লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, “জেলায় জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন প্রায় ৬ লাখ মানুষ।”
Published : 23 Aug 2024, 11:26 PM
ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল আর ভারী বর্ষণে লক্ষ্মীপুর জেলার অনেক এলাকাতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন জেলার মেঘনা পাড়ের কমলনগর ও রামগতি উপজেলার পূর্বাঞ্চল।
সেখানে লক্ষাধিক মানুষ ১০-১২ দিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। পাশের নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলা চরমটুয়া ও আন্ডারচর ইউনিয়নের বাসিন্দারাও জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন।
কমলনগর ও রামগতি উপজেলার বাসিন্দারা জানান, পানির কারণে তাদের বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। রান্না করার চুলার পানির নিচে। তাদের অনেক কষ্ট করে খাবার সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কেউ কেউ শুকনা খাবার খেয়ে দিন পার করছেন।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, “জেলায় জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন প্রায় ৬ লাখ মানুষ। বুধবার থেকে শুকনো খাবার বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া আমাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী ১৮৯টি সাইক্লোন শেল্টারগুলোও প্রস্তুত রয়েছে।”
জলাবদ্ধতার জন্য খালগুলো অবৈধভাবে দখল হওয়াকে দায়ী করে তিনি বলেন, “খালগুলোতে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে দখল করে রেখেছে প্রভাবশালীরা। এতে পানি নামতে পারছে না। জনগণ আমাদেরকে এ ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে। প্রশাসনের উপস্থিতি ও জনগণের সহযোগিতায় অবৈধ বাঁধগুলো কেটে দেওয়া হচ্ছে।”
শুক্রবার লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের চরঠিকা গ্রাম (স্মার্ট ভিলেজ), রামগতি উপজেলার চরবাদাম ও চরপোড়া গাছা ইউনিয়ন ঘুরে পানিবন্দি মানুষের দুর্দশার চিত্র দেখা যায়।
কমলনগরের চরকাদিরা ইউনিয়নের ভুলুয়া নদী পানিতে থইথই করছে। যদিও শুষ্ক মৌসুমে এ নদীতে পানি খুব বেশি একটা দেখা যায় না। বৃষ্টির পানি জমে ভুলয়া এখন উপচে পড়ছে। আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাও ডুবে আছে বৃষ্টির পানিতে।
অধিকাংশ বাড়িতেই হাঁটু পানি। অনেক বাড়িতে কোমর পানিও দেখা গেছে। সেখানকার মানুষ উঁচু এলাকায় আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে কেউই সাইক্লোন শেল্টার বা আশ্রয়ণ কেন্দ্রে যাননি।
রামগতির চরবাদাম ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ এলাকার পূর্বপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। যতদূর দেখা যায়, পানি আর পানি। কবরস্থান ডুবে আছে। সেখানে প্রায় সাত ফুট পানি রয়েছে।
প্রত্যেকটি ঘরের ভেতর চার থেকে পাঁচ ফুট পানি। এই অবস্থায় ঘরছাড়া হয়েছে কয়েকশ পরিবার। এরমধ্যে এক বৃদ্ধকে দেখা গেছে, গরুর জন্য কলার ভেলা ভাসিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িবাঁধ এলাকায় খড় নিয়ে আসতে। পানিবন্দি এসব এলাকায় সাপের ভয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের চরপোড়াগাছা গ্রামের শেখের কিল্লা এলাকায় গিয়ে শতাধিক বাড়িতে হাঁটু পানি দেখা যায়। এর মধ্যে আবদুল মজিদ ড্রাইভারের বাড়ি কোমর সমান পানিতে ডুবে আছে।
ওই বাড়ির বাসিন্দা ঝর্ণা বেগম বলেন, “একমাস আগ থেকে প্রায় প্রতিদিন চরপোড়াগাছায় বৃষ্টি শুরু হয়। এতে ২২ দিন ধরে তাদের বাড়ির উঠানসহ আশপাশের এলাকায় পানি জমতে শুরু করে। গত পাঁচ দিনের টানা বৃষ্টিতে বাড়ির সামনেসহ আশপাশে কোমর পর্যন্ত পানি জমে আছে। একটুও পানি নামছে না। বাড়িতে হাঁটু পানি।
“আমাদের ঘরে আরও পাঁচটি পরিবারকে আশ্রয় দিতে হয়েছে। গত কয়েকদিন ইট বসিয়ে রান্না করতে হয়েছে। এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না। পানির কারণে আগুন জ্বলছে না। আমদের কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি।”
ওই বাড়ির আরেক বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, “২২ দিন ধরে আমরা খুব কষ্টে আছি। চারপাশে পানি থাকায় বাড়ি থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। বাচ্চাদেরকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে।”
এলাকার শাহজাহান, ফারুক, কুলসুমা বেগম, ইমরান হোসেনসহ কয়েকজন এই অবস্থার জন্য ভুলুয়া নদী দখল আর অবৈধ বাঁধকে দায়ী করেছেন।
তারা জানান, নদীতে স্রোত নেই তাই পানি যেতে পারছে না। ফলে আশপাশের গ্রামগুলো ডুবে গেছে। এখানে জলাবদ্ধতার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে ভুলুয়া নদী। কয়েকটি স্থানে অবৈধ বাঁধ কেটে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পানির কারণে পুরোপুরি কাটা সম্ভব হয়নি।
এ ছাড়া নদীটির দক্ষিণে চরবাদাম ইউনিয়ন সীমানা শেষ হলেই চরপোড়াগাছা ইউনিয়নে নদী দখল করে ঘর উঠানো হয়েছে ও বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই বাঁধ কাউকে সরাতে দেওয়া হচ্ছে না।
স্থানীয়রা মনে করেন, অবৈধ দখলদার ও বাঁধগুলো অপসারণ করলেই এ নদীতে প্রবাহ ফিরে আসবে। জলাবদ্ধতাও নিরসন হবে। মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এজন্য সবাই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে সর্বোচ্চ সহযোগিতা চেয়েছেন।
চরপোড়াগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, “আমার ইউনিয়নের আজাদনগরের দক্ষিণে স্টিল ব্রিজ এলাকায় নদী দখল করে কয়েকটি ঘর উঠানো হয়েছে। ঘরগুলোর কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
“এ ছাড়া নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরজব্বর ইউনিয়নে নদীটির তিনমুখী একটি এলাকায় পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। একইসঙ্গে আমার ইউনিয়নের কোডেক বাজার এলাকায় সম্প্রতি একটি ব্রিজ হয়েছে। এতে ব্রিজের দুই পাশে বাঁধ দিতে হয়। কিন্তু বাঁধগুলো পুরোপুরি অপসারণ করা হয়নি। এখন তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে বাঁধগুলো অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
চেযারম্যান বলেন, “স্থানীয়রা আমার বিরুদ্ধে বাঁধ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। উপজেলা প্রশাসনের লোকজন এসে দেখে গেছে। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি।”
নুরুল আমিন বলেন, “প্রায় ২০ দিন ধরেই আমার এলাকার বহু মানুষ পানিবন্দি। অনেকের ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে লোকমাননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ তিনটি সাইক্লোন শেল্টারে অর্ধ-শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।”
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, “নদীতে ভাটা আসলে জলাবদ্ধতা নিরসনে সবগুলো স্লুইস গেইট খুলে দেওয়া হয়। আবার জোয়ারের সময় গেইটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সার্বক্ষণিক আমাদের কর্মীরা পর্যবেক্ষণে রয়েছে।”