Published : 24 Jun 2020, 05:23 PM
[প্রথম উপাখ্যান। এই ঘটনা ঠিক কখন ঘটিয়াছিল তাহা না হয় অনুক্তই থাকিল। কুট্টনীগঙ্গা নদী তীরবর্তী বিক্রমশীলা নগরে বিক্রমাদিত্য নামে এক প্রবল পরাক্রমশালী নৃপতি রাজত্ব করিতেন। এই মহানুভব রাজা কখনই কোনো সাহায্যপ্রার্থীকে বিমুখ করিতেন না। একদা এক কাপালিক সন্ন্যাসী বিশেষ এক যজ্ঞকার্যে সহায়তা করিতে রাজাকে অনুরোধ করিলে রাজা স্বভাবতই তাহাতে সম্মত হইলেন। সন্ন্যাসীর সঙ্কেতানুসারে অসিহস্তে ঘোর অমানিশাকালে কুট্টনীগঙ্গাতীরস্থ মহাশ্মশানে উপস্থিত হইয়া রাজা দেখিলেন, রক্তবস্ত্র পরিধান করিয়া সন্নাসীবর বলির যুপকাষ্ঠ ও যজ্ঞের অন্যান্য উপকরণ সাজাইয়া ব্যাঘ্র চর্মাসনে বসিয়া আছেন। বিক্রমাদিত্যকে দেখিবামাত্র অদূরবর্তী সুউচ্চ এক ন্যগ্রোধ বৃক্ষের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া সন্ন্যাসী কহিলেন: 'ঐ বৃক্ষের সর্বোচ্চ শাখাগ্রে একটি শব লম্বমান রহিয়াছে। সত্বর গিয়া শবটি লইয়া আইস!' বিক্রমাদিত্য অবিলম্বে সন্ন্যাসীর নির্দেশ পালন করিতে গেলেন। কিন্তু শবদেহটি সংগ্রহ করিয়া রাজা বৃক্ষ হইতে নামিবামাত্র শব লম্ফ দিয়া রাজার স্কন্ধোপরি চাপিয়া বসিল এবং অট্টহাস্যপূর্বক কহিল: 'আমি বেতাল জ্ঞানপাপী'। তোমাকে একেকটি বিষয়ে প্রশ্ন করিব। যদি উত্তর দিয়া আমাকে সন্তুষ্ট করিতে না পার, তবে তৎক্ষণাৎ তোমাকে হত্যা করিব। জিতেন্দ্রিয়, অকুতোভয়, সর্বশাস্ত্র ও সর্বশস্ত্র বিশারদ রাজা বিক্রমাদিত্য যজ্ঞস্থলের দিকে অগ্রসর হইতে হইতে বেতালের প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগিলেন।]
বেতাল: অধম বিশ্বে গণতন্ত্রের মূল সমস্যা কি, বিক্রমাদিত্য?
বিক্রমাদিত্য: 'হে বেতাল, 'মাৎস্যন্যায়' শব্দটির প্রতি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। 'ন্যায়' শব্দের অর্থ 'বিচার' বা 'যুক্তি'। 'মাৎস্যন্যায়' শব্দের অর্থ 'মাছের বিচার' বা 'মাছের যুক্তি'। বৃহদাকার মৎস্য প্রয়োজন কিংবা নিজস্ব খেয়ালখুশি অনুসারে ক্ষুদ্র মৎস্যকে উদরস্থ করে। বিনা প্রতিবাদে এই শাসন-ব্যবস্থা স্বীকার করা ব্যতীত ক্ষুদ্র মৎস্যের উপায়ান্তর নাই। সাগর কিংবা জঙ্গলের জীবন মাৎস্যন্যায়ের এই আইনে পরিচালিত হয়।
ইতিহাসের কোনো কোনো পর্যায়ে, পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতি বিরাজ করিত বটে, কিন্তু যে কেহ স্বীকার করিবে যে, মাৎস্যন্যায় মানব সমাজ পরিচালনার নীতি হইতে পারে না, কারণ প্রথমত, ক্ষুদ্র-মধ্যম-বৃহৎ সকলকে জীবনধারণ করিতে না দিলে আগে পরে সমাজেরই ক্ষতি; দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্রকায় আর বৃহৎকায় না থাকিলে কী প্রকারে বুঝা যাইবে, কে মধ্যমকায়? ক্ষুদ্রকায় আর মধ্যমকায় না থাকিলে কোনো একজনকে বৃহৎকায় হিসেবে গণ্য করিবারইবা উপায় কী?
