“সিনেমাকে মতাদর্শের জন্য এত বড় অস্ত্র করে তুলতে আগে দেখা যায়নি। এই চলচ্চিত্রগুলো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে আমরা যা জানি, তাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়।”
Published : 05 May 2024, 02:09 AM
“সমগ্র কাশ্মির ভারতের অংশ ছিল, আছে এবং থাকবে”: বলিউডের সাম্প্রতিক আলোচিত একটি চলচ্চিত্রে অভিনেতা কিরণ কর্মকারের সংলাপ এটি। ২০১৯ সালে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলে ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বানানো হয়েছে সিনেমাটি।
চলচ্চিত্রটির নাম ‘আর্টিকেল ৩৭০’। পরিপাটি সাদা কুর্তা পরিহিত বলিষ্ঠ গড়নের কিরণ কর্মকার এ সিনেমায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই কাশ্মিরকে নিজেদের এলাকা দাবি করে। এর মধ্যে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল দেশটির সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে। সে কারণেই এ সিনেমার নাম রাখা হয়েছে ‘আর্টিকেল ৩৭০’।
কিরণ কর্মকার অভিনীত দৃশ্যটি একটি বাস্তব ঘটনার চিত্রায়ণ। লোকসভায় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অমিত শাহ যে বক্তব্য দেন, চলচ্চিত্রে কিরণের মুখে সেই সংলাপই উঠে এসেছে।
বিবিসির সাংবাদি জোয়া মতিন ও মেরিল সেবাস্টিয়ান এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে সিনেমাটি যখন মুক্তি পায়, সমালোচকদের অনেকে একে ‘ছদ্মবেশী প্রচারণা’ আখ্যা দেন। তাদের ভাষ্য, সরকারের অনেক প্রশ্নবিদ্ধ পদপেক্ষকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এ সিনেমায়।
তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংসহ বিজেপির শীর্ষ নেতারা এ চলচ্চিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
আনুমানিক ২০ কোটি রুপি খরচ করে নির্মিত চলচ্চিত্রটি শেষপর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১০১ কোটি রুপি আয় করেছে।
বিবিসির লিখেছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন, তখন থেকেই সরকারি নীতির কথা বলে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে চলচ্চিত্র বানানো শুরু হয়। তবে গত চার বছরে এরকম কয়েকটি চলচ্চিত্র সরকারপন্থি প্রপাগান্ডার স্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের নির্বাচন শেষ হওয়ার পরপরই মুক্তি দেওয়া হয় মোদীর বায়োপিক।
পাঁচ বছর পর দেশটিতে আরেকটি নির্বাচনের আগে এমন একগুচ্ছ চলচ্চিত্র মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বা হয়েছে, যার সবই বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী আর্দশকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে দুটি সিনেমার কথা বলা যায়, ‘অ্যাকসিডেন্ট অর কন্সরিরেসি: গোধরা’ এবং ‘দ্য সবরমতি রিপোর্ট ‘। দুটিই ২০০২ সালে গুজরাটে ঘটে যাওয়া মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার ঘটনা নিয়ে তৈরি করা।
আর ‘বীর সাভাকার’ বিংশ শতাব্দীর বিতর্কিত এক হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতার বায়োপিক। সেখানে একটি সংলাপ রয়েছে এরকম– স্বাধীনতার নেতৃত্ব মহাত্মা গান্ধীর হাতে না থাকলে ভারত আরো অনেক আগেই ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হত।
চলচ্চিত্র সমালোচকরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে এমন কিছু সিনেমা মুক্তি দেওয়া হচ্ছে, যা চলচ্চিত্রে একটি নতুন ধারার জন্ম দিচ্ছে, যেখানে শাসক দলের (বিজেপি) আদর্শই প্রতিফলিত হচ্ছে।
সব সিনেমাই যে বক্স অফিসে সাফল্য পাচ্ছে, তেমন না হলেও মূল ঘটনা আড়াল করে ভুয়া গল্পে নির্মিত সিনেমা সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণা পাল্টে দিতে ভূমিকা রাখতে পারে বলে সমালোচকরা মনে করছেন।
