বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে?

সিন্ডিকেট আছে স্বীকার করা মানে জেনেশুনে এদের লালনপালন করার সমতুল্য। ব্যবসার নামে মানুষের রক্ত শোষণের সুযোগ দেওয়া। মানুষের রক্ত ঘাম করা পয়সা ব্যবসার আড়ালে লুটে নিচ্ছে কারা?

সুরেশ কুমার দাশসুরেশ কুমার দাশ
Published : 7 July 2023, 10:58 AM
Updated : 7 July 2023, 10:58 AM

কাঁচা মরিচের কেজি এক হাজার টাকা হওয়ায় গোস্বা চারপাশে উথলে উঠেছে। সবাই সরব কাঁচা মরিচ নিয়ে। কাঁচা মরিচ কাদের পাতে পড়ল না যে এমন গোস্বা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। কিন্তু নানা প্রক্রিয়ায় বার বার ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাত দেখিয়ে কারা ব্যবসায়ীদেরকে ব্রয়লার মুরগি, ডিম, চিনি, ভোজ্য তেল, আটা-ময়দা, আদা-জিরা, পান, সুপারি, সাবান-সোডাসহ নানা পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া করার সুযোগ করে দিয়েছে। নাকি সেসব আড়াল করার জন‍্যই কাঁচা মরিচ নিয়ে অন‍্যদিকে দৃষ্টি ফেরানো হয়েছে।

উচ্চমূল্যে মাছ, মাংস, ডিম অনেকে কিনতে পারলেও দরিদ্র, হত-দরিদ্র এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্তদের পাতে তা উঠছে কিনা সেই খবরে কারও হা-হুতাশ নেই। অথচ সামান্য মরিচের জন্য কি দৌড়ঝাঁপ। কত ব‍্যস্ততা। আর অন‍্যদিকে বৈধ-অবৈধ আয় রোজগারের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে সম্ভবত, তাই কিনা সিন্ডিকেটের কথা উঠেছে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই সিন্ডিকেটের খবর জানতেন খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী। তারপরও এতদিন কোনো ব‍্যবস্থা নেননি তিনি। অবশেষে তিনি বলতে বাধ্য হলেন, সিন্ডিকেটের মাথায় হাত বুলিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

আসলে বাংলাদেশে যেকোনোভাবে যিনি পার পেয়ে যান তিনি সফলতার ডুগডুগি বাজাতেই পারেন। এটা এদেশের বাস্তবতা। বাজারে ভোক্তাদের এমন দুর্বিষহ যন্ত্রণা দেওয়ার পরও তারা ব্যর্থ হয়েছে এমন ভাবনা তো তাদের মাথায় আসাটাই দুরাশা। কারণ তাদের ব্যর্থতা তুলে ধরার সময় নয় এটা। বরং ব্যর্থ হবার জন্য তিরস্কারের বদলে আছে পুরস্কার। সিন্ডিকেট আছে স্বীকার করা মানে জেনেশুনে এদের লালনপালন করার সমতুল্য। ব্যবসার নামে মানুষের রক্ত শোষণের সুযোগ দেওয়া। মানুষের রক্ত ঘাম করা পয়সা ব্যবসার আড়ালে লুটে নিচ্ছে কারা? হাজার হাজার কোটি টাকা এভাবে লুটপাট হচ্ছে মানুষের। লুটপাটের অনেকগুলো প্রক্রিয়ার মধ‍্যে এটাও একটা।

অন‍্যদিকে জনগণেরও দায় আছে–কোনো দায়িত্বশীল মানুষ তো এটা হতে দিতে পারে না। যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, এই সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। প্রায় পাঁচ বছর সময় তো কম ‘দীর্ঘদিন’ নয়। এসব চোরা ব্যবসায়িরা এক সময় আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দিত। এখন আর সেই অজুহাত দেয়া যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম পড়তি। অথচ আমাদের বাজারে যে দাম তুলেছে তা আর নামাতে চাইছে না তারা। দাম ধরে রাখতে নানা অজুহাত খুঁজছে। কারণ লুটের ভাগ কমে যাবে। এখন দরকার সিন্ডিকেটে জড়িতদের ম্যানেজ করা।