ভারতবর্ষের পুরাণে বলা হইয়াছে, সমাজে 'মাৎস্যন্যায়' যাহাতে সৃষ্টি না হয়, সেই নিমিত্ত 'প্রজাগণ' সলাপরামর্শ করিয়া নিজেদিগের মধ্যে একজনকে 'রাজা' নির্বাচিত করিয়াছিল। সেই রাজা যদিও প্রথমে রাজী হন নাই, রাজ্য পরিচালনার জন্য নিয়মিত কর পাইবার প্রতিশ্রুতি পাইয়া নিমরাজী হইয়াছিলেন। এই কাহিনীমতে প্রথমে সৃষ্টি হইয়াছিল প্রজা, তারপর রাজা। সুতরাং রাজার প্রজা হইতে পারে না, প্রজার রাজা হইয়া থাকে। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন: 'আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে!' 'প্রজা' শব্দের অর্থ {প্র}{জ}, অর্থাৎ যাহারা প্রকৃষ্টরূপে সৃষ্টি হইয়াছেন। হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার আরেক নাম 'প্রজাপতি', কারণ তিনি প্রজা সৃষ্টি করিয়াছেন, অবশ্যই রাজা সৃষ্টি হইবার বহু পূর্বে।
রাজ্য পরিচালনার জন্য রাজা অপরিহার্য নহে। প্রাচীন গ্রীসে কয়েক খানি গণরাজ্য ছিল। বৈশালী এবং তক্ষশীলা ভারতবর্ষের দুটি গণরাজ্যের উদাহরণ। এই গণরাজ্যগুলোতে সংসদের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে নাগরিকগণ সমবেত হইয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিত, কী প্রকারে শাসনকার্য পরিচালিত হইবে। রাজ্য পরিচালনার এই পদ্ধতির নাম 'গণতন্ত্র'। ইওরোপ এবং ভারত উভয় অঞ্চলেই সাম্রাজ্য বিস্তারের কালে এই গণরাজ্যগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রও হারাইয়া গিয়াছিল। মধ্যযুগে এই পদ্ধতি বহাল ছিল বিভিন্ন গিল্ড বা সংঘে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেটি ছিল মূলত একটি পেশাজীবী সংঘ। এই সব প্রতিষ্ঠান সমবেত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হইত। অবশেষে মধ্যযুগের অবসানে যখন ইওরোপে জাতিরাষ্ট্র গঠিত হইতে শুরু করে, তখন গণতন্ত্র পুনরায় শাসনপদ্ধতি হিসেবে গৃহীত হয়।
'রাজতন্ত্র' শব্দের অর্থ 'রাজার তন্ত্র'। রাজতন্ত্রে রাজ্য চলে রাজার খেয়ালখুশিমতো এবং রাজাকেই রাজ্যের এবং জনগণের মালিক ভাবা হইয়া থাকে। রাজাই সেখানে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, রাজামশাইয়ের কোনো প্রকার সমালোচনা করা যায় না, জীবিতাবস্থায় কিংবা মৃত্যুর পরেও। অনুরূপ বেয়াদবি কেহ করিলে, রঙ্গপুর বা অনুরূপ প্রান্তিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অজ্ঞাত, অখ্যাত নারী শিক্ষকও যদি তিনি হইয়া থাকেন, রিমান্ড-বেত্রাঘাত-কারাবাস অনিবার্য, ভাগ্য মন্দ হইলে সৌদি খাসোগির মতো তাহার শরীর খণ্ডবিখণ্ড হইয়া যাওয়াও বিচিত্র নহে। রাজার ইদৃশ কুকর্মের মূল উদ্দ্যেশ্য