নিউজ পোর্টাল স্ক্রলের চলচ্চিত্র সমালোচক নন্দিনী রামনাথ বলেন, “সিনেমাকে মতাদর্শের জন্য এত বড় অস্ত্র করে তুলতে আগে দেখা যায়নি। ঐতিহাসিক ব্যক্তি বা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে আমরা যা জানি, তাকে এই চলচ্চিত্রগুলো চ্যালেঞ্জ করতে চায়। তারা একটি নতুন ‘বিকল্প-ইতিহাস’ তৈরি করতে চায়।”
বিবিসির প্রতিবেদনের বলা হয়, এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারা বলিউডের ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে বলিউড এমন এক জায়গা, যা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজন মুছে সবাইকে এক করতে পারে। তবে এখন তাকে একমুখী শক্তিতে রূপান্তরের চেষ্টা করা হচ্ছে।
অবশ্য এসব প্রকল্পের পেছনের নির্মাতারা অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করেছেন।
‘দ্য কেরালা স্টোরির পরিচালক সুদীপ্ত সেন বলেছেন, “আমার চলচ্চিত্রগুলো রাজনৈতিক নয়, সেগুলো মানবিকতার ভিত্তিতে তৈরি।”
তার দাবি, ২০২৩ সালে নির্মিত তার ওই সিনেমায় হিন্দু ও খ্রিস্টান নারীদের ইসলাম গ্রহণ করতে এবং ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দিতে নানা প্রলোভন দেখানোর বিষয়ে ‘সত্য গল্প’ বলা হয়েছে।
সুদীপ্ত সেনের ভাষ্য, তার দৃষ্টিভঙ্গি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিফলন নয়। তার চলচ্চিত্রে ‘সত্যের প্রকাশ’ ঘটায় তিনি অনেকের বিরাগভাজন হয়েছেন।
তবে সিনেমাটি যখন মুক্তি পায়, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সিনেমায় একটি ঘোষণা যুক্ত করতে নির্মাতাদের নির্দেশ দেয়, যেখানে বলা থাকবে সিনেমাটি কাল্পনিক ঘটনাবলির ওপর নির্মিত। ৩২ হাজার মানুষের ধর্মান্তরের যে তথ্য সিনেমায় দেওয়া হয়েছে, তার সমর্থনে ‘কোনো প্রমাণ নেই’– এ কথাও সেখানে থাকতে হবে।
বিবিসি লিখেছে, বলিউডে জাতীয়তাবাদের আছর এবং তার ওপর ভিত্তি করে তৈর সিনেমা তৈরির ঘটনা এই প্রথম নয়। উগ্র দেশপ্রেম, শত্রু বিনাশে উন্মত্ত দেশভক্তদের নিয়ে সিনেমা আগেও হয়েছে ভারতে।
সাধারণত এসব সিনেমায় খলনায়কদের একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে নায়কদের লড়াইয়ের নাটকীয় ঘটনাবলির চিত্রায়ণ করা হয়। অত্যাচারী, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক নায়কদের বীরত্বের চিত্রায়ণ হয় এসব সিনেমায়।
ভারতীয়রাও সামরিক বিজয়ের ওপর ভিত্তি করে অতিকল্পিত সিনেমা দেখতে পছন্দ করে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ‘শত্রু’ হিসেবে দেখানো হয়। এ ধরনের চলচ্চিত্রের সঙ্গে বাস্তব জীবনের মিল থাকে না অনেক ক্ষেত্রেই।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক রুচিকা শর্মা বিবিসিকে বলেন, “বলিউডে নির্মিত এসব সিনেমায় সবসময় সত্য ঘটনা উঠে আসে না, প্রকৃতপক্ষে তা প্রায় কখনোই হয়ে ওঠে না। নিখুঁত কিংবদন্তি তৈরি করতে গল্প বলার সব স্বাধীনতা ভোগ করে এ ইন্ডাস্ট্রি।
“কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখন ইতিহাসের সমান্তরালে তাদের নিজস্ব সংস্করণের ইতিহাস নিয়ে আসছেন, যা সত্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একে ইতিহাসের ধারারই ধ্বংস বলতে হয়।”
রুচিকা বলেন, এসব সিনেমায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে এমন সব কাল্পানিক চরিত্র তৈরি করা হচ্ছে, যা সিনেমাগুলোকে বিপজ্জনকভাবে সাম্প্রদায়িক করে তুলেছে।
‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’ সিনেমাটির কঠোর সমালোচক করেছেন রুচিকা শর্মা। ১২ শতকের এক হিন্দু রাজাকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র এটি। আফগানিস্তান থেকে আসা মোহাম্মদ ঘুরির সঙ্গে যুদ্ধে ওই রাজার নিহত হওয়ার গল্প বলা হয়েছে সিনেমায়।
রুচিকা শর্মা বলেন, “এ সিনেমায় মোহাম্মদ ঘুরিকে মুসলমান আগ্রাসনকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এটি পুরোপুরি আড়ম্বরপূর্ণ গল্প এবং ইতিহাসসিদ্ধ নয়। কারণ সংস্কৃত গ্রন্থগুলোতে তাকে ধর্মের ভিত্তিতে রূপায়িত করা হয়নি।
