যে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সমাধানের সুযোগ ছিল, সে বিষয়টি শক্তিপ্রয়োগ করে সমাধান করা হয়েছে।
Published : 29 Jul 2024, 07:13 PM
যদি সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করি, আওয়ামী লীগ সরকারি চাকরিতে কোটা রাখার পক্ষে না বিপক্ষে? দলটির নেতাকর্মীদের কাছে এর জবাব কী? আপনি যদি একজন আওয়ামী লীগ কর্মী হয়ে থাকেন তবে ভেবে বলুন, কী উত্তর দেবেন? আওয়ামী লীগ কোটার পক্ষে? নাকি বিপক্ষে? কোনটা বললে আপনার দলের মুখ বাঁচবে? আরও কাছে গিয়ে প্রশ্নটি করি, আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্মের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের পক্ষে না বিপক্ষে?
সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, সরকার এবার শুরু থেকেই কোটা আন্দোলনকারীদের পক্ষে ছিল। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালেই তাদের দাবি মেনে নিয়ে কোটা উচ্ছেদ করেছেন। হাইকোর্ট সরকারের পরিপত্র বাতিল করে দিয়ে কোটা পুনর্বহালের আদেশ দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধেও আপিল করেছে সরকার। তার মানে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের কোনো বিরোধ নেই। তৃতীয় পক্ষ, মানে বিএনপি-জামায়াত, আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
ধরে নিচ্ছি এটাই সরকার তথা আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থান। আওয়ামী লীগের একজন কর্মী বা সমর্থক হিসেবে আপনি এখন বলতেই পারেন, “আমরা কোটা উচ্ছেদের পক্ষে। আমরা কোটা আন্দোলনকারীদের পক্ষে ছিলাম। আমরাই তাদের দাবি বাস্তবায়ন করেছি।”
বিশ্বাস করতে চাই, আপনার এ কথায় চালাকি বা ফাঁকি নেই। তাই বুঝিয়ে বলুন, “আওয়ামী লীগ কোটা আন্দোলনকারীদের পক্ষে থাকলে এত বিরোধ কেন? এত ধ্বংস কেন? এত মৃত্যু কেন? কেন এমন হলো? মৃত্যুর দায় কে নেবে?
১৯ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকায় সহিংস আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। সে সময় পরিবারের সবার সঙ্গে বাসার ছাদে গিয়েছিল ছয় বছরের ছোট্ট মেয়ে রিয়া গোপ। হঠাৎ গুলি এসে বিদ্ধ করে শিশুটির শরীর। রিয়ার এমন মৃত্যুর দায় কে নেবে?
ঘটনাটি রামপুরা এলাকার। সেখানে দশম শ্রেণির ছাত্র রেফায়েত কৌতূহলী হয়ে দেখতে গিয়েছিল কী হচ্ছে? গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে রেফায়েতের ডান পা। জীবন বাঁচানোর জন্য ডাক্তাররা ওর হাঁটু থেকে নিচের অংশ কেটে বাদ দিয়েছেন। সাংবাদিকদের সে বলেছে, “আমি আন্দোলন করতে যাইনি, দেখতে গিয়েছিলাম।”
আন্দোলন করতে যাক বা দেখতে যাক– তার এই বেদনাদয়ক পরিণতি কীভাবে মানা যায়? কে এর দায় নেবে?
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে নিরীহ শান্তিকামী মানুষ আছে, আন্দোলনকারী আছে, আন্দোলনে বাধাদানকারী ছাত্রলীগ কর্মী আছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও আছে। কার মৃত্যুতে কার সুখ হয়? কে নেবে দায়?