ভীতিপ্রদর্শন, যাহাতে কেহ তাহার বিরুদ্ধে মস্তক উত্তোলন করিতে না পারে। অবশ্য রাজতন্ত্রে জনসাধারণের জীবন দুর্বিসহ হইবেই এমন কোনো কথা নাই। প্লেটো বিশ্বাস করিতেন, রাজা যদি চরিত্রবান হইয়া থাকেন, তবে রাজতন্ত্রই হইবে সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা। কিন্তু যুগে যুগে ক্ষমতাবানদের খুব কমই চরিত্রবান হইতে দেখা গিয়াছে। মৎসদৃশ চরিত্রবান রাজা সর্বকালে বিরল ছিল।
'গণতন্ত্র' শব্দের অর্থ 'গণ-এর তন্ত্র'। 'প্রজাতন্ত্র' ও 'গণপ্রজাতন্ত্র' সমার্থক শব্দ। 'গণতন্ত্র' নামক শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মালিক বা রাজা হইতেছে 'প্রজা', 'গণ', 'জন'। 'প্রজাতন্ত্র' হইতেছে সেই রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতি, যাহাতে প্রজাকেই রাজ্যের মালিক মনে করা হইয়া থাকে। যেমন ধর, ভারতবর্ষের সর্বনবীন রাষ্ট্রটির নাম: 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ'। এই 'প্রজাতন্ত্র' শব্দটিতে বাংলাদেশে আপত্তি লক্ষ্য করা যায়। আপত্তি যাহারা করেন, 'প্রজা' শব্দটা তাহাদিগের পছন্দ নয়, কারণ তাহারা মনে করেন, রাজারই শুধু প্রজা থাকে। এই ধারণা সঠিক নহে। 'প্রজা', 'জন', 'গণ', 'জনতা' – এই শব্দসমূহের মধ্যে মিল আছে অর্থের দিক হইতে এবং সম্পর্ক আছে ব্যুৎপত্তির দিক হইতে। এই শব্দসমূহ এবং 'জন্ম' শব্দ একই {জন} ধাতুজাত। 'গণপ্রজা', 'জনগণ' এক ধরনের বীপ্সা বা দ্বিরুক্ত শব্দ, 'বিয়েসাদি', 'পাঁউরুটি' বা 'বইপুস্তক'-এর মতো, যেখানে সমার্থক, দুই উৎসজাত দুটি শব্দ সম্মিলিত হইয়া (তৎসম 'বিয়ে' এবং ফারসি 'সাদি', পর্তুগিজ 'পাঁউ' এবং হিন্দি/বাংলা 'রুটি') একেকটি পৃথক, নতুন শব্দ গঠিত হয়, অনেকটা কাকতালীয়ভাবে।
রাজতন্ত্রে রাজামশাই মন্ত্রী বা সচিবদের সহায়তায় রাজ্য পরিচালনা করিয়া থাকেন। গণতন্ত্রে জনগণ তাহাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করিয়া থাকে এবং সেই প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাজ্য পরিচালিত হইয়া থাকে। জনগণ সরাসরি রাজ্যপরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারেন না। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক যে জনগণ, ইঙ্গরাজি ভাষায় 'পাবলিক', তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। প্রধান-অপ্রধান সকল মন্ত্রী-সচিব 'পাবলিক সার্ভেন্ট', আক্ষরিক অর্থে 'গণদাস'। রাষ্ট্রের বেতনভোগী মাত্রেই, তিনি যে কেহ হইতে পারেন, মূলত তিনি জনগণের সেবায় নিয়োজিত একজন (কথ্য বাংলায় যাহাকে বলে) 'চাকর' কিংবা 'বুয়া' বৈ নন।
