আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিরোধী দল না থাকলেও প্রথম সংসদের প্রথম বৈঠকে সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার আগেই সাংবিধানিক ইস্যুতে বিতর্ক হয়েছিল। যে বিতর্কের সূচনা করেছিলেন জাতীয় লীগ থেকে নির্বাচিত একমাত্র সংসদ সদস্য (ঢাকা-১৯) আতাউর রহমান খান।
Published : 10 Jun 2024, 02:40 PM
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম সংসদের স্থায়িত্বকাল ছিল দুই বছরেরও কম সময়। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক এক মাসের মাথায় ৭ এপ্রিল প্রথম সংসদের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় সংসদ কার্যত অকার্যকর হয় পড়ে। ফলে সেখানে সংসদীয় বিতর্ক বলে কিছু ছিল না। যদিও প্রথম সংসদের প্রথম দিনেই বেশ বিতর্ক হয়।
প্রসঙ্গত, প্রথম সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। কেননা ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টিতেই জয় পায় আওয়ামী লীগ। এর বাইরে জাসদ ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১টি এবং ৫টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান।
বিরোধী দল না থাকার বিষয়ে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে খসড়া সংবিধান অনুমোদন উপলক্ষে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলের নাম শুনতে পাই। দেশে এরকম কোনো পার্টি আছে কি না জানি না। নির্বাচনের আগে এরকম কোনো পার্টি ছিল না। অনেকেই ভোট না পেয়ে পশ্চাদপসরণ করেছিল। ভবিষ্যৎ নির্বাচনে যদি তারা ভোট না পায় সে দোষ আমাদের হবে না। ভোট পেয়ে পরিষদে এসে বলুন, আমরা বিরোধী দল। যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ভোট পায়নি তারা বলে আমরা বিরোধী দল। ভবিষ্যতে ভোট নিয়ে এসে তারপর বলুক আমরা বিরোধী দল। তা হলে বলুক, এই এই আমাদের দাবি।’ (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রাসঙ্গিক তথ্য, সংঘ প্রকাশন/ ২০০১, পৃষ্ঠা ১৬৬)।
পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর কথাই সঠিক প্রমাণিত হয় যে, প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কোনো দল এককভাবে দশটি আসনও পায়নি যাদেরকে বিরোধী দল বলা যাবে। তখন অবশ্য ওই অবস্থা ছিলও না। কেননা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে তখন আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং বঙ্গবন্ধুও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। যদিও এই জনপ্রিয়তার ভেতরেও প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন শতভাগ বিতর্কমুক্ত ছিল না।
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্টারিয়ান মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘এটা সত্য যে, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করতো। আওয়ামী লীগ বিঘ্ন সৃষ্টি না করলে যে ৯টিতে বিরোধী দল জয়লাভ করেছিলো তার সাথে আর বড়জোর ২০টি আসন যোগ হতে পারতো। সংসদের ৩১৫টি (সংরক্ষিত ১৫টিসহ) আসনের মধ্যে ৯টির পরিবর্তে ৩০টি আসনে বিরোধী দল জয়লাভ করলে সরকার ও আওয়ামী লীগের বিশেষ কোনো ক্ষতি হতো না। এরপরেও সবগুলো আসনে জয়লাভের জন্য তারা যেভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো, তার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। (মওদুদ আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ইউপিএল/১৯৮৩, পৃ. ১৮২)।
আরেক বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘পার্লামেন্টারি পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন মানে বিরোধী দলের যথেষ্ট সংখ্যক ভালো মানুষ নির্বাচিত হবেন, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। কাজেই নির্বাচনে (১৯৭৩) সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিরোধী দলের প্রতি উদার হওয়া উচিত ছিল। উদার হইতে তারা রাজিও ছিলেন। রেডিও টেলিভিশনে বিরোধী দলসমূহের নেতাদের বক্তৃতার ব্যবস্থা করিতেও তাদের আপত্তি ছিল না। আমি আওয়ামী নেতৃত্বকে পরামর্শ দিয়াছিলাম বিরোধী পক্ষের অন্তত জনপঞ্চাশেক নেতৃস্থানীয় প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়লাভ করিতে দেওয়া উচিত। তাতে পার্লামেন্টে একটি সুবিবেচক গণতন্ত্রমনা গঠনমুখী অপজিশন দল গড়িয়া উঠিবে। আমার পরামর্শে কেউ কান দিলেন না।’ (আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাব মহল/১৯৯৫, পৃ. ৬২৬)।
