; প্রতিদিনই তাকে নিত্যনতুন বিষয়ে কথা বলতে হয়; তাই তার কাজের প্রতিক্রিয়াও হয় তাৎক্ষণিক।

২.

‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ধারণাটির সঙ্গে স্বায়ত্তশাসন, চিন্তার স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা বিষয়গুলোর এক নিবিষ্ট সম্পর্ক ও যোগাযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধিকার স্বোপার্জিত। চিন্তার স্বাধীনতা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জ্ঞান সৃজন ও বিকাশে কোনোভাবেই ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারবে না। সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আমাদের রাষ্ট্রনির্মাতারা এদেশের চারটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের বলে স্বায়ত্তশাসন উপভোগের অধিকার দিয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে দিয়েছিলেন, ব্যাপারটা এমন নয়। দিতেই হতো। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থার আদি-অন্ত যে ইতিহাস, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চার অবাধ স্বাধীনতা না দিলে তার পক্ষে ক্রিটিক্যাল ও র‌্যাশনাল হওয়াটা দুষ্কর।

সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে সেই অধিকার চর্চা করতে দেওয়া সেদিন যেমন জরুরি ছিল, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও আজ তা সমান জরুরি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যেমন জরুরি, ঠিক তেমনই জরুরি গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ ধারা ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা’য় বলা হয়েছে, “(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।... ২(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং ২(খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।” সংবিধানের এটি একটি মৌলিক অধিকারের ধারা এবং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সর্বোত্তম চেষ্টা থাকা উচিত এই ধারার সম্মানকে অক্ষু্ণ্ন রেখে এর মর্মবাণীকে অনুধাবন করা। কিন্তু, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামক এমন একটি ভীতি জাগানিয়া আইন করে রাখা হয়েছে, যা সংবিধানের মৌলিক অধিকারেরই পরিপন্থী। এর আগে ভীতি জাগিয়েছে আইসিটি আইনের কুখ্যাত ৫৭ ধারা, এখন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ)। এর শিকারে পরিণত হয়েছেন বহু মানুষ। মূখ্যত স্বাধীন মত প্রকাশের দায়ে। কিন্তু, এতবার এত এত জায়গা থেকে জনদাবি ওঠার পরেও নিবর্তনমূলক এই আইনটি সংহারের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘কপাল’ ভালো যে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই আইনের খপ্পরে তাদের পতিত হতে হয়নি। যদিওবা বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কারও কারও ওপর ডিএসএ-এর প্রয়োগ হয়েছে, তবে দুঃখের মধ্যে সত্য এই যে, বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কখনই এই আইনের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি। ব্যক্তিগতভাবে অনেক শিক্ষকই হয়তো বলছেন এখনও, কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় বলেনি, এটা বেশ চোখে পড়ার মতো ঘটনা। ঘটনা, কারণ, একটা নিবর্তনমূলক আইন যে রাষ্ট্রের নাগরিকদের টুঁটি চেপে ধরছে এবং বাক্ ও চিন্তার স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারটি যে এই আইন বাবদ খর্ব হচ্ছে, সেটা ‘মুক্তবুদ্ধি চর্চার আধারক্ষেত্র’ বিশ্ববিদ্যালয় আমলেই আনেনি।

না-আনার কারণও আছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের পর সৃষ্টি হওয়া তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার ব্যবস্থায় এতটাই দলান্ধ হয়ে পড়েছে যে, তাদের নিজেদের ভূমিকা পার্টি-সভ্যদের তুলনায় আলাদা করা যায় না। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ সময়ে যতটা শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি নিয়োগ হয়েছে ‘সম্ভাবনাময় পার্টিসভ্য’। বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক চর্চাবোধ প্রায় বিলুপ্ত এক প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন হয়েছে ‘হীরক রাজা’। ফলে, সর্বৈব এক বুদ্ধিবিলোপ রেজিমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিব্যি নিজেদের চালিয়ে নিচ্ছে।

৩.

এমন এক পরিস্থিতিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রায় আকাশচুম্বি এক প্রত্যাশা নিয়ে হাজির হয়েছি— বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা বদলানোর কথা বলবে!