মধ্যযুগ হইতেই গণদাসদের একটি শ্রেণি হইতেছে 'ক্লার্ক' বা করণিক। 'ক্লার্ক' শব্দের অর্থ 'সেই সব চাকর যাহারা (ইঙ্গরাজিতে) 'ক্লিয়ার' অর্থাৎ পরিষ্কার দেখিতে পান, কমবেশি লেখাপড়া জানার কারণে।' ক্লার্ক গীর্জার একটি পদ। অধ্যাপক, বিচারক, আমলা, মন্ত্রী, কর্মকর্তা ইত্যাদি গীর্জার একেকটি পদ, ভ্যাটিকানে এইসব পদ অধ্যাবধি বর্তমান। ইহারা সকলেই ক্লার্ক, শিক্ষিত দাস, চাকর, কথ্য বাংলায়: আবদুল। যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইহাদের একেকজনকে জোগাড় করা হয়, তাহার নাম: 'পাবলিক সার্ভিস কমিশন', বাংলায় 'গণসেবা কমিশন'। যাহারা এই প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় পাশ করিয়া গণ কিংবা জনসেবায় নিযুক্ত হইয়া থাকে, তাহারা একেক জন পাবলিক সার্ভেন্ট, বাংলায় বলিলে (গণ)-ভৃত্য বা (গণ)-বুয়া। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন, অবিভক্ত ভারতের সর্বশেষ বড় লাট ইংল্যান্ডের রাণীকে লেখা চিঠিতে স্বাক্ষরের নিচে নিজের পরিচয় দিতেন: 'ইওর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট ক্লার্ক'। বাংলা ভাষায় লিখিলে তিনি লিখিতেন: 'আপনার একান্ত বাধ্যগত শিক্ষিত আবদুল।'
১৯৭৫ সালে প্রদত্ত এক ভাষণে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিবুর রহমান তাহার নিজস্ব ভাষায় পরিষ্কারভাবে ক্লার্কদের স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন যে তাহারা একেক জন সাধারণ জনগণের দাস বা সেবকমাত্র: "আপনি চাকরি করেন, আপনার মায়না দেয় ঐ গরীব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ঐ গরিব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়, আমি গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন। … সরকারি কর্মচারীদের বলবো, মনে রেখো, এ ব্রিটিশ কলোনি নয়, পাকিস্তানি কলোনি নয়।"
রাষ্ট্রপিতার বক্তব্যের সহিত দ্বিমত পোষণের অবকাশ নাই, রাষ্ট্রের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রথমেই পাওয়া উচিত জনগণের, কারণ তাহারাইতো প্রকৃতপক্ষে দেশের রাণী বা রাজা। কিন্তু যে কোনো গণতন্ত্রে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পায় আবদুল অর্থাৎ ভৃত্যেরা, বিশেষ করিয়া অধম (উত্তম-এর বিপরীত) বিশ্বের তথাকথিত গণতন্ত্রে। এই চাকরেরা সর্দিকাশি হইলেই পরদেশে চলিয়া যায় চিকিৎসা লইতে, অবশ্যই আপন গাঁটের অর্থ খরচ করিয়া নহে, মালিক জনগণের অর্থে (যদিও সামর্থ্য ইহাদের যথেষ্টের চেয়ে বেশিই রহিয়াছে। কাহারও কাহারও বিংশতি লক্ষ টংকা দামের হস্তঘড়িই আছে কয়েক ডজন!)। পরের ধনে পোদ্দারি এই সকল ছোটলোকের জন্মগত স্বভাব!
