সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল বা কোটা সংস্কারের মতো আপাত নিরীহ একটি আন্দোলন কেন এমন সরকারবিরোধী প্রবল আন্দোলনে রূপ নিল? কেন শিক্ষার্থীরা মারমুখী হয়ে উঠল? কেন সবখানে হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়ল? ক্ষমতাসীনদের অদূরদর্শিতা ও হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
Published : 18 Jul 2024, 05:55 PM
চারদিকে বারুদের গন্ধ। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝালো ধোঁয়া। লাশের সারি। প্রতিবাদী শিক্ষার্থীর রক্তে রঞ্জিত রাজপথ। মিছিলে-স্লোগানে আকাশ প্রকম্পিত। ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ায় চারদিকে সন্ত্রস্ত। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে চরম অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিভিন্ন স্থানে লাখ লাখ শিক্ষার্থী রীতিমতো বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল বা সংস্কারের দাবিতে তাদের আন্দোলন শুরু হলেও এখন তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পরিণত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও আক্রমণাত্মক ভূমিকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সরকার প্রথমে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তাতে শিক্ষার্থীদের নিরস্ত করা সম্ভব হয়নি। বরং ক্ষোভের আগুন রাজধানী থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা রাজপথ-রেলপথ অবরোধ করে। বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টার্গেট করে আক্রমণ পরিচালিত হতে থাকে। পুলিশ ফাঁড়ি, থানা এমনকি বিভিন্ন স্থাপনাও ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার মতো সংবেদনশীল স্থানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের সমর্থনে সাধারণ মানুষও প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সামিল হয়। সরকার পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি বিজিবি নামিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না।
প্রশ্ন হলো, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল বা কোটা সংস্কারের মতো আপাত নিরীহ একটি আন্দোলন কেন এমন সরকারবিরোধী প্রবল আন্দোলনে রূপ নিল? কেন শিক্ষার্থীরা মারমুখী হয়ে উঠল? কেন সবখানে হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়ল? ক্ষমতাসীনদের অদূরদর্শিতা ও হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির দাবি-দাওয়া ও ক্ষোভের ব্যাপারে সরকারের এক ধরনের উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্য রয়েছে। এই মনোভাবের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার অহমিকা ও কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে বিরোধী দলসমূহের ব্যর্থতা। উপেক্ষা দেখিয়ে কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে অতীতের সব আন্দোলনকে দমন করার ‘সাফল্য’ থেকে সরকার এমনটা করতে উৎসাহী হয়েছে নিঃসন্দেহে।
অথচ কোটা সংস্কার বা কোটা বাতিল আন্দোলনটা ছিল নিতান্তই সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী একটা ছোট গ্রুপের আন্দোলন। এটা কখনোই জাতীয় কোনো ইস্যু বা গণদাবি হিসেবে গণ্য হওয়ার মতো কিছু নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশে ৭ কোটির বেশি মানুষ চাকরি এবং কর্মমুখী নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা মাত্র সাড়ে ১৫ লাখ, যা মোট কর্মক্ষম মানুষের ১ শতাংশের মতো। এই অল্প কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ সরকারের ভুল নীতি ও কৌশলের কারণে দাবানলে পরিণত হয়েছে, হয়ে গেছে জাতীয় ইস্যু।
সরকার প্রথমেই যদি আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতো তাহলে আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। সরকার বলতে পারত, আমরা তোমাদের দাবির প্রতি একাত্ম। তোমাদের দাবি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে আমরা উচ্চ আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করব। রায় প্রত্যাশা মতো না হলে নির্বাহী আদেশে কিংবা সংসদে আইন পাস করে কোটাব্যবস্থা যৌক্তিক পর্যায়ে পুনর্নির্ধারণ করব। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও এমন কথা বলতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন, তোমাদের হয়ে আমি আইনি লড়াই করব। না পারলে গদি ছেড়ে দেব। কিন্তু তেমন কোনো কথা ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে শোনা যায়নি। বরং নানাভাবে আন্দোলনকারীদের ‘উদ্দেশ্য’ ও ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। আন্দোলনকারীদের ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ ‘রাজাকার’, ‘শিবির’, ‘বিএনপি’ ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করা হয়েছে।