প্রথম বৈঠকেই উত্তাপ
আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিরোধী দল না থাকলেও প্রথম সংসদের প্রথম বৈঠকে সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার আগেই সাংবিধানিক ইস্যুতে বিতর্ক হয়েছিল। যে বিতর্কের সূচনা করেছিলেন জাতীয় লীগ থেকে নির্বাচিত একমাত্র সংসদ সদস্য (ঢাকা-১৯) আতাউর রহমান খান। তিনি পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতার বিধান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার আগে সাংবিধানিক এই বিষয়ে আলোচনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নুরুল হক। নোয়াখালী-৭ আসনের এই সংসদ সদস্য পয়েন্ট অব অর্ডারে স্পিকারের উদ্দেশে বলেন, ‘মাননীয় সদস্য শপথ গ্রহণের পূর্বে আলোচনা করে চলেছেন। এইরকম অবস্থায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করা যায় কি না, সেদিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
আতাউর রহমান খান আবারও ফ্লোর নিয়ে তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এরপর এ বিষয়ে কথা বলতে দাঁড়ান আরেক সংসদ সদস্য তাহের উদ্দিন ঠাকুর। স্পিকারের রুলিং দাবি করে তিনি বলেন, ‘এই সভা পার্লামেন্টের সভা এবং জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে এই মুহূর্তে আমাদের শপথ গ্রহণ করা কর্তব্য এবং কোনো বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন না করে সংসদ সদস্য হিসাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া দরকার।’
তখন স্পিকার মুহম্মদুল্লাহ বলেন, ‘আমারও মনে হচ্ছে যে শপথ গ্রহণের পূর্বে সংসদ পূর্ণাঙ্গ হচ্ছে না। কাজেই শপথ গ্রহণ আগে অনুষ্ঠিত হোক। তারপর মাননীয় সদস্য জনাব আতাউর রহমান খান সাহেব তাঁর বৈধতার প্রশ্ন লিখিতভাবে দিলে পরে পরবর্তী কোনো সময় তার আলোচনা হবে।’ স্পিকারের বক্তব্যের পর ওই মুহূর্তে এই বিতর্ক থেমে যায়। তখন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন নতুন নির্বাচিতরা।
সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার পর ভিন্ন এক বিষয়ে বিতর্ক তোলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম-১ থেকে নির্বাচিত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, সর্বসাধারণ্যে তিনি এম এন লারমা নামে পরিচিত। স্মরণ করা যেতে পারে, গণপরিষদে সংবিধান বিতর্কেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। এমনকি বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলে পরিচিত হবেন— সংবিধানে এরকম একটি বিধান যুক্ত করার প্রতিবাদে তিনি গণপরিষদ থেকে ওয়াকআউটও করেছিলেন।
এম এন লারমা বলেন, ‘বৈঠকের শুরুতে শুধু কোরআন ও গীতা পাঠ করা হয়েছে। দেশে শুধু হিন্দু বা মুসলমান নয়—বৌদ্ধ, খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরাও আছেন। ত্রিপিটক এবং বাইবেল থেকেও পাঠের প্রয়োজন আছে।’ এ সময় সংসদ সদস্য নুরুল হক দাঁড়িয়ে বলেন, ‘জনাব স্পিকার সাহেব, মিস্টার লারমা জৈন ধর্ম সম্বন্ধে কিছুই বলেন নাই।’
এরপর আবারও আগের বিতর্ক অর্থাৎ বৈধতার প্রশ্নটি নিয়ে কথা বলেন আতাউর রহমান খান। তখন তৎকালীন আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ফ্লোর নিয়ে আগে নতুন সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং সভাপতিমণ্ডলী নির্বাচনের আহ্বান জানান। এ নিয়েও আতাউর রহমান খানের সঙ্গে আইনমন্ত্রীর বাহাস হয়। পরে পাঁচ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলী মনোনয়ন দেওয়া হয়। আর স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদে মনোনয়ন জমা দিতে আধা ঘণ্টার জন্য বৈঠক মুলতবি করা হয়।
