নির্বাচন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। তবে আমরা সাধারণ মানুষ নির্বাচনের আগুনে পুড়ে মরতে চাই না আর।
Published : 15 Nov 2023, 01:51 AM
‘আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’ হরতাল-অবরোধে অতিষ্ঠ হয়ে মনে পড়ল শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতাটির এই একটি চরণ। খাণ্ডবদাহনের গল্পটা মহাভারতের। পঞ্চপাণ্ডব চার দিক ঘিরে খাণ্ডব বনে আগুন ধরিয়ে দিলে হরিণ, বাঘ, সাপসমেত সব প্রাণী অগ্নিদেবতার গ্রাসে পরিণত হয়েছিল। নির্বাচন এলে মনে হয় আমরা কী এমন এক বনে আটকা পড়েছি এবং ‘বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ’ করছি?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে পড়ছিলাম এই সেদিন আগুনে দগ্ধ বাসচালক সবুজ শেখের কথা— “শরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের শয্যায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাতরাচ্ছেন বাসচালক সবুজ। সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বলতে তিনিই। কিন্তু রোজগার বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে স্বজন আর পরিচিতজনদের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। কবে সুস্থ হয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিতে পারবেন; আয়ে ফিরবেন সেই দুশ্চিন্তায় দিন পার করতে হচ্ছে তার পরিবারকে।”
এরই মধ্যে শুরু হলো বিএনপির ডাকা পঞ্চম দফা অবরোধ। নির্বাচন সমাগত হলেই আমাদের দেশ, বিশেষত রাজধানী ঢাকা, এক রকম রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এই লড়াই মোটেও বাঁচার লড়াই নয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইও নয়। যদিও বিরোধীরা হরতাল-অবরোধের নামে নৈরাজ্যকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দোহাই দেয়। ক্ষমতাসীনরাও ক্ষমতায় টিকে থাকার যুক্তি তৈরি করতে ব্যস্ত হয়। বলতে শুরু করে নির্বাচন হতে হবে সংবিধানসম্মত উপায়ে। ফলে যে লড়াই-প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা ভোটে, ব্যালটে, স্বাক্ষরে, সিলে সেই লড়াই শুরু হয়ে যায় রাস্তায়। লাঠি, ইট-পাটকেল, বুলেট ও টিয়ার গ্যাসে। যে ভোট দিয়ে জনগণ নিজেদেরকে দেশের মালিক বলে প্রমাণ করতে পারে, সে ভোটের আগুনে প্রাণ দেয়। খাণ্ডবদাহনে অগ্নিদেবতাকে তুষ্ট করা হয়েছিল, এমনটাই পৌরাণিক আখ্যানে রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে বন পুড়িয়ে জমি হাসিল করা হয়েছিল, বনে পশুপাখির মৃত্যু পাণ্ডব ভাইদের কারোর ভাবনার বিষয় ছিল না। বাংলাদেশের ক্ষমতা থাকা এবং ক্ষমতা যেতে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমাদের অবস্থাও হয়েছে খাণ্ডব বনের পশুপাখির মতো।
বিগত দুই দশকের মধ্যে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলো হয়েছে, তার আগে দেখেছি নির্বাচন কিভাবে হবে তা নিয়ে জোর তর্ক শুরু হয়। আরও স্পষ্ট করে বললে নির্বাচনকালীন সময়ে ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় থাকবে কিনা তা নিয়ে প্রথমে শুরু হয় তর্কযুদ্ধ। এরপর ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন না করার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বিরোধীরা লড়াইয়ের মাঠে নামে। এই লড়াই কখনো ত্রিমুখী-চতুর্মুখী হয়ে ওঠে। সভ্য মানুষ অসভ্যের মত আচরণ করে, অন্ধ আক্রোশ কেড়ে নেয় কিছু মানুষের প্রাণ। আহত, পঙ্গু, অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকে আরো কিছু মানুষ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দিন থেকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছিল। এ তথ্য বিবিসির। নির্বাচনের আগের রাতেই সারাদেশে পাঁচশ’র মতো ভোটকেন্দ্রে হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। এত শুধুমাত্র দুদিন বা তারো কম সময়ের কথা। সেই ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে আগে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলন কর্মসূচি চলেছে বছরজুড়ে। শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে এবং দেশের মানুষ আন্দোলনের নামে নৃশংসতা, অগ্নিসন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করে এবং সেই সঙ্গে পোহায় সীমাহীন ভোগান্তি।