এর ফল হয়েছে বুমেরাং। যারা কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াই কেবল চাকরি পাবার জন্য কোটাব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলনে নেমেছিল, তারা আহত হয়ে ‘রাজাকার’ পরিচয়কেই অলঙ্কার বানানোর পথে হেঁটেছেন! কোটাবিরোধী আন্দোলনে যে নানা ধান্দার মানুষজন আসছে, সেটা সত্য। এই ধান্দাবাজদের ভিড়ে আন্দোলনকে ঠিক পথে পরিচালনা করার মতো দূরদর্শিতা আন্দোলনকারীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
সরকার সবচেয়ে বড় ভুল করেছে আন্দোলন দমনে শক্তি প্রয়োগের কৌশল গ্রহণ করায়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র-যুব সংগঠন কোনো রকম রাখঢাক ছাড়াই আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয়েছে। ছাত্রীদেরও নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। কোথাও কোথাও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালিয়েছে। বর্তমানের এই শক্তিশালী প্রযুক্তির যুগে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের এই হিংস্রতার ছবি ও ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের এই দস্যুতার বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ হয়েছেন। এর ফল হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের হিংসার শিকার হয়েছেন। কিন্তু তারা তেমন কারও সহানুভূতি পাননি।
এমনকি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাঠে নামানো হয়েছে, তাদের হাতেই খুন হয়েছে শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে রংপুরে আবু সাঈদ নামে যে শিক্ষার্থীকে পুলিশ একেবারে সামনাসামনি টার্গেট করে গুলি করেছে, ওই ঘটনা জনবিক্ষোভকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একজন সাহসী শিক্ষার্থীকে এভাবে টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা যারাই দেখেছে, তারাই শিউরে উঠেছে! পুলিশের এ কোন বর্বর আচরণ? ওই প্রতিবাদী ছেলেটিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারত। ছত্রভঙ্গের জন্য টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করতে পারত। তা না করে সরাসরি গুলি করেছে। তাও একটি নয়, পর পর তিনটি। এই দৃশ্যটি শুধু শিক্ষার্থী নয়, সারাদেশের মানুষকে পুলিশের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। ফলে পুলিশ এবং সরকারি দলের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের হিংসার শিকার হয়েছেন।
রাজধানীসহ সারাদেশের আজ যে চিত্র, তাতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এমনকি সেনাবাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে মনে হয় না। সবখানে ক্ষোভের আগুন দাউ দাউ জ্বলছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। কয়েকজন পুলিশেরও হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংলাপে বসার প্রস্তাব দিয়েছে। এর জবাবে আন্দোলনকারীরা তাৎক্ষণিকভাবে বলেছেন, পুলিশ ও সরকারি দলের সদস্যদের হাতে নিহতরা যদি জীবিত হন, তাহলেই কেবল আলেচনায় বসা হবে! এটা যে আন্দোলনকারীদের তীব্র ক্ষোভের কথা, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাদের ক্ষোভকে অন্যায্য বলা যাবে না।
শুধু কোটা নিয়ে কথা বললেই যে সমস্যাটি মিটে যেত, বাস্তব কারণে এখন তা অনেক জটিল আকার ধারণ করেছে। এখন নিহতদের ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন আসবে। যাদের হাতে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা নিহত হয়েছেন, তাদের বিচারের প্রশ্ন আসবে। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের দস্যুতার বিচারের প্রশ্ন আসবে। মামলা প্রত্যাহার, আহতদের চিকিৎসার বিষয় আসবে। ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন অপরিণামদর্শী ও উস্কানিমূলক বক্তব্য ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন আসবে। সবচেয়ে বড় কথা, সহপাঠীর লাশ ও রক্তের তাজা স্মৃতি যাদের অন্তরে, ওই বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের এখন শান্ত করবে কে?
তারপরও সব রকম রাগ-ক্ষোভ-অহমিকা-ইগো ঝেড়ে ফেলে সংলাপের পথেই এগোতে হবে। একটা সমাধানসূত্রে উপনীত হতে হবে। গত কয়েক দিনে কোটা-আন্দোলন নিয়ে দেশের সীমাহীন ক্ষতি হয়ে গেছে। অকারণে ঝরে গেছে অনেকগুলো তাজা প্রাণ। নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশা ও নির্যাতন ভোগ করেছে আন্দোলনকারীরা। এই ক্ষতি ও ক্ষত কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, এখন সম্মিলিতভাবে ওই চেষ্টা করতে হবে। সব রকম সংকীর্ণতা, ইগো বিসর্জন দিয়ে সরকারকে যেমন সহনশীল ও নমনীয় হতে হবে, আন্দোলনকারীদেরও এই অচলাবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য ইতিবাচক হতে হবে। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যে ক্ষতি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে অপূরণীয়, অমোচনীয়। কিন্তু কোথাও কোথাও গিয়ে তো শেষ করতে হবে। তা না হলে লাশের সংখ্যা বাড়বে বৈ কমবে না। সেটা হবে পুরো জাতির জন্যই আরও বেশি হৃদয়বিদারক!
কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শাসকদের শিক্ষা নিতে হবে। ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনায় আরও বেশি দায়িত্বশীলতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় দিতে হবে।