আন্দোলন যখন গণতান্ত্রিক না থেকে সহিংস হয়, তখন বলপ্রয়োগ না করে সরকারের উপায় থাকে না। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন কেন্দ্রে আক্রমণ হয়েছে, সেখানে বলপ্রয়োগ না করে এবং তা দমন না করে উপায় ছিল না, একথা ঠিক। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির উপর হামলা হয়েছে, সরকার সমর্থক দেখলেই হামলা হয়েছে, সাংবাদিক দেখলেই হামলা হয়েছে, অলিতে-গলিতে সহিংসতা হয়েছে– দমন না করে উপায় ছিল না।
শুধু সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে নয়, বিভিন্ন স্থানে থানা দখল করা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে, এমনকি জেলখানায় হামলা করে হাজতি ও কয়েদিদের বের করা হয়েছে। এই হামলাগুলো ছিল রাষ্ট্রের উপর। এগুলো বন্ধে শক্তি প্রয়োগের বিকল্প ছিল না।
তাহলে দায় কার? নিশ্চয় হামলার দায় তাদের, যারা হামলা করেছে। মৃত্যুর ও সহিংসতার দায় তাদের, যারা এসব করে। আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়ার পরেও যারা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ প্রত্যাহার করেনি, বড় দায় তাদের। আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে যেসব অপরাধী অপরাধগুলো করেছে তাদের সবার দায়। দায়ীদের বিচার হতে হবে।
কিন্তু পুলিশের কি দায় নেই? ছাত্রলীগের, আওয়ামী লীগের, সরকারের এবং সরকার প্রধানের কি দায় নেই? যে গুলি পুলিশের বন্দুক থেকে বেরিয়েছে সে দায় পুলিশ এবং সরকারকে নিতে হবে। তার বিচার হতে হবে।
বলতে পারেন, “আমরা চাইনি একটি মৃত্যুও ঘটুক। এগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, নিরীহ মানুষের প্রাণহানিগুলো দুর্ঘটনা ছিল, তাদের টার্গেট করে মারিনি, হামলাকারীদের উপর গুলি না চালিয়ে উপায় ছিল না” ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব বলে কি পার পাওয়া যায়? আপনি গাড়ি চালানোর সময় পথচারীর ভুলেও যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তবে চালক হিসেবে আপনি দায় এড়াতে পারেন না, পারবেন না।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের স্মার্ট প্রশ্নের জবাব ততোধিক স্মার্টভাবে প্রদান করে রাজনৈতিক নেতারা পরিস্থিতি নিজেদের পক্ষে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু স্টুপিড টাইপ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বেশি ধরা খান। নেতিবাচক কঠোর বাক্যেই হোক বা তোষামোদি বাক্যেই প্রশ্ন হোক– উত্তেজিত বা আবেগতাড়িত হয়ে উত্তর দিতে গেলেই রাজনীতিকরা বেকায়দায় পড়েন এবং সংবাদের বড় হেডলাইনের জন্ম দেন।
১৪ জুলাই চীন সফরোত্তর সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আর রাজাকারের সন্তান যদি বিসিএস পাশ করে, তবে আপনি কাকে চাকরি দেবেন?”
চাকরির কোটা নিয়ে আদালতে চলমান মামলার কথা বলে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে পারতেন। সরকার আদালতে ছাত্রদের দাবির পক্ষেই আইনি লড়াই করছে বলে পাশ কাটিয়ে যেতে পারতেন।
কিন্তু জবাব দেয়ার সময় একজন ঝানু রাজনীতিবিদ হয়েও মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের ব্যাপারে নিজের আবেগ লুকাতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের প্রতি তাঁর পক্ষপাত প্রকাশ করে ফেলেছেন। হয়তো ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিলেন, রাজপথে একটা আন্দোলন চলছে, যে আন্দোলনে কলকাঠি নাড়াচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে যথেচ্ছ বিকৃত করে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উত্তেজক ব্যঙ্গবিদ্রুপ শুরু করে তারা।
সমাজের দুঃখজনক বিচ্যুতি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যখন ছেলে-মেয়েরা নিজেদের ‘রাজাকার’ অভিহিত করে শ্লোগান দিতেও লজ্জা পায় না। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম ওরা ক্ষুব্ধ হয়ে এটা করেছে, কিন্তু ক্ষোভের এমন প্রকাশ, যা তাদের রাজাকার বলে ঘোষণা করতে প্ররোচিত করে তা আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন।
কিন্তু আওয়ামী লীগ কেন তাদের ফাঁদে পা দিল?
সরকার পতনের আন্দোলন করার জন্য যারা লাশ চাচ্ছিল তাদেরকে আমরা চিনি। আপনারা তাদেরকে সুযোগ দিলেন কেন? আপনারা নিজেরাই বলছেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আপনাদের বিরোধ নেই। তবে আপনারা নিজেরাই কেন দলগতভাবে ঘোষণা দিয়ে তাদের আন্দোলনে শামিল হলেন না? জনসমর্থন নিজেদের পক্ষে নিলেন না কেন?
আদালতে যেহেতু কোটা বিরোধীদের পক্ষে লড়ছিলেন, তাহলে রাজপথে ওই আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে না দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে তাদের পক্ষে দাঁড়ালে আপনাদের কি ক্ষতি হতো? ছাত্রলীগ কোটাবিরোধীদের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত না হয়ে কোটা উচ্ছেদের পক্ষে শ্লোগান দিয়ে মিছিল বের করল না কেন?