"ভারতের ইতিহাসের প্রতিটি শতাব্দী আমাদের ‘গেম অফ থ্রোনস’-এর মত মহাকাব্যিক নাটকের পটভূমি দিতে পারে। তবুও আমরা আজও হিন্দু-মুসলমান বিভাজনে আটকে থাকতে চাই।"
পৃথ্বীরাজ ভালো করতে না পারলেও বক্স-অফিস রেকর্ড বলছে, ধর্মীয় বিভাজনের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো প্রায়ই ভালো ব্যবসা করে।
ওরম্যাক্স মিডিয়ার প্রধান শৈলেশ কাপুর বলেন, “ধর্মের রাজনীতি সিনেমায় জনরাজনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী রূপ হয়ে উঠেছে।”
তিনি বলেন, ছোট বাজেটে তৈরি ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’ এবং ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ যখন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি আয় করেছে, তখনই বিষয়টি আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে।
১৯৯০-এর দশকে কাশ্মিরে সশস্ত্র লড়াইয়ের কারণে বহু হিন্দুর সেখান থেকে উচ্ছেদ হওয়ার ঘটনাকে ‘সত্য গল্প’ হিসেবে চিত্রায়ণের চেষ্টা করা হয়েছে ‘কাশ্মির ফাইলস’-এ।
বিবিসির লিখেছে, ‘আর্টিকেল ৩৭০’ এর মত ‘কাশ্মির ফাইলস’ সিনেমাটিকেও ভারতের বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্যে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে, দলটির নেতারা এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
সমালোচনাদের দৃষ্টিতে, এসব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিভাজনের রাজনীতি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা বলছেন, সরকারি নথিতে যেখানে কাশ্মিরে ২০০ জন হিন্দু পন্ডিত নিহত হওয়ার তথ্য মেলে, সেখানে কাশ্মির ফাইলস-এ সংখ্যাটি বলা হয়েছে ৪ হাজার।
শৈলেশ কাপুর বলেন, বিতর্কের পরও এসব চলচ্চিত্র অনেক নতুন দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছে। এ দর্শকরা এসব নতুন সিনেমার জন্য বক্স-অফিসে নতুন সম্ভাবনাও তৈরি করছে।
অন্যদিকে ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে–এমন সিনেমার সংখ্যা দিন দিন কমছে।
নেটফ্লিক্স সম্প্রতি নির্মাতা দিবাকর ব্যানার্জির ‘টিস’ সিনেমাটি মুক্তি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দিবাকর বলছেন, অ্যামাজন সিরিজ ‘তাণ্ডব’ যেভাবে বিজেপির আক্রমণের শিকার হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই নেটফ্লিক্স তার সিনেমা আটকে দিয়েছে। তাণ্ডবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেখানে হিন্দু দেবতাদের অবমাননা করা হয়েছে।
বিবিসি লিখেছে, ‘টিস’ মুক্তি না দেওয়ার বিষয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়নি নেটফ্লিক্স। তবে বিবিসিতে এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, "আমাদের কাছে ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টিভি সিরিজগুলোর অবিশ্বাস্য ভাণ্ডার রয়েছে। এসব সিনেমা সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে আমাদের দীর্ঘস্থায়ী সমর্থনেরই প্রকাশ।”
রামনাথ বলেন, নতুন এসব সিনেমার কোনো কোনোটি তাদের উদ্দেশ্য পূরণে সফল হয়, কারণ থ্রিলারের মত করে তৈরি এসব চলচ্চিত্র দাবি করে যে, তারা কিছু ‘ঐতিহাসিক ভুল’ প্রকাশের সাহস দেখাচ্ছে, যা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নির্মাতারা উপেক্ষা করে গেছেন।
শৈলেশ কাপুরও তার সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা যখন জনপ্রিয় রাজনৈতিক ভাবনাকে পুঁজি করে কাজ করেন, তখন তার ওই ফর্মুলা কতটা কাজ করবে, তারও একটি সীমা থাকে।
তবে নতুন ধারার এসব সিনেমা মানুষের মনে কতটা স্থায়ী প্রভাব রেখে যাচ্ছে, তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চলচ্চিত্র সমালোচকরা।