যৌথ নদী কমিশনের পাঁচটি দায়িত্বের অন্যতম হচ্ছে বন্যার পূর্বাভাস সঠিকভাবে দেওয়া। ভারত ও বাংলাদেশের ৫৪টি যৌথ নদীর পানি ও বন্যার তথ্যবিনিময় সঠিকভাবে করা গেলে এবং বন্যার পূর্বাভাস মানুষের বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করা গেলে এত বড় বিপর্যয় হতো না।
Published : 24 Aug 2024, 07:20 PM
ঘরে-ঘরে পানি-বন্দি হয়ে আছে অসহায় মানুষ, গবাদি-পশুসহ অন্যান্য প্রাণী, বানের জলে ভেসে যাচ্ছে কত কত প্রাণ! স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যা, চারদিকে অসহায় মানুষের হাহাকার। বন্যা আক্রান্ত ১১ জেলার মধ্যে সবেচয়ে নাজুক পরিস্থিতি ফেনীতে। অধিকাংশ এলাকায় ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। উদ্ধার কাজ করা যাচ্ছে না। স্রোতের তীব্রতা অনেক। অনেক জায়গায় হেলিকপ্টার ছাড়া উদ্ধার কাজ সম্ভব নয়। স্থানীয়রা বলছেন, বানের পানি কমতে শুরু করলেও ত্রাণ বিতরণের চেয়ে মানুষকে উদ্ধার করা বেশি জরুরি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে। বর্ষা মৌসুমের শেষ সময়ে এসে বাংলাদেশ যে আরেক দফা বন্যার কবলে পড়তে পারে, অগাস্টে বন্যা ভয়াবহ বন্যা আসতে পারে, সেটি গত মে মাসে পূর্বাভাসেই তা জানা গিয়েছিল। জুলাইয়ের শুরুতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতির নির্দেশও ছিল।
মুহুরী নদীর বানে ফেনী জেলা যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, ইতিহাসে তার নজির নেই। সম্পদ যা গেছে, তা গেছে; এ জেলার চার উপজেলার চার লাখ মানুষ এখন প্রাণ বাঁচানো নিয়েই শঙ্কায়। ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। বেশিরভাগ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এখন একটু একটু করে মোবাইল সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে। তবে এখনও ফোনেও যোগাযোগ করতে না পেরে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় আছেন অন্য জেলায় থাকা স্বজনরা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে। বন্যা আক্রান্ত সব জেলায় রাতদিন আতঙ্ক, মানুষের আর্তি আর বন্যার প্রবল বিধ্বংসী রূপ, প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে সামান্য কয়েকটি কাপড়চোপড় সম্বল করে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হচ্ছেন অসহায় মানুষ। বন্যা ও বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, মাথায় গাছ পড়ে এবং পানিতে তলিয়ে মানুষ মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনী অংশের কিছু স্থানে প্রায় কোমড় সমান পানি উঠে গেছে। মৌলভীবাজারের মনু, কুশিয়ারা, জুড়ি ও ধলাইসহ সবকটি নদনদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকারের বক্তব্য পড়লাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে। তিনি জানিয়েছেন, সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে যে লঘুচাপ তৈরি হয়েছে, সেটি গত তিন থেকে চার দিন বাংলাদেশের উপরে ছিল। এখনো কিছুটা বিরাজ করছে।
“গত কয়েক বছর ধরে লঘুচাপ সাধারণত বাংলাদেশের উপর দিয়ে যায় না; আরও নিচ দিয়ে যায়। এবার বাংলাদেশের উপর দিয়ে যাচ্ছে এবং মৌসুমী বায়ুর অক্ষ বাংলাদেশের উপর থাকছে, যার ফলে এমন বৃষ্টিপাত হচ্ছে। লঘুচাপটা এমন এক জায়গায় বসে আছে, যার ফলে সাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প আসছে চট্টগ্রাম দিয়ে। সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বাতাসও আসছে। যতক্ষণ পর্যন্ত লঘুচাপটি দুর্বল না হবে ততক্ষণ বৃষ্টি হতে থাকবে।”
বাংলাদেশের মতো ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরাতেও বেশি বৃষ্টি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এর প্রভাব বাংলাদেশে এসে পড়ছে। পানি যাবার মূল জায়গাটা তো বাংলাদেশ। প্রচণ্ড বেগে এই পানি আসছে, যা সামনে পাচ্ছে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মত অবস্থা হচ্ছে।”
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাসফিকুস সালেহীনের অভিমতও, দুই তিন দিনের ভারী বৃষ্টির কারণেই এ ভয়াবহ বন্যা তৈরি হয়েছে।