মৃতপ্রায় এই সব জনপ্রতিনিধি কিংবা গণদাস পাবলিকের অর্থে পরদেশে গিয়া চিকিৎসা করাইয়া দেশে প্রত্যাবর্তন করে। ভৃত্যের গাড়ি মার্গ দিয়া চলিবার সময় মালিক পাবলিকের শকট আটকাইয়া রাখা হয়। ভৃত্য দখল করিয়া আছে বলিয়া পাবলিকের নিমিত্ত করোনোকালে চিকিৎসালয়ে শয্যাভাব হইত। বিমানবন্দরসহ সর্বত্র এই ভৃত্যেরাই ভিভিআইপির সম্মান পাইয়া থাকে, মালিক পাবলিক মুখব্যাদান করিয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া হতাশ তাকাইয়া থাকে। অথচ উচ্চ আদালত পর্যন্ত বলিয়াছে, ঠিকই বলিয়াছে, প্রজাতন্ত্রে কোনো ভিআইপি থাকিতেই পারে না, কারণ জনগণের বেতনভূক চাকর-বুয়া কী প্রকারে ভিআইপি হইবে? ভিআইপি বলিয়া যদি কেহ থাকিতেই হয়, তবে ভিআইপি হইবেন সেই সকল সাধারণ জনগণ, প্রধানত কৃষক, যাহারা কোনোক্রমেই রাষ্ট্রের বেতনভোগী নহেন, অথচ ফসল ফলাইয়া যাহারা জনগণের জীবন রক্ষা করিয়া থাকেন।
যাহার শিল যাহার নোড়া, তাহারই ভাঙি দাঁতের গোড়া। জনগণের প্রতি কত অন্যায় যে গণতন্ত্রে হইয়া থাকে, তাহার কোনো ইয়ত্তা নেই। অধম বিশ্বের একেক জন সাংসদ ও মন্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহার দেখিয়া অতীতের উগ্রচণ্ডা মহারাজারাও নিঃসন্দেহে লজ্জা পাইতেন। হে বেতাল! ইহাদিগের ব্যঙ্গচিত্র পর্যন্ত অঙ্কন করা যায় না, ব্যঙ্গ করাতো দূর কী বাত। কোনো প্রভু তিতিবিরক্ত হইয়া মনের ভুলে আবদুলকে 'আবদুইল্যা' বলিয়া সামান্যতম সমালোচনা করিলেও, হেনস্থা, বিনাবিচারে দীর্ঘ কারাবাস অবশ্যম্ভাবী, জীবনান্ত হওয়াও বিচিত্র নয়, ঠিক যেমন রাজতন্ত্রে হইয়া থাকে। বাঙালি কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত গান: 'চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। আজকে যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায়!' ইহারা মাঝেমাঝে শুনিলে পারে।
সমাজের সর্বস্তরে সহনশীলতার অভাব এবং দালাল-নির্ভর সুশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে আবদুলগণের ন্যূনতম সমালোচনা পর্যন্ত করা যায় না। যদি কেহ এমত ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে, অধম বিশ্বের আবদুলেরা অবিলম্বে সেই সমালোচকের উপর খড়গহস্ত হইয়া থাকে। বিপন্ন সমালোচকের পক্ষে সুশীলদের কেহ একটি বাক্য পর্যন্ত ব্যয় করে না। করিবেইবা কী প্রকারে? প্রত্যেকের স্কন্ধে একটি মাত্র মস্তক! সমালোচক যদি শিক্ষক হইয়া থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয় নামক যে প্রতিষ্ঠানটি ঐতিহাসিকভাবে গণতন্ত্রের, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সূতিকাগার, সেই প্রতিষ্ঠানই অগ্রগামী হইয়া সমালোচক শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করে। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকিলে এই প্রসঙ্গে লিখিতেন: 'কার আগে পা কে চাটিয়া দিবে, পড়ি গেল কাড়াকাড়ি!' সুতরাং ভুলেও যেন এই পোড়া দেশে কেহ কোনো আবদুলের সমালোচনা করিতে না যায়, জীবনকালে, কিংবা জীবনান্তে, তাহার নিজের কিংবা সংশ্লিষ্ট আবদুলের।
কোন রইস পরিবারের সদস্য তুমি, তাহা বিচার্য হওয়া উচিত নহে, তুমি আবদুল – ইহাই তোমার মূল পরিচয়। আবদুল মহোদয় ঠিকঠাকমতো তাহার দায়িত্ব পালন করিয়াছিল কিনা, যদি না করিয়া থাকে, তবে প্রভুর মনে ক্ষোভ থাকা কি এতটাই অস্বাভাবিক? আবার ইহাও সত্য যে একজন আবদুলের পক্ষে কোটি কোটি মালিককে সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট করাও সম্ভব নহে। যাহাই হউক, কপালের ফেরে মালিক হইয়া যাহারা জন্মাইয়াছে, মনের দুঃখ তাহাদিগকে মনেই চাপিয়া রাখিতে হইবে। ইহাও তাহাদিগকে মনে রাখিতে হইবে যে দুঃখ প্রকাশ করিবার শুভদিন কখনও তাহাদিগের জীবনে আসিবে না, কারণ আবদুল কিংবা জরিনাকে বিদায় করিবার পর যে খাম্বা বারেক কিংবা ফালুদা বুয়া চাকুরিতে বহাল হইবেন, তাহারাও এমন কিছু সুশীল ছিলেন না, ভবিষ্যতেও যে হইবেন, তেমন সম্ভাবনা নাই।
অন্যায় যখন দীর্ঘদিন ধরিয়া চলে, যাহাদিগের প্রতি অন্যায় হয় এবং অন্যায় যাহারা করে, উভয়ে অন্যায়কে অমোঘ নিয়ম বলিয়া মানিয়া লয়। অসহায় মালিক মনে মনে ভৃত্যদিগকে অভিসম্পাত করে বটে, কিন্তু বাংলা প্রবাদ আছে, 'শকুনের শাপে গরু মরে না!' পাবলিক অবশ্যই শকুন হইবেক, কারণ অখাদ্য-কুখাদ্য তাহারা খাইয়া থাকে এবং সহজে মরে না। ভৃত্যেরা প্রকৃতই গরু, কারণ মনুষ্যই যদি তাহারা হইবেক, তবে কী কারণে তাহাদিগের সুযোগ্য নেতৃত্ব ও পরিচালনায় দেশের অবস্থার পরিবর্তন হয় না?