এদিন বেলা সাড়ে ১২টায় স্পিকার মুহম্মদুল্লাহর সভাপতিত্বে আবার বৈঠক শুরু হয়। এই পর্বে নতুন নির্বাচিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘এই সংসদের মর্যাদা যাতে রক্ষা পায়, সেদিকে আপনি (স্পিকার) খেয়াল রাখবেন। কারণ আমরা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি, সে ইতিহাসে যেন খুঁত না থাকে। দুনিয়ার পার্লামেন্টারি কনভেনশনে যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো আমরা মেনে চলতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে যেন এমন একটি পার্লামেন্টারি প্রসিডিউর ফলো করতে পারি, যাতে দুনিয়া আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।’
সংসদে আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য দলের অবস্থান সেভাবে ছিল না— সে প্রসঙ্গও আসে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে। স্পিকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনাকে এক দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দুঃখের বিষয়, অন্য কোনো দল অ্যাসেম্বলিতে আসতে পারেনি। সেজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু জোর করে জনসাধারণকে বলতে পারি না, ভোট দাও। অন্য দল ভোট না পেলে আমার কিছু বলার নেই। আপনি প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত স্পিকার।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ‘এখানে কোনো দল বা মতের নয়, এখানে এই দেখব যে, প্রত্যেক সদস্য যেন যাঁর যে অধিকার আছে, সে অধিকার ব্যবহার করতে পারেন। সেদিকে আপনিও খেয়াল রাখবেন বলে আমি আশা পোষণ করি। এ সম্পর্কে আপনি আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। পার্লামেন্টারি ট্র্যাডিশন পুরোপুরিভাবে ফলপ্রসূ করতে আমরা চেষ্টা করব।’
প্রথম বৈঠকের শেষ পর্যায়ে আতাউর রহমান খান পুনরায় রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনার বিষয়ে প্রশ্ন তুললে সংসদে দীর্ঘ বিতর্ক হয়। তবে সেই বিতর্কের নিষ্পত্তি না করেই স্পিকার পরবর্তী কার্যক্রমে চলে যান।
বিতর্ক ছাড়াই জরুরি অবস্থার বিল পাশ
প্রথম সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন যে উত্তাপ ছিল, পরবর্তীতে সেই উত্তাপ কমে আসে। বিশেষ করে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় এবং সরকারি দলের এমপিদের ঘাড়ের ওপর সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের খড়্গ ঝুলে থাকায় গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলো কোনো কার্যকর আলোচনা ও বিতর্ক ছাড়াই পাশ হয়ে যায়।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত সংবিধানে উল্লিখিত আদর্শ বিসর্জন দিয়ে এর এক বছরের মধ্যেই ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী এনে নিবর্তনমূলক আটকাদেশে সঙ্গে জরুরি অবস্থা জারির বিধান সংযোজন করা হয়। সংসদে বিরোধী দলের অবস্থান নগণ্য থাকায় খুব অল্প সময়ে উল্লেখযোগ্য বিতর্ক ছাড়াই সংশোধনী বিলটি পাশ হয়ে যায়। আতাউর রহমান খানসহ অন্যান্য বিরোধী নেতারা জনমত যাচাইয়ের জন্য এই বিল জনসমক্ষে উপস্থাপিত করার দাবি জানালেও সেই দাবি কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর অবশ্য যুক্তি দেখান যে, যেকোনো জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানেই এই বিষয় দুটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সংবিধান প্রণয়নের সময় এই বিধানগুলো সংযোজন করা হয়নি বিধায় এখন সংশোধনী এনে সেই ভুল শোধরানো হচ্ছে।
আতাউর রহমান খান এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে ক্ষমতাসীন সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, গত ২৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ এ ধরনের আইনের বিরোধিতা করে আসছে। কারণ এগুলো সবসময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশেও এই আইন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহার করা হবে।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগের জবাব দিতে কেউ উৎসাহ দেখাননি। বিশেষ করে কী ধরনের গোলযোগ পরিস্থিতিতে জরুরি আইন প্রয়োগ করা যাবে কিংবা জরুরি অবস্থার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার কেন স্থগিত রাখা হবে, সে ব্যাপারে আইনমন্ত্রীও সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