বন্যার কারণ যাই হোক, প্রকৃতপক্ষে এবারের আকস্মিক বন্যায় আক্রান্ত ১১ জেলায় কত মানুষ যে মারা গেছে, তা নিয়ে এখনই বলার সুযোগ নেই। বানের পানি এক সময় চলে যাবে, তখন হয়তো মৃত্যু নিয়ে যথাযথ তথ্য জানা যাবে। তবে এই বন্যা কত মানুষকে জীবন্মৃত করে রেখে যাবে তা বলা মুশকিল। যার ঘর ভেঙেছে, মরেছে গবাদিপশু, বানের তোড়ে ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, বিনষ্ট হয়েছে মাঠের ফসল, তার তো বেঁচে থাকার অবলম্বন শেষ হয়ে গেছে। মানুষের নিজের জীবন বাঁচানো যখন কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে বন্যার্তদের পক্ষে আর কিছু ভাবাও কঠিন।
বাঁধ নিয়ে বিতর্ক, মিটিং, মিছিল
বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েকদিন যাবৎ বিক্ষোভ হচ্ছে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। বন্যা নিয়ে গত বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছে এক দল শিক্ষার্থী, যারা এই দুর্যোগের জন্য ভারতকে দায়ী করেছে। আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে।
বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে ভারতের ত্রিপুরায় ডুম্বুর নামে একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে এবং একেই এই বন্যার জন্য দায়ী করে বক্তব্য রেখেছেন দুই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
আসিফ মাহমুদ তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, “নোটিশ ছাড়াই ওয়াটার গেইট খুলে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণের কাছে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে।“
নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “কোনো ধরনের আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে এ যে বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে; এটির মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সাথে অসহযোগিতা করছে।” এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উজানে ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়াকে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির কারণ হিসাবে বর্ণনা করে বাংলাদেশে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে, তা আমরা দেখেছি। এটা তথ্যগতভাবে সঠিক নয়।” বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতে গোমতী নদীর সংলগ্ন এলাকায় গত কয়েকদিনে চলতি বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাঁধের ভাটি এলাকার পানির কারণে বাংলাদেশের বন্যা হয়েছে।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলসহ ১৩টি জেলায় আকস্মিক বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। ত্রিপুরার ডুম্বুর হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট (ডুম্বুর গেট) খুলে দিয়েছে ভারত সরকার। এর প্রভাবে বাংলাদেশ অংশে দ্রুতগতিতে পানি বাড়ছে। একাধিক বিদেশি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যায় সেখানে বুধবার পর্যন্ত সাতজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে প্রশাসন। এমন পরিস্থিতিতে খুলে দেওয়া হয়েছে ত্রিপুরার 'ডুম্বুর গেট'।
গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। বন্যার মত দুর্যোগ মোকাবিলায় ভারতের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের একটি সহযোগিতার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি চান, জরুরি অবস্থায় এই সহযোগিতা কার্যকর হবে।
এই সাক্ষাৎটি এমন সময় হয়েছে যখন দেশের উত্তর-পূর্বে সিলেট অঞ্চল, পূর্বাঞ্চলে বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং দক্ষিণ পূর্বে খাগড়াছড়ি বন্যায় ডুবে আছে। বৃষ্টির পাশাপাশি উজানে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে শোচনীয় অবস্থা তৈরি হয়েছে ফেনীতে, যে জেলায় কখনো এমন বন্যার ইতিহাস নেই। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদেরকে ব্রিফ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি জানান, ভারতীয় দূতকে ড. ইউনূস পানির তথ্য বিনিময়ে নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতার কথা বলেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রণয় ভার্মার বৈঠকেও বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ভারতীয় দূতের ভাষ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “ত্রিপুরায় বৃষ্টি হচ্ছে, সেটার কথা হয়েছে। বাঁধের কথা এসেছে, বলেছেন যে অটোমেটিক রিলিজটা হয়েছে। এত পানির উচ্চতা, এত পানি, ফলে এটা থেকে অটোমেটিক রিলিজটা হয়েছে।” প্রেস সচিবের ভাষ্য, ইউনূসকে ভারতের দূত বলেছেন, “ত্রিপুরায় যে বন্যা হচ্ছে সেটাও নজিরবিহীন। সেখানেও ৫০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।”