নির্বাচনের পূর্বে দাসপদপ্রার্থীরা জনগণের নিকট মৌখিক ও লিখিত আর্জি জানায়: 'জনসেবার সুযোগ দানে আমাকে বাধিত করুন!' জনগণ দাসগণকে বারংবার বিশ্বাস করিয়া বারংবার প্রতারিত হয়। আলাওল 'পদ্মাবতী' কাব্যে লিখিয়াছিলেন: 'প্রতি বার প্রসবেতে জীবন-সংশয়। তবু নারী বার বার গর্ভবতী হয়!' নির্বাচিত হইবার অব্যবহিত পরেই ভৃত্যের 'সেবায় আঁশ' মিটিয়া যায় জনতার, এমন 'সে বাঁশ'।
তবুও লোকে বলিয়া থাকে, রাজতন্ত্র হইতে গণতন্ত্র শ্রেয়। রাজতন্ত্র বস্তুটি অতীতে আমরা দেখিয়াছি, বর্তমানেও দেশে কিংবা বিদেশে দেখিতেছি। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র কি কদাপি আমরা দেখিয়াছি? গণতন্ত্র একটি 'সোনার হরিণ' এবং বেচারা জনগণ রামায়ণের নায়িকা সীতার ন্যায় লক্ষণরেখায় চিরঅবরুদ্ধ। এই শাসনব্যবস্থাটি কেমন হইতে পারে, কল্পনা করা অসম্ভব নহে বটে, কিন্তু বাস্তবে ইহার প্রয়োগ খুব কমই হইতে দেখা যায়। 'গণতন্ত্র' নামে যে শাসনব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রচলিত আছে, অন্ততপক্ষে তৃতীয় বা 'অধম বিশ্ব' দক্ষিণ এশিয়ায়, উহা আসলে নির্দিষ্ট সময় পর পর নবায়নযোগ্য (ভাগ্য প্রসন্ন হইলে) গোষ্ঠীতন্ত্র, এবং (ভাগ্য মন্দ হইল) ডান্ডাতন্ত্র বা গুণ্ডাতন্ত্র।
যে শাসনব্যবস্থা লোকে কদাপি বাস্তবায়িত হইতে দেখে নাই, সেটি ভালো কি মন্দ, বলি কী করিয়া? তাছাড়া 'গণতন্ত্র' শব্দটির অর্থ কী, তাহা বড় কথা নহে, 'গণতন্ত্র' নামক রাষ্ট্রপরিচালনা ব্যবস্থা কী প্রকারে বাস্তবায়িত হয়, তাহাই ধর্তব্য। শব্দের অর্থ নয়, ব্যবহারই আসল। 'ফলনা একটি গাধা' বাক্যে 'গাধা' কোনো প্রাণী নয়। একই ভাবে ধর্ম, গ্রন্থ, সংবিধান, আইনে কী লেখা রহিয়াছে, তাহা বড় কথা নহে, কী প্রকারে তাহার প্রয়োগ হইতেছে তাহাই মূল কথা। 'আমাদের গ্রন্থে এই লেখা আছে, সেই লেখা আছে', বলা বৃথা। বাস্তবে সেই ধর্মাবলম্বীরা কী করিতেছে, তাহাই ধর্তব্য, কারণ গ্রন্থ কেহ পড়ে না, পড়িলেও ভাষিক মূর্খতার কারণে খুব বেশি লোকে পড়িয়া বুঝিতে পারে না, কিংবা বুঝিতে চাহেও না, পাছে বুঝিতে পারিয়া অবিশ্বাসের পাপ জমা হয় মনে!