সেই প্রত্যাশা আমরা করতে পারি। কেননা, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থা পুরো উপমহাদেশেই এক অন্য উচ্চতায় আসীন হয়ে আছে। যার গুরু হলো পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ কলোনিয়াল রেজিমে প্রতিষ্ঠিত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩তম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু ছিল প্রায় সব অর্থেই অন্যরকম। শুরুতে ১৯১২ সালের নাথান কমিটি এবং পরে ১৯১৭-১৯১৯ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা স্যাডলার কমিশনের সুপারিশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় উপমহাদেশের প্রথম ডিগ্রিপ্রদানকারী (অ্যাফিলিয়েটেড) আবাসিক ও একাডেমিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে উপাচার্য অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আদর্শ এবং উচ্চমান স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তা বিরল।‘ কথাটা অধ্যাপক আরসি মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাপদ্ধতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন। কিন্তু, কথাটা আরও নানাপ্রসঙ্গেই প্রযোজ্য।

যদিওবা ১৯২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে লর্ড রিপন বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো বঙ্গভঙ্গ রদের ‘রাজকীয় ক্ষতিপূরণ’, তথাপি এ কথাও উল্লেখ করতে হবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য স্যার পিজে হার্টগ বলেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যাশা, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতে এক মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা পালন করবে।’ সেটা করতে গিয়ে স্যার হার্টগ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাপদ্ধতিকে ‘যান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে এখানে বেশ কয়েকটি নিয়ম চালু করেছিলেন ( যেমন: দুই পরীক্ষক পদ্ধতি, নম্বরের পার্থক্য শতকরা দশের বেশি হলে তৃতীয় পরীক্ষক, পরীক্ষার খাতায় নম্বর না দেয়া, মৌখিক পরীক্ষা, বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দ্বারা ফল নির্ধারণ ইত্যাদি), যেগুলোর প্রায় সবগুলোই আজও বাংলাদেশে প্রচলিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আদর্শ’ হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন শিক্ষকবৃন্দ। উপাচার্য হার্টগ প্রায় বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন শিক্ষক নিয়োগে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করলেও, শিক্ষক নিয়োগে পরে যথেষ্ট প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জী। তথাপি, মূল কৃতিত্বটা অবশ্যই হার্টগের।

১৯২০ সালের অগাস্টে ভারতের গভর্নর জেনারেল উপাচার্য হার্টগকে লেখা এক চিঠিতে অনেক পরামর্শের ভেতরে প্রথম যে বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন, সেটি ছিল শিক্ষক নিয়োগ। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত গৎবাঁধা চাকরির যে নিয়মনীতি তা থাকবে না।’ ওই চিঠিতে গভর্নর জেনারেল বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের নিয়োগের ব্যাপারেও প্রস্তাব করেছিলেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, ‘শিক্ষক নিয়োগে হার্টগ গভর্নরের সব সুপারিশ বা অনুরোধ রক্ষা করেননি। অ্যাকাডেমিক কৃতিত্ব নেই এমন কাউকে তিনি নিতে চাননি।... হার্টগ গুরুত্ব দিচ্ছিলেন অ্যাকাডেমিক পাণ্ডিত্যের ওপর।’

পৃথিবীর প্রায়-বিরল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী চৈতন্যের বুকে জন্ম নিয়েছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নসৌধ। সেটা ছিল একটি গভীর রাজনৈতিক প্রশ্ন এবং রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারার প্রশ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওই চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করতে পেরেছিল এবং সমগ্র জাতিকে পথ দেখিয়েছিল। ওই যে চ্যালেঞ্জ করতে পারার সক্ষমতা, ওটা ছিল আসলে স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারারই সমানুপাতিক। স্বাধীনচিন্তার পথ উন্মুক্ত না হলে, চিন্তামুক্তির আস্বাদ না পেলে, মানুষ শেষ পর্যন্ত রুখে দাঁড়াবেই। আর সেই রুখে দাঁড়ানোর লড়াইটা শেষ পর্যন্ত গিয়ে স্বাধীকারের আন্দোলনেই রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাপ্তি দিয়ে তা অনুধাবন করতে পেরেছিল। সেই বুদ্ধিবৃ্ত্তিক সাংস্কৃতিক চেতনার গুণেই ১৯৫২ বা ১৯৬২ বা ১৯৬৯ সালের সৃষ্টি হয়েছিল।

আমরা মজ্জাগতভাবেই স্বাধীনচিন্তাপন্থী। আর এই শিক্ষাটা, মূখ্যত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছি। অথচ, আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেল, এ বড় বিস্ময়কর ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য!