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌথ নদী কমিশনের পাঁচটি দায়িত্বের অন্যতম হচ্ছে বন্যার পূর্বাভাস সঠিকভাবে দেওয়া। ভারত ও বাংলাদেশের ৫৪টি যৌথ নদীর পানি ও বন্যার তথ্যবিনিময় সঠিকভাবে করা গেলে এবং বন্যার পূর্বাভাস মানুষের বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করা গেলে এত বড় বিপর্যয় হতো না। উজান থেকে আসা পানির ঢল সম্পর্কে ভারতের কাছ থেকে আমাদের সঠিক তথ্য পাওয়া যেমন দরকার, তেমনি ওই ঢল আসার পর তা নামার পথও মুক্ত রাখতে হবে। এ জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত যৌথ নদী কমিশন ও নদী রক্ষা কমিশন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে।
নদী ও পানিবিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত একটি জাতীয় দৈনিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বাংলাদেশের বন্যা ও আবহাওয়া পূর্বাভাস–ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। যে ধরনের পূর্বাভাস আমরা যেভাবে দিই, তাতে চলমান বন্যার মতো ভয়াবহ দুর্যোগের বিষয়টি আগাম বোঝা যায় না। আর ভারতের কাছ থেকে আমরা গঙ্গা ও তিস্তার পানিপ্রবাহের তথ্য যত বিস্তারিত পাই, গোমতী ও মুহুরীর মতো অন্য নদীগুলোর ঢল বা পানিপ্রবাহের তথ্য সেভাবে পাই না।” তিনি আরও বলেন, “এই বন্যার একটি কারণ হিসেবে ভারতের ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পানি বেড়ে গেলে গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওই স্লুইসগেট স্বয়ংক্রিয়ভাবেই খুলে যায়। পানি কমলে তা আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়।”
দেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরকার উদয় রায়হানের বরাতে জানা যায়, ভারত থেকে বড় ও আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা থাকলে তা বিশেষভাবে জানানোর চর্চা দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের রয়েছে। মুহুরী নদীর উজানে ভারতীয় নদী বিলুনিয়াতে গত তিন দিনে সর্বকালের রেকর্ডভাঙা বৃষ্টি হয়েছে। পানির উচ্চতা দ্রুত বেড়েছে; কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কোনো বিশেষ সতর্কবার্তা বাংলাদেশকে দেওয়া হয়নি।
বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকার কথা ছিল, অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারে উজান ও ভাটির দেশের মধ্যে যে ধরনের যৌক্তিক, মানবিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা থাকার কথা ছিল, তা অনুপস্থিত। কোনো একটি দেশ চাইলেই বন্যা সৃষ্টি করে তার প্রতিবেশী দেশকে ডুবিয়ে মারতে পারে না। উজানের দেশ এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে না, যাতে ভাটির দেশের মানুষেরা শুকনো মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার করবে, আর বর্ষায় সেই পানিতেই তলিয়ে যাবে। উজানের দেশ ভারতকে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, এবং ভাটির দেশের মানুষের অর্থনীতি ও জীবন-জীবিকার ব্যাপারে সংবেদনশীল হতে হবে। অভিন্ন নদী ও পানিকে রাজনীতির হাতিয়ার বানানো যাবে না।
বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে, বুঝে নিতে হবে আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা। সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য ভারতকে যেমন বাংলাদেশের প্রয়োজন, তেমনি বাংলাদেশকেও ভারতের প্রয়োজন। সেটা শুধু নদীর পানি বণ্টন কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাই নয়, বরং সব ক্ষেত্রেই।
নদীতে বাঁধ নির্মাণ কতটা ক্ষতিকারক