ছাত্রলীগ কি চাইলে কোটাবিরোধীদের সঙ্গে সুরে সুর মিলিয়ে সারাদেশে কর্মসূচি পালন করতে পারত না? কোটা উচ্ছেদ বা সংস্কার, যেটাই বলা হোক না কেন, আপনারাই করলেন; সেই করাটা ছাত্রলীগের দাবি মিলে যেতে পারত না কি? আপনাদের রাজনৈতিক কৌশলে ভুল হয়েছে। চাকরির কোটা প্রশ্নে আপনাদের নৈতিক অবস্থানেও বিচ্যুতি আছে।
কোটা এবং কোটা বিরোধিতার নৈতিক ভিত্তি কী?
দেশে সিভিল সার্ভিসে বছরে গড়ে প্রায় আড়াই হাজার পদে নিয়োগ হয়। এর বিপরীতে বছরে চার লাখ ছেলে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বের হয়। মাত্র এই আড়াই হাজার পদের সবগুলোতে কোটা ছাড়া নিয়োগ হলেও বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর সবার লাভ নেই।
বাকি থাকে কেরানি, পিয়ন দারোয়ান, সুইপার ইত্যাদি পদ। কোটা থাকলেও এসব পদে মেধার ঘাটতি হওয়ার কিছু ছিল না। মেধাবী কেরানি, মেধাবী পিয়ন, মেধাবী দারোয়ান, মেধাবী সুইপার নিয়োগের জন্য কোটা বাতিলের উন্মত্ত আন্দোলন যৌক্তিক হতে পারে না।
আন্দোলনকারীরা নিজেদের মেধাবী দাবি করলেও তাদেরকে বেশি মেধাবী বলার সুযোগ নেই। মেধাবী হলে বিজ্ঞানী বা তেমন কিছু হওয়ার কথা ভাবত। তারা ঘুষ খেয়ে লাভবান হওয়ার মতো সরকারি চাকরির খোঁজে মরিয়া হয়ে গেছে।
নিশ্চয় সরকারি কর্মচারীরা সবাই ঘুষখোর নন এবং এই ছাত্ররা চাকরি পেলে সবাই ঘুষ খাবেন তা-ও বলতে চাই না। তবে এই স্বঘোষিত মেধাবীদের দাবির মধ্যে আদর্শবোধ নেই। বরং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থাই মানবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অংশ।
কোটার বিরোধিতা করা মানে দুর্বলের অধিকার সংরক্ষণের বিরোধিতা করা। এ চিন্তা ভালো মানুষের হতে পারে না। যার শক্তি আছে সে টিকে থাকবে, যে দুর্বল সে খেয়ে পড়ে বাঁচার সুযোগ পাবে না, ‘survival of the fittest’ জীবনধারণের নিয়ম হবে— এসব জল ও জঙ্গলের জীবনধারা। জলাশয়ে বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খায়, এটাই নিয়ম। জঙ্গলে দাঁতাল প্রাণীরা নিরীহদের চিবিয়ে খাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। এই জংলি জীবন থেকে বেরিয়ে এসেই মানুষ মানবসমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে মানুষ– স্নেহ, প্রেম, করুণার সমাজ রচনা করেছে– যেখানে দুর্বলের অধিকার সংরক্ষণই সভ্যতা। এর বিরোধিতা করাকে সভ্যতা বলা যায় না।
লক্ষণ দেখলেই বোঝা যায়, কোটা উচ্ছেদের আন্দোলনকারীদের নেপথ্যে যারা রয়েছে, তাদের সকল সেন্টিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, নারীর সমঅধিকারের বিরুদ্ধে, সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর অগ্রাধিকারের বিরুদ্ধে।
অথচ নিজেদের নামটি কিন্তু দিয়েছে, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’! এই নামের আড়ালে কৌশলী প্রচেষ্টা হল দুর্বলের অধিকার কেড়ে নেওয়া। দুর্বলের অধিকার কীভাবে কেড়ে নেওয়া যায়? যদি তাদের জন্য সংরক্ষিত সুযোগ অপসারণ করা যায়, তবেই তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া যায়। তাই সমঅধিকারের নাম করে সকল দুর্বল জনগোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নেওয়ার আন্দোলন হল কোটা বিরোধী আন্দোলন। এক পা না থাকা একজন মেধাবী মানুষ যাতে ১০তলা ভবনে উঠে অন্যদের সঙ্গে কাজে যোগদানের সুযোগ না পায় সে উদ্দেশ্যে বিল্ডিংয়ে ওঠার বিশেষ লিফট ধ্বংস করার নাম কোটা আন্দোলন। দরিদ্র শ্রেণির মানুষকে সরকারি কাজে যোগদান করার সংরক্ষিত সুবিধা দিয়ে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তোলার বিরোধিতার নাম কোটা আন্দোলন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের মন্তব্যে দেখলেও ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। আন্দোলন চলাকালে আমি ফেইসবুকে লিখেছিলাম, “চাকরিতে নারী ও পুরুষ কোটা সমান ভাগ করে দিলে সমঅধিকার হবে। মেধাভিত্তিক সকল কাজে ৫০% নারী, ৫০%পুরুষ। বৈষম্য নেই।” একথা লেখায় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’র সমর্থকরা আমাকে গালি দিয়েছে।