২০১৩ সালে গোটা বছরজুড়ে চলেছে হরতাল-অবরোধ। প্রথমদিকে একদিন দুদিনব্যাপী হরতাল দিয়ে শুরু হয়েছিল। পরে এই মেয়াদ বাড়তে বাড়তে তিন চার দিন মেয়াদী হয় এবং বছর শেষে তা পৌঁছায় লাগাতার অবরোধে। সংবাদ মাধ্যমে প্রতিদিনই সহিংসতায় একাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। সেই সময় চলন্ত যানবাহনে মূলত বাসে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারার ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যায়। সাধারণ মানুষ দুর্বিপাকে পড়ে। গণপরিবহন চলাচল না করায় দূরপাল্লার পথে নিরূপায় হয়ে রিকশায়, ভ্যানে, অটোরিকশা করে এবং পায়ে হেঁটে মানুষ গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। ২০১৪ নির্বাচনকে বা নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে ঘিরে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন হয়।
নির্বাচন উত্তর সময়ে দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আক্রমণের শিকার হয়। নির্বাচন এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন অবশ্য রীতিতে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনে যে দলই জয়ী হোক না কেন, সংখ্যালঘুরা নির্বাচনের আগে-পরে হবে নির্যাতনের শিকার। তবে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচন শেষে যে তাণ্ডব চলেছিল সেটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ এবং সেবার দ্বিতীয় দফায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। সংখ্যালঘুরা সেবারও রেহাই পায়নি। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরের দিন যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাঁপাতলায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর একটু রেহাই মিলেছিল সংখ্যালঘুদের।
২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল এর বিরোধিতা করে। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর প্রথমবারের মতো এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল, ফলে সে বিবেচনায় ২০১৮ সালের এই জাতীয় নির্বাচনের একটা ভিন্ন দিক ছিল। যদিও এটি বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। ‘রাতের ভোট’ নিয়ে সেই থেকে শুরু হওয়া আলোচনা এখনও থামেনি।
২০১৮ সালের ১০ নভেম্বর দুপুরে ঢাকার আদাবর এলাকায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় দুই কিশোর নিহত হয়। এই সংঘর্ষের ঘটনাটি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী সহিংসতার বড় ধরনের প্রাণহানির প্রথম ঘটনা। ডয়েচে ভেলের তথ্যানুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর দিন থেকে নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত ২১ দিনে সারাদেশে ২২ জন নিহত এবং ২১৭৯ জন আহত হয়েছিল।ভোটের দিনে সহিংসতা আগের ২০ দিনকে ছাড়িয়ে যায়। ২৪ ঘন্টায় নিহত হন ১৭ জন এবং আহত হন ৪৭ জন।
‘আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব‘ নির্বাচন কমিশন বেশ কিছুকাল আগে এই স্লোগান প্রচার করে আসছিল। বর্তমানে আর এমন প্রচার শোনা যায় না। তবে কি আমাদের দেশে যার ভোট তিনি নিজেই তা প্রদান করতে পারার বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেছে? হয়নি যে তার প্রমাণ তো ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বরের নির্বাচন। ভোট শুরুর পর ঘণ্টা দুয়েক যেতে না যেতেই অনেক এলাকা থেকে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা নানা অভিযোগ তুলে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়া শুরু করেন। দুপুর না গড়াতেই ১০০টির বেশি আসনে বিএনপি প্রার্থীরা একের পর এক নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছিলেন। সারাদেশ থেকে শুধু তাদের নির্বাচন বয়কটের খবরই পাওয়া যাচ্ছিল। ওই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র সাতটি আসনে জিততে পেরেছিল।