এবারের প্রলয়ঙ্করী বন্যা একটা বিষয়কে আমাদের সকলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, নদী শাসন করতে গিয়ে নদীতে বাঁধ নির্মাণ কতটা বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে। আমরা জানি, এই উপমহাদেশে ১৯৫০–র দশকে বন্যার প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় নদীগুলো ‘বাঁধবন্দি’ করা শুরু হয়েছিল। এর ফলে যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের যে সংস্কৃতি ছিল, তা আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ে, হারিয়ে যেতে থাকে প্লাবনভূমির চরিত্র। উপনিবেশ–পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাঁধ বন্যা নিয়ন্ত্রণের বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে। বড় নদীগুলোকে কবজায় আনার জন্য মানুষ বিভিন্ন পন্থা (বাঁধ নির্মাণ তার একটি) অবলম্বন করে, বিশেষ করে নদীর উৎসস্থলে বা ভারতের বিভিন্ন অংশে— যার অনেক কিছুই অস্পষ্ট বা জানানো হয় না। মানুষ নদীকে বশ করতে গিয়ে নিজের এবং অন্যান্য প্রাণ-প্রকৃতির জন্য বিপদ ডেকে আনছে। আমরা জানি, গঙ্গায় ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ, যার প্রভাবে ভারতের অনেক স্থানে বন্যা এখন নিয়মিত ঘটনা। বাংলাদেশেও এই ব্যারাজের বিভিন্ন প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ ও ত্রিপুরায় চলতি অগাস্টের বন্যা দক্ষিণ এশিয়ায় ড্যামকেন্দ্রিক বিপদের দিকটা আবারও বেশ মোটাদাগে সামনে আনল।
বাংলাদেশ থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে ভারতে গঙ্গা নদীতে বহুল আলোচিত বিতর্কিত ফারাক্কা ব্যারেজ চালুর পর এটি গত চার দশকে গঙ্গা অববাহিকায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। শুরু থেকেই ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের নদী বিশেষজ্ঞরা। ফারাক্কার প্রভাবে নদীর স্বাভাবিকতা হারিয়ে গঙ্গার উজানে বিহার ও উত্তর প্রদেশ এবং ভাটিতে সুন্দরবন পর্যন্ত পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গার উজানে বিপুল পরিমাণ পলি জমে প্রতিবছর বন্যা দেখা দিচ্ছে ভারতের বিহারসহ উত্তর প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। অন্যদিকে গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি আটকে রাখার ফলে নদীর স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ক্ষতির শিকার হয়েছে ভাটি অঞ্চলে বাংলাদেশ, শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে হাজার হাজার কৃষক পরিণত হয়েছে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে।
যেসব নদী একাধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সেই নদীতে উজান কিংবা ভাটি— কোনো দেশের সরকারই উভয় দেশের সম্মতি ছাড়া নিজের ইচ্ছামতো বাঁধ তৈরি করতে পারে না। এক্ষেত্রে উভয় দেশের মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় রাখতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা বরাবরই অনুপস্থিত। বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নীতিতে ভারত বরাবরই নিজের স্বার্থে যতটা সোচ্চার থেকেছে, বাংলাদেশের স্বার্থ সেভাবে দেখেনি। অথচ আন্তর্জাতিক বা অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের নিয়মই হচ্ছে পারস্পরিক সমঝোতা এবং পানির ন্যায্য বণ্টন ও অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা।
বাঁধ নির্মাণ বিষয়ক এক রিসার্চ থেকে আমরা জানি, “অবকাঠামো হিসেবে ড্যাম কেবল নদীপ্রবাহেরই সর্বনাশ করছে না, ভূমিকম্পপ্রবণ আসাম-বাংলা ভাটি-অঞ্চলকে চিরস্থায়ী এক বিপদের মুখেও রেখে দিয়েছে। এছাড়া এরকম অবকাঠামোর নীরব প্রতিক্রিয়া হিসেবে নদী-অববাহিকার নানান স্থানে নিরন্তর ভাঙ্গন চলছে।” এখন সময় এসেছে এই ব্যাপারে আমাদের সোচ্চার হওয়ার। অভিন্ন নদীতে ভারত যেসব বাঁধ দিয়েছে সেগুলো নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করা এখন সময়ের দাবি। কেননা অভিন্ন নদীতে কোনো একটি দেশের একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নাই।
উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে অন্তরায়
দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সবসময় বাংলাদেশের মানুষ দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এই সময়ে সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার চিত্র আমরা দেখতে পাই দেশজুড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি ছাত্র-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন বন্যা দুর্গত অঞ্চলে। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের বড় একটি শক্তি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে কিছু কিছু অন্তরায় এবং সমন্বয়হীনতা আমরা দেখতে পাই। এমন অনেকেই বন্যা দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন যাদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও উদ্ধার কাজে অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে, সেইসঙ্গে নিজেদের এবং অন্যদের মৃত্যু ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন।