হিন্দুধর্মে ভিন্ন জাতকে ঘৃণা করার উপদেশ নাই গীতায়। অথচ এই পাপ হাজার বছর ধরিয়া হিন্দু সমাজে সগৌরবে বিরাজ করিতেছে। গোমূত্র অবশ্যপানীয় বলা হয় নাই কোথাও, কিন্তু গরুর মুত্রদ্বার হইতে সরাসরি গ্লাসে ধারণ করিয়া গলাধঃকরণ করিতেছে বহু শিক্ষিত ব্যক্তি, পাছে পাত্রান্তর হলে পূণ্যান্তর হইয়া যায়! ইসলাম ধর্মে কোনো পদ পাইবার জন্যে বংশ, বর্ণ, সামাজিক অবস্থান শর্ত হইতে পারে না। কিন্তু আরব দেশের ইতিহাসে কোনো নির্বাচিত খলিফা কিংবা বাদশা হাবশি ছিলেন কি? বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র নিষিদ্ধ ইসলামে। কিন্তু উমাইয়া, আব্বাসীয় যুগে এবং আজকের আরব অঞ্চলে আমরা কী দেখিতে পাই? মার্কিন সংবিধানে বলা হইয়াছে, সকল মানুষ সমান। অথচ আড়াইশ বছর পরেও কৃষ্ণকায়গণকে চিৎকার করিয়া বলিতে হয়: 'আমার শ্বাসকষ্ট হইতেছে!' ইহার অর্থ, গোয়ালে যে কয়টি গোধন আছে, সে কটিই কাজীর প্রকৃত গোধন, কাগজে কয়টি গোধনের কথা উল্লেখিত রহিয়াছে, তাহা জানিয়া আদৌ কোনো লাভ লাভ নাই। সুতরাং গ্রন্থ কিংবা সংবিধান নহে, ধর্মাবলম্বী কিংবা নাগরিকগণের আচরণ, প্রয়োগ কিংবা ব্যবহারই হইতেছে আসল ধর্ম, আসল রাষ্ট্র।
'জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস!' – যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে এই বাণী লিখিত থাকে বটে, কিন্তু কাজে-কর্মে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, বিশেষত অধম বিশ্বে জনগণ পশুরও অধম, বলির একমাত্র পণ্ঠক। গণতন্ত্র একটি ট্র্যাজিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যাহাতে হতভাগ্য নায়ক হইতেছে 'জনগণ', যাহার নামে, যাহার প্রতি, সমস্ত অন্যায় করা হয় এবং তাহারা টু শব্দটিও করিতে পারে না, শব্দ করাটাকে উচিত বলিয়াও মনে করে না। গণতন্ত্রে 'শক্তি মরে ভীতির কবলে', যেমনটা লিখিয়াছিলেন বাঙালি কবি কামিনী রায়, 'পাছে লোকে কিছু বলে' কবিতায়।
শিশির ভট্টাচার্য্য রচিত 'যাত্রাপালা চন্দ্রগুপ্ত' নাটকে চাণক্যের এই সংলাপটি স্মর্তব্য: "গণতন্ত্র এমন এক অদ্ভূত রাষ্ট্রব্যবস্থা যাহাতে কিংমেকারের গুরুত্ব কিছুমাত্র নাই, সকল গুরুত্ব কিং এর। যিনি বা যাহারা প্রতিনিধি নির্বাচন করেন, নির্বাচনের পরে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্যে গুরুত্বের ব্যারোমিটারে সেই নির্বাচক ভোটারের অবস্থান শূন্যের বহু নিচে নামিয়া যায়। পক্ষান্তরে যিনি নির্বাচিত হন, তাহার অবস্থান ব্যারোমিটারের সর্বোচ্চ দাগটিকেও ছাড়াইয়া যায়। এই শাসন-ব্যবস্থায় সাধারণ জনগণ ভোট দিয়া মরণশীল সামান্যকে অসামান্যে পরিণত করিয়া দিয়া নিজে কার্যত অসহায়, অকিঞ্চিৎকর, অতি সামান্যে পরিণত হয়। ইহাই 'গণতন্ত্র' নামক শাসন ব্যবস্থার অন্যতম ট্র্যাজেডি।"