অবশেষে বাকশাল
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দুর্ভিক্ষ এবং তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্ত। এরকম পরিস্থিতিতে একটি নতুন ধরনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু এগোতে থাকেন— তিনি যেটিকে বলতেন দ্বিতীয় বিপ্লব। ওই বিপ্লব কায়েমের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে পাশ হয় সংবিধানের বহুল আলোচিত চতুর্থ সংশোধনী বিল। যে সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়।
চতুর্থ সংশোধনী পাশের সময় বিরোধী সদস্যরা কোনোপ্রকার আলোচনার সুযোগ পাননি এবং তারা অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট করেন। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বিলটি উত্থাপন করেন। আব্দুস সাত্তার বিলের বিরোধিতা করে এর ওপর আলোচনার দাবি জানান এবং সংশোধনী প্রস্তাব দেয়ার কথা বলেন। তিনি এ ধরনের বিলের আগে ৭ দিন বা ৩ দিনের নোটিশ প্রদানের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। জাতীয় সংসদের স্পিকার বিলটির তৃতীয় পাঠের সময় আলোচনার সুযোগ হবে মর্মে জানান। যদিও পরে বিলটি তিন মিনিটের ভেতর ২৯৪-০ ভোটে পাস হয়ে যায়। (কাজী জাহেদ ইকবাল, বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনী ১৯৭২-১৯৯৮ প্রেক্ষাপট ও পর্যালোচনা, ধ্রুবপদ/২০১৬, পৃ. ৬৫)।
এই বিল পাস হওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থার এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন সাধিত হয়। একদিকে যেমন একদলীয় শাসন প্রচলন করা হয়, একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ওপর নির্বাহী (প্রশাসন), আইন ও বিচার বিভাগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্পিত হয়। বিল পাসের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন আইনবলে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে সীমাহীন একক ক্ষমতা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি সংসদ কিংবা কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে গুরুতর অসদাচরণের জন্য অপসারণ করতে সংসদের তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থনের বিধান রাখা হয়। (ড. সুলতান মাহমুদ, বাংলাদেশ সংবিধান প্রেক্ষিত এবং প্রাসঙ্গিকতা, আলেয়া বুক ডিপো/২০২১, পৃ. ৯১)।
এটি হলো মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠ হলো ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ যে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন, তাকেই ১৯৭৫ সালে একটা নতুন বিপ্লবের সূচনার জন্য সংবিধানে এই যে বিরাট পরিবর্তন আনতে হয়, তার পেছনে ছিল ওই সময়ের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। এই সংশোধনীটি আনা হয় একটি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত ও নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু করার জন্য। যে কারণে বদলানো হয় দেশের রাজনৈতিক দলের কাঠামো, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পদ্ধতি, রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনিক পদ্ধতি। সর্বোপরি নেয়া হয় একটি সম্পূর্ণ নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচি। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু তার সারা জীবনের যে রাজনীতি, অর্থাৎ মানুষের মুক্তি, সেই মুক্তির জন্য তিনি প্রথা ভাঙেন।
মওদুদ আহমদ লিখছেন, চতুর্থ সংশোধনী নিয়ে সংসদে ওই অর্থে কোনো আলোচনা না হলেও দলের ভেতরে এই ইস্যুতে দ্বিভাবিভক্তি ছিল। তারপরও ‘শেখ মুজিবের তেজোদীপ্ত ভাবগম্ভীরতা ও ব্যক্তিত্বের কাছে নিজেদের সত্তা বিসর্জন দেয়া ছাড়া অন্যান্যদের কোনো গত্যন্তর ছিল না। চাটুকার নেতৃবৃন্দ পরিবেষ্টিত অবস্থায় শেখ মুজিবের সর্বশক্তিমত্তা ছিল বৈঠকের মূল কেন্দ্রবিন্দু। যদিও এম এ জি ওসমানি ও মইনুল হোসেনের মতো নেতারা সরকারের রাজনৈতিক ভূমিকার সাথে একাত্মতা ঘোষণা না করে দল থেকে পদত্যাগ করেন।’ (মওদুদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১৪)।