সংসদে জাতীয় পার্টির এক এমপি বলেছেন, “গত কয়েক মাসে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব পড়ছে না। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ শতাংশ, এখন মনে হয় ১০ শতাংশ এবং এটা ক্রমবর্ধমান। মূল্যস্ফীতির কারণে সাবান, রুটি সবকিছুরই আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “সিন্ডিকেট আছে। এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সিন্ডিকেট শক্তিশালীও। কিন্তু তারা কি সরকারের চেয়ে শক্তিশালী?”

সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও বলেছেন, “উৎসব-পার্বণে আমাদের দেশের কিছু ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্য বাড়ায়। এটি অবশ্যই আমাদের জনগণের জন্য ভোগান্তি তৈরি করছে। যারা এটি করে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।” তিনি আরও বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।”

শুধু সংসদে বা সংসদের বাইরে নয়, বাজারে বিশাল সিন্ডিকেট যে কাজ করছে এ ব্যাপারে অহরহ কথা বলে আসছেন বিশ্লেষকরাও।

দেশ স্বাধীনের পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে আসার পর থেকে মৃত্যু অবধি যে লড়াই-সংগ্রাম করছিলেন তা ছিল মুনাফাখোর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, মজুতদার, খাদ্য চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে। ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজের মাঠে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এই বাংলাদেশে যত ডিস্ট্রিবিউটর আছেন, যত হোল সেলার আছেন, যত এজেন্ট আছেন, তেলের, সাবানের, কাপড়ের যা কিছু হোক, যদি সাত দিনের মধ্যে জিনিসের দাম না কমে... সমস্ত ডিস্ট্রিবিউটর, এজেন্টকে আমি ক্যানসেল করে দিব।.... তোমাদের আমি ব্যবসা করতে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাংলার মানুষকে লুট করতে দিই নাই।”

এভাবে তিনি দেশের মানুষকে ঘুষখোর মুনাফাখোর, দুর্নীতিবাজ, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের হাত থেকে বাঁচানোর লড়াই করেছেন। সুতরাং এই লুটেরা ব্যবসায়ীরা কিন্তু সাধারণ কোনো গণদুশমন নয়, তারা শত শত বছর ধরে ব্যবসার আড়ালে লুটপাট চালিয়ে আসছে। ঠকানোর কৌশল, মজুতদারি, খাদ্যপণ্য নষ্ট করে হলেও সঙ্কট তৈরি করে মুনাফা হাতানো তাদের মজ্জাগত অভ্যাস। আর ব্যবসার স্বার্থেই তাদের ঠেকাতে হবে তা নয়, তাদের দেখাদেখি অন্যরাও অন্যায়, জুলুমের সুযোগ নিচ্ছে। কারণ তারা অন্যায়, জুলুম করে পার পেলে অন‍্যরাও তাদের দলে এসে জুটবে।

দেশ স্বাধীনের পরে যে খাদ্য সঙ্কট ছিল বর্তমান সময়ের সঙ্গে তার তুলনা হবারই নয়। তখন বেশিরভাগ খাদ্য আসত বিদেশ থেকে। আর এখন দেশ খাদ‍্যপণ‍্যে ভরপুর। খাদ্যপণ্যের ভরপুর বাজারে জোচ্চুরি করছে সিন্ডিকেট। এমন অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। দেশে এরকম পরিস্থিতিতে জাতির পিতার সমবেদনা, অনুতাপ, অনুশোচনা ও মহনুভবতাকে ধারণ করতে হবে। শুধু মূল্য কমানোই নয়, এটা হবে গোটা জাতির ওপর চলমান অন্যায় ও জুলুমকে মোকাবিলা করার সামিল।