হে বেতাল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতার বক্তৃতা হইতে উদ্ধৃতি দিয়া আমার বক্তব্য শেষ করিতে চাহি: "যে লোককে দেখবা তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতে, ওরাই সম্মান বেশি পাবে। … তাদের আপনি কাজ করবেন, সেবা করবেন। তাদের আপনি কী দিয়েছেন, কতটুকু দিয়েছেন, কী ফেরৎ দিচ্ছেন, কতটুকু দিচ্ছেন? কার টাকায় ইঞ্জিনিয়ার সাব, কার টাকায় ডাক্তার সাব, কার টাকায় অফিসার সাব, কার টাকায় রাজনীতিবিদ সাব, কার টাকায় মেম্বার সাব, কার টাকায় সব সাব? সমাজ যেন ঘূণে ধরে গেছে। এ সমাজকে আমি চরম আঘাত করতে চাই। এমন আঘাত করতে চাই, যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের – সেই আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থাকে।"
বেতাল জ্ঞাপপাপী, তুমি নিশ্চয়ই জানো যে আঘাত করিতে তিনি সক্ষম হন নাই। এই বক্তব্য প্রদানের কিছুকাল পরেই কিছু সংখ্যক দুর্বিনীত দাস বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতাকে সপরিবারে হত্যা করিয়াছিল। বাংলাদেশের মালিক জনগণের দুর্বিসহ জীবন সুসহ হইবার যে ক্ষীণ সম্ভাবনাটুকু ছিল তাহাও অচিরে বিদূরিত হইয়াছিল, একাধিক দশক, কিংবা কে বলিতে পারে, কপাল মন্দ হইলে, কয়েক শতকের জন্য।
হে বেতাল, কোনো কারণে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের দাসেরা বিস্মৃত হয় যে তাহারা দাস। তাহারা ইহাও বিস্মৃত হয় যে কাহারা তাহাদিগের প্রভু। এই বিস্মৃতির কারণে দাসগণ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া গিয়া রাষ্টের ক্ষতি করে এবং ক্ষতি করে নিজেদিগেরও, কারণ বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন: 'তুমি যারে নিচে ফেলো সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে। পশ্চাতে ফেলিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে!' দুবির্নীত দাসের কারণে অসহায় প্রভুর জীবন দুর্বিসহ হইয়া ওঠা – ইহাই অন্ততপক্ষে অধম বিশ্বে গণতন্ত্রের মূল সমস্যা।
[বেতালের প্রশ্নের সবিস্তার উত্তর দিতে দিতে রাজা বিক্রমাদিত্য সন্ন্যাসীর যজ্ঞক্ষেত্রের নিকটবর্তী হইতেছিলেন। হঠাৎ স্কন্ধ নির্ভার বোধ হইল, হস্ত সঞ্চালন করিয়া স্কন্ধোপরি বেতালের নিতম্ব এবং বক্ষোপরি তাহার পদযুগল আর অনুভূত হইল না। আশ্চর্য হইয়া পশ্চাতে ফিরিয়া রাজা দেখিলেন, শবদেহ পুনরায় ন্যগ্রোধবৃক্ষের সর্বোচ্চ শাখা হইতে লম্বমান হইয়াছে। বিক্রমাদিত্য পুনরায় দ্রুত বৃক্ষের দিকে ধাবমান হইলেন, কারণ রাত্রি গভীর হইতেছিল এবং শবদেহ না লইয়া তাহার ফিরিবার উপায় ছিল না।]