৪.

ধরে নিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কিংবা তাদেরকে অনুসরণ করে আরও যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বিবৃতি দেওয়ার সম্ভাব্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়াননি বা দাঁড়াবেন না, তারা মূলত একটি জাতীয় দৈনিকের ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা’র বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু, তাদের যুক্তি এত অসাড় যে, তারা নিজেরাও চাইলে দৈনিক প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনটিকে কোন মেরিটেই ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ প্রমাণ করতে পারবেন না। তবে, সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, একদম শেষ লাইনটিতে তারা লিখেছেন, ‘উক্ত সংবাদপত্রসহ সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।’ সন্দেহাতীতভাবেই ওই বিবৃতিতে ভাষিক ও ব্যাকরণগত ত্রুটি আছে (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এ নিয়ে সরব), বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে এমনটা অনভিপ্রেত ও অপ্রত্যাশিত হলেও, সেটা আমাদের এ আলোচনায় গৌণ বিষয়। বিবৃতিটির মূলভাব যদি আমি যথার্থ বুঝে থাকি, তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি মূখ্যত সরকারের কাছে নালিশ জানাচ্ছে যেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উহ্য থাকলেও, সেই আইন যে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ সেটা হয়তো তারা স্বীকার করবে না। কিন্তু, মর্মবাণীটা ওটাই। যে আইনেই তারা এই বিচারটা চান না কেন, তাদের অবস্থানটা এজন্য ন্যাক্কারজনক যে, তারা পরিপূর্ণভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়ালেন এবং পরোক্ষে একটা নিবর্তনমূলক আইনের পক্ষে কথা বললেন। ভাবা যায়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়, তাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন রীতিমতো আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজটা করলেন!

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কত বড় পার্টিজেন হয়ে গেছেন, এই বিবৃতিটি পড়লেই সেটা সাদা চোখে বোঝা যায়।

৫.

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের নানা সংকট আছে। তার মধ্যে জনগণের প্রকৃত কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে না পারাও একটি। সঙ্গে সাংবাদিকতা পেশার পেশি দেখানোর একটি 'সফট পাওয়ার'ও কেউ কেউ লালন করেন। লেজুড়বৃত্তি গণমাধ্যমকেও আর নিরপেক্ষ থাকতে দিচ্ছে না। এই ইস্যুতেই যেমন খোদ ‘এডিটরস গিল্ড’ একবার গণমাধ্যমের পক্ষে কথা বলেও, একদিন পরেই ইউটার্ন নিয়েছে।

বলাবাহুল্য, দৈনিক প্রথম আলোর ভূমিকা নিয়েও সরকারের ভেতরে নানারকম প্রশ্ন বরাবরাই আছে। এর একটি তো রাষ্ট্রবিদিত যে, সুশীল এলিটদের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পত্রিকাটির ভূমিকা নিয়ে সরকার বরাবরই উচ্চকিত। কিন্তু, তাই বলে, স্বাধীনতার দিনে ‘মাছ, মাংস ও চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ নামের একটি সংবাদ প্রতিবেদনের জন্য (যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো এখানে আর খণ্ডন করতে চাইছি না), একজন সাংবাদিককে সাজার মুখোমুখি করতে হবে! আর সেখানে কি না সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি!