নির্বাচনের সময় এলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুখে একটি বাক্য বহুবার শোনা গেছে। বাক্যটি হলো ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’। বাক্যটি সব দলের জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা অর্থে বোঝানো হলেও এতে কোথায় যেন সাধারণ ভোটারদের প্রতি চরম উপেক্ষা প্রকাশ পায়, অন্তত আমার কাছে এমনটাই মনে হয়। রাজনীতিকদের দৃষ্টিতে যেন নির্বাচন একটি খেলা, দুই দল বা জোট খেলোয়াড় হয়ে মাঠে নামবে খেলার অনুষঙ্গ হলো সাধারণ জনগণ তথা ভোটার। কি খেলা খেলবেন তারা? জনতাকে ফুটবল বানিয়ে পারদর্শিতা অনুযায়ী ইচ্ছে মতো শট মেরে, হেড দিয়ে অধিক গোল করতে পারা মানে তাদের ক্ষমতায় পৌঁছানো? নাকি জনতাকে ক্রিকেট বলের মতো একদল ছুঁড়ে মারবে আরেকদল ক্রমানুসারে ব্যাট দিয়ে আঘাত করবে যে যেভাবে পারে আর কি। সমান সুযোগ নিশ্চিত হয় না, আমরাও আমজনতা ভোট দিয়ে দেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি না, যতই মুখে বলা হোক জনগণ দেশের মালিক, মালিকানা প্রমাণের সুযোগ তো একটাই যে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ চালাবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বহু বিতর্কের পরও এর মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং সেই সরকারের মেয়াদ এখনো চলমান আছে। আর তথাকথিত বিরোধীদল হিসেবে সংসদে পেয়েছি জাতীয় পার্টিকে।
স্বৈরাচারী এরশাদের জাতীয় পার্টি নিয়ে আওয়ামী লীগ জোট বেঁধেছিল এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালিত নির্বাচনের আগ দিয়ে। প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল সেনা সমর্থিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার, মানুষ যাকে ‘ ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনে’র সরকার বলে থাকে।
এখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়ছে। বিএনপি এখনও নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড়। আওয়ামী লীগ শুরু থেকে এ দাবি মানতে নারাজ। তাই আন্দোলন, সংগ্রাম, মহাসমাবেশ, শান্তি সমাবেশের নামে রাজপথ রণক্ষেত্রে পরিণত হতে দেখা গেল গত ২৮ অক্টোবর।
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশকে ঘিরে সংঘর্ষের পর বিএনপি হরতাল ডাকে। ২৯ অক্টোবর সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পর একদিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর সারা দেশে টানা তিনদিন অবরোধ করে বিএনপি-জামায়াত। সেই অবরোধ শেষে ৫ ও ৬ এবং ৮ ও ৯ নভেম্বর কর্মসূচি দিয়েছিল তারা। এরপর ১২ ও ১৩ নভেম্বর টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ পালন করে মাঝে মঙ্গলবার বিরতি দিয়ে ফের বুধ ও বৃহস্পতিবার পঞ্চম দফায় কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। অবরোধের আগের রাতে ঢাকায় ৪ বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধের মধ্যে মোট ৯৮টি বাস পুড়ল। মানুষের জীবন নিয়ে এই টানাটানি আর কত?
আওয়ামী লীগ এই আন্দোলনকে আদৌ বিবেচনায় নিচ্ছে বলে মনে হয় না। তবে এরই মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন-ভারত বৈঠকের খবর পেলাম। কেন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতে বৈঠক হয়, এই নিয়ে আলাপের মধ্যেই দেশের বড় তিনটি দলকে চিঠি দিয়ে ‘পূর্বশর্ত ছাড়া’ সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। ১৩ নভেম্বর ওই চিঠির তথ্যটি প্রকাশ পায়। সংলাপের আহ্বান যে বৃথা যেতে বসেছে, তা আজ ১৫ নভেম্বর তফসিল নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকের খবরে ধারণা করা যায়। ‘তফসিল নিয়ে আসছেন সিইসি, সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ’ এমন খবরে নিশ্চিত অনুমান করা যায় আজই তফসিল ঘোষণা করা হচ্ছে। এরপর কী আলোচনা হবে? হয় যদি তা আমাদের জন্য হয়তো মঙ্গলবার্তা নিয়ে আসবে।
নির্বাচন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। তবে আমরা সাধারণ মানুষ নির্বাচনের আগুনে পুড়ে মরতে চাই না আর।