এসব লুটেরা ব্যবসায়ীরা সব যুগেই ছিল। আর ব্যবসার আড়ালে চুরি, জোচ্চুরিই তাদের লক্ষ্য। কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা সবসময় ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলেও বাজারের খবরাখবর নিয়ে অসৎ, চোরা, লুটেরা ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেওয়া হতো। তখনকার সময়ে এই ব্যবসায়ী সম্প্রদায় পণ্য এক ওজনে কিনে অপেক্ষাকৃত কম ওজনে বিক্রি করত। খরিদ্দার ও উৎপাদকদের ঠকাত ব্যবসায়ীরা।

নবাবী আমলে মুর্শিদকুলী খান তার কর্মচারীদের দিয়ে বাজারে বিক্রয়যোগ্য সমস্ত পণ্যের মূল্য তালিকা প্রস্তুত করতেন। গরীব মানুষরা বাজারে কি দামে জিনিস পত্র কেনে সে সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তিনি উভয় তালিকা মেলাতেন। যদি দেখা যেত গরীব খরিদ্দার দাম বেশি দিয়ে কোনো জিনিস কিনতে বাধ্য হয়েছে তখনই তিনি দোকানি, মহলদার ও ওজনদারদের ডেকে পাঠাতেন। এদের জন্য ছিল কাঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। গাধার পিঠে চাপিয়ে এদের সারা শহরে ঘোরানো হতো। বাজার, বাজার দর ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সম্পর্কে সবসময় অবহিত থাকতেন তিনি।

মধ্যযুগে সুলতান আলাউদ্দির খলজি নিজেই বাজার তদারক করতেন। ভোক্তাদের স্বল্পমূল্যে সঠিক মাপে পণ্য ক্রয় নিশ্চিত করতে সঠিক ওজন দেওয়ার প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল তার। কোনো ব্যবসায়ী ওজনে কম দিলে তার শরীর থেকে অনুরূপ ওজনের মাংস কেটে নেওয়া হতো, অসদুপায় অবলম্বনের অপরাধে দোকানিদের প্রকাশ্যে বাজারে অপমান করা হতো এবং তাদের শারীরিক নির্যাতনও করা হতো।

অথচ আধুনিক সময়ের আইন-আদালত যখন অনেক বেশি জনগণের পক্ষে বলা হয়, ঠিক তখনই জনগণ ব‍্যবসায়ীদের ভয়ংকর জুলুমের শিকার। ভাতের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার চেয়েও নির্মম জুলুম ভোক্তাদের ওপর চালানো হচ্ছে। আর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের মাথায় যদি হাত বুলাতে হয় আইন আদালতে কাজ কী! মানুষ কার মুখাপেক্ষি হয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন অতিবাহিত করবে। আর বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রেও দুশমন এই ব্যবসায়ীদের খুঁটির জোর কোথায়? দেশে অনেক পণ্য পর্যাপ্ত উৎপাদন হবার পরও তাদের জন্য আমদানি বন্ধ করা যায় না ক্ষেত্র‍বিশেষে। তাদের সিন্ডিকেটের কারণে সরকারও তটস্ত থাকে। যে কারণে সিন্ডিকেট চিহ্নিত করলেও ব্যবস্থা নিতে পারে না বলে বাজার বিশ্লেষকদের বক্তব্য।

সম্প্রতি দৈনিক ইত্তেফাকের একটি খবর বলা হয়েছে, বাজারের আটটি আমদানিকারক সিন্ডিকেট লালনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা জড়িত। সিন্ডিকেটটি চাল থেকে শুরু করে ডাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, শাক-সবজি, চিনি, মসলা, আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে।

তাই কাঁচা মরিচ নিয়ে তড়পানোর কিছু নেই। তেমনিভাবে পেঁয়াজ নিয়েও ভাবার কিছু নেই। তেল, আটা, চিনি, মাছ, মাংসসহ সকল নিত‍্যপ্রয়োজনীয় পণ‍্যের কয়েকগুণ মূল‍্যবৃদ্ধি করা হয়েছিল তা যেন অন্তত তথাকথিত আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করা হয়। এজন‍্য সিন্ডিকেট ধরে শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। আর বাজার সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে কী ব‍্যবস্থা নেবেন, কোন প্রক্রিয়ায় ব্যুহচক্র ভাঙ্গবেন আশাকরি বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই সেটা ভালো জানেন।