ওই শিক্ষকরা কি ভুলে গেলেন, মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের কথা, ১৯৭২ সালের সংবিধান উল্লিখিত মৌলিক অধিকারের কথা? ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ‘মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র’-এর ১৯ ধারাতেও তো গণমাধ্যমের মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা স্পষ্ট বলা আছে। ঊনিশ শতকের বিশের দশকে মুসলিম সাহিত্য সমাজের ‘শিখা পত্রিকা’র প্রতি সংখ্যায় লেখা হতো: ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি যেখানে অসম্ভব।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের কি এসব কথার মর্মবাণীকে বোধবুদ্ধিতে আনার প্রয়োজন নেই? নাকি, পার্টিসভ্যর মতো আচরণই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মূল অভিপ্রায়?

২০১৫ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এক যুগান্তকারী রায় আছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। শ্রেয়া সিংহল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়ার মধ্যকার সেই মামলায় ভারতীয় ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট ২০০০-এর ৬৬এ ধারাকে (সঙ্গে ধারা ৭৯) ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক বলেছিলেন এ জন্য যে, ভারতীয় সংবিধানের ১৯(১)(এ) এবং ১৯(২) ধারায় প্রদত্ত ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’-এর সঙ্গে তা সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

আজকে বাংলাদেশের মানুষ যখন বাক্ স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের কথা বলছে, তখন পার্শ্ববর্তী দেশের এ দৃষ্টান্তের দিকে বাংলাদেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকালেন না। অথচ, অন্যান্য অনেক বিষয়েই তারা বিবৃতিতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন।

৬.

মনে হচ্ছে, চলমান যে ইস্যুটি এত বড় হয়ে উঠল, তার কারণ, নানাভাবে সরকারকে এ ব্যাপারে উস্কানি দেয়া হয়েছে। গণমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে না-থাকা শক্তিশালী বিরোধী দলের কিছুটা হলেও বিকল্প বাংলাদেশে। গণমাধ্যমের দায়িত্বও মূলত তাই। কিন্তু, এই যে একটা ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী’ লড়াই বেধে গেল, সেটা যতটা না রাষ্ট্র বা সরকারের সঙ্গে ‘প্রথম আলো’র তার চেয়েও অনেক বেশি মূলত রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী পার্টি বনাম 'ফোর্থ এস্টেট' গণমাধ্যমের। আর এর মধ্যেই হুট করে প্রবেশ করে ফেলল রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্ববিদ্যালয় তথা তার শিক্ষক সমিতি! বয়ান দিচ্ছে পার্টিজেনের মতো, বিপক্ষে যাচ্ছে স্বাধীন মত প্রকাশের। কী তাজ্জব!

৭.

লেখাটা শেষ করি স্যার আশুতোষ মুখার্জীর কথা দিয়ে। তাঁর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা-সচেতন উপাচার্য সম্ভবত ভারতবর্ষের ইতিহাসেই আর কেউ আসেননি। ১৯২২ সালের ২ ডিসেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনেট সভার সভাপতির ভাষণে তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লিখে রাখা যেতে পারে, তাতে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপথে যাওয়ার মতিভ্রম কিছুটা হলেও সংকুচিত হয় আর কী! তাঁর কথা পড়া যাক (অনুবাদ বর্তমান লেখকের):

“আমার শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবমাননার কোনো কাজে অংশগ্রহণ করব না। এ বিশ্ববিদ্যালয় দাস উৎপাদনের কারখানা হবে না। আমরা সত্যচিন্তা করতে চাই। আমরা স্বাধীনতার শিক্ষা দিতে চাই। আমরা উঠতি প্রজন্মকে উচ্চ ও নৈতিক মানোন্নয়নের চিন্তা-ভাবনায় অনুপ্রাণিত করব। আমরা সরকারি সচিবালয়ের অংশ হব না... আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্যদের অনুরোধ জানাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। বাংলার সরকারকে ভুলে যান, ভারত সরকারকে ভুলে যান। আপনাদের আলমা মাতের প্রকৃত সন্তান হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর হিসেবে আপনাদের দায়িত্ব পালন করুন। স্বাধীনতা প্রথম, স্বাধীনতা দ্বিতীয়, স্বাধীনতা সর্বদা— এছাড়া অন্যকিছু আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না।”

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ‘আজকে সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই!’