লিখেছিলাম, “মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পর্যায়ে ৩০% কোটা বাদ দিয়ে নারীদের জন্য ৩৫% কোটা চালু করুন। তাতে কারও ক্ষতি হবে না, কারণ সবার ঘরে মুক্তিযোদ্ধা না থাকলেও নারী আছে। শিক্ষিত মেধাবী নারীদের ৩৫ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে তথা অর্থনৈতিক জীবনের মূলধারায় চলে আসলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। দেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও সরকারি চাকরিতে নারীদের অবস্থান এখনো ১০ শতাংশের নিচে আছে।”
এ কথা লেখার কারণেও নিজেদের বৈষম্যবিরোধী বলে দাবিদাররা আমাকে গালি দিয়েছে। কারণ তাদের লক্ষ্যই হল, নারী-পুরুষ বৈষম্য। নারী শিক্ষার হার বাড়লেও তারা যেন বড়জোর ‘শিক্ষিত গৃহিণী’ হয়– এই তাদের চাওয়া। যারা পুরোপুরি তালেবানি রাষ্ট্র করতে চায়, তারা কোনোক্রমের ক্ষমতা দখল করতে পারলে অবশ্য নারীর উচ্চ শিক্ষার সুযোগও কেড়ে নেবে। কোটা সংরক্ষণ না করলে নারীদের সমঅবস্থানে এগিয়ে আনা সুদূর পরাহত হবে– এটা তারা বোঝে। বোঝে জন্যই নারী কোটার বিরোধিতা করে।
দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ক্রমাগত কমছে। সরকারি চাকরিতে চার শতাংশের বেশি সংখ্যালঘু পাওয়া যাবে না। এদের সংরক্ষণের জন্য কোটা দরকার। তবুও সংখ্যালঘুদের জন্য কোটা সংরক্ষণের বিরোধিতা করবে, কারণ তারা দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের বিলুপ্তি চায়।
কিন্তু আওয়ামী লীগ কী চায়? আওয়ামী লীগ নিয়েছে জনতুষ্টিবাদী অবস্থান। কোটাবিরোধীদের দাবি অযৌক্তিক হলেও তা মেনে নিয়ে তুষ্ট করার পন্থা অবলম্বন করেছে।
মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সৃষ্টি করা একটি আজগুবি সিদ্ধান্ত ছিল। এটারই সুযোগ নিয়ে কোটা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে জনগণকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে।
তারপর আবার ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে তাদের পক্ষে আদালতে পর্যন্ত লড়াই করেছে। সরকার ‘যখন যেমন তখন তেমন’ অবস্থান নিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ কোন পক্ষে তা ঠিকঠাক করে বলা দলটির নেতাকর্মীদের জন্যও কঠিন হয়ে গেছে।
কোটা ব্যবস্থা কোনো চিরস্থায়ী কাঠামো নয়। এ হল কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, যা জনগণের বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থা বিবেচনা করেই সরকারকে নিতে হয়। তাই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়ায় আওয়ামী লীগ মহাপাপ করেছে বলতে চাই না। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তাদের কিছু ভুল কথা ও ভুল পদক্ষেপের বড় খেসারত দিতে হচ্ছে সবাইকে।
সরকার দাবি মেনে নেওয়ার পর কোটার দাবিতে আর আন্দোলন ছিল না। দাবি মানার পরেও নিছক নৈরাজ্য ও সহিংসতা চালানোর উদ্দেশ্য পরিষ্কার ছিল। তারা শুধুই লাশ চাচ্ছিল। কিন্তু সরকার তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ভুল করেছে।
সহিংসতা সত্ত্বেও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ প্রত্যাহার না করা ছিল অপরাধমূলক। ‘আমরা করিনি, আমাদের মধ্যে ঢুকে তৃতীয়পক্ষ এসব করেছে,’ বলে আন্দোলনকারীরা নাশকতার দায় এড়াতে পারে না। সরকারও তাদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দায় এড়াতে পারে না।
যে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সমাধানের সুযোগ ছিল, সে বিষয়টি শক্তিপ্রয়োগ করে সমাধান করা হয়েছে। যতটা সম্ভব ক্ষত মোচন করে, যেভাবেই হোক জনসমর্থন ফেরানো আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।