যারা উদ্ধার কাজে অভিজ্ঞ, স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতা নিয়ে তাদেরই উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া উচিত, অনভিজ্ঞরা সহযোগী হিসেবে থাকতে পারেন। ভয়াবহ বন্যার কবলে থাকা ফেনীতে উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ডের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীরাও পৌঁছেছেন। তবে, সেখানে বড় রকমের সমন্বয়ের অভাব দেখা দিয়েছে, যার কারণে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার কার্যক্রম।
ফেনী থেকে মেজর শুভম আফ্রিদি জানান, সব ধরনের প্রস্তুতি থাকলেও 'সমন্বয়ের অভাবে' উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, “বেশকিছু জায়গায় এখনো উদ্ধার কাজের জন্য পৌঁছানো যায়নি, ত্রাণও পৌঁছেনি। আমরা যেখানে যেটা দরকার সেটা করার চেষ্টা করছি। যেখানে ত্রাণ দরকার সেখানে ত্রাণ দিচ্ছি, যেখান থেকে মানুষকে উদ্ধার করা দরকার সেখান থেকে উদ্ধার করছি।” তিনি আরও বলেন, “এখানে সমন্বয়ের একটি বড় গ্যাপ তৈরি হয়েছে। ঢাকা বা দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে যারা উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য এসেছেন তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। যারা বাইরে থেকে এসেছেন তারা একটা পরিকল্পনামাফিক কাজের চেষ্টা করছেন, আর স্থানীয়রা তাদের আপন মানুষদের জন্য কাজ করতে চাচ্ছেন। এর ফলে যাদের সাহায্য পাওয়া জরুরি তারা পাচ্ছেন না।”
বন্যা-পরবর্তী আসন্ন সংকট
বন্যার পরে যারা বেঁচে থাকবেন, তাঁরা বেঁচে থাকবেন জীবন্মৃত হয়ে। বন্যায় বিপদসীমার ওপরে ওঠা পানি যখন আস্তে আস্তে নেমে আসবে ঠিক তখনই আসল যুদ্ধ শুরু হবে। সাধারণত বন্যার চাইতেও কঠিন হয়ে থাকে বন্যা পরবর্তী সময় মোকাবিলা করা। সে সময় বর্তমান সময়ের মতো সহযোগিতা করার মত এত মানুষও পাশে থাকবে না। তখন সামাল দিতে হবে নিজেদের, মোকাবিলা করতে হবে বন্যা পরবর্তী সময়ের কঠিন পরিস্থিতিকে।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ভেসে উঠবে ক্ষতচিহ্ন। ভাঙা ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র অনেকের ভেসে গেলেও, অধিকাংশ ভিজে নষ্ট হয়ে যাবে। স্থানে স্থানে সড়ক ভেঙে তৈরি হবে শতশত ক্ষতচিহ্ন। যানবাহন চলাচলেরও অনুপযোগী হয়ে পড়বে অনেক সড়ক। এছাড়া বন্যাপরবর্তী মানুষের স্বাস্থ্যসেবার ঝুঁকি অনেক বেশি। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি দেখা দেবে খাদ্য আর খাবার পানির সংকট। অনেক বিদ্যালয় পাঠদানের অযোগ্য হয়ে পড়বে। অনেক শিক্ষার্থীর বই-পত্র বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে যাবে। পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবও দেখা দেবে। অনেকে আবার গোখাদ্য নিয়ে বিপাকে পড়বেন। সব মিলিয়ে বন্যাকবলিত এলাকায় একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করবে।
বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ যেন স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে পায় তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য তাদের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে। ডায়রিয়া-আমাশয়ের মতো রোগ থেকে রক্ষা পেতে স্যালাইন ও অন্যান্য ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া পানিবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। সরকারকে অবশ্যই সদিচ্ছা নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
আরও পড়ুন:
অর্ধকোটি বানভাসি, প্রাণ গেছে ১৮ জনের
অগাস্টের বন্যার এমন ভয়াল রূপ কেন?
বন্যা: ১০ জেলায় কোথায় কেমন ক্ষতি
বন্যা মোকাবিলা: ভারতের সঙ্গে 'উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা' চান ইউনূস
বাঁধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে বন্যার কথা 'সঠিক নয়': ভারত
বন্যা মোকাবিলা: ভারতের সঙ্গে 'উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা' চান ইউনূস
বন্যা আসছে জেনে কী করেছে বাংলাদেশ?
উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা হোক অগ্রাধিকার
লক্ষ্মীপুরের মেঘনা পাড়ে ১ লাখ মানুষ পানিবন্দি, জ্বলছে না চুলা