“প্রাক-বাজেট আলোচনায় কেন কৃষক, শ্রমিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের রাখা হয় না?”
Published : 18 Apr 2025, 11:52 PM
দেশে ‘ভয় ও নিয়ন্ত্রণের আবহে’ সংস্কৃতিচর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
থিয়েটার আর্টিস্টস এসোসিয়েশন অব ঢাকার (টাড) এক সেমিনারে তিনি বলেন, “একটা শ্রেণির আস্ফালনে সমাজ ও সংস্কৃতির পরিসর ছোট হয়ে আসছে। ভয় ও নিয়ন্ত্রণের আবহে সংস্কৃতিচর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”
সরকারকে শিল্পীদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, "যদি একজন শিল্পী স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ না পান, তাহলে সৃজনশীলতার জন্ম হয় না। শিল্প কেবল আনুগত্যের হাতিয়ার হয়ে পড়ে, যার কোনো গভীরতা থাকে না।"
দেশে প্রাক-বাজেট আলোচনায় কেন কৃষক থাকেন না, শ্রমিক থাকেন না, সংস্কৃতিকর্মীরা থাকেন না, সেই প্রশ্ন তুলে আনু মুহাম্মদ বলেন, "অথচ এ তিন শ্রেণিই সমাজের ভিত্তি। তাদের অভাব, তাদের বঞ্চনা এবং তাদের দাবিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নীতিনির্ধারক পরিসরে তাদের কোনো জায়গা নেই।"
শুক্রবার বিকালে ঢাকার জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে 'সংস্কৃতি খাতে বাজেট পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা' শিরোনামে এ সেমিনার হয়। তাতে ধারণাপত্র পাঠ করেন তৌফিকুল ইসলাম ইমন।
এতে বলা হয়, "বাজেট কেবল আর্থিক বিষয় নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। সংস্কৃতিকে প্রগতিশীল জাতি গঠনের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করলে সংস্কৃতিখাতে জাতীয় বাজেটের ১ শতাংশ বরাদ্দ সময়োপযোগী ও যৌক্তিক দাবি। এ জন্য যেমন রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমনি সংস্কৃতি কর্মীদেরও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং দায়িত্ব নিতে হবে।"
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আনু মুহাম্মদ বলেন, "উপজেলা পর্যায়ে যদি সত্যিকার অর্থে মানবিক ও সৃজনশীল সমাজ গঠন করতে হয়, তাহলে সেখানে পাঠাগার, খেলার মাঠ, নাটকের মঞ্চ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট অবকাঠামো থাকা জরুরি। অথচ আমরা দেখছি, দিন দিন এসব জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
"একটা সময় আমরা দেখেছি—বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি লেখা হত। সেই সব দেয়ালে লেখা স্বপ্নগুলো আজ চাপা পড়ে গেছে।"
সরকারকে উদ্দেশ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, "বর্তমান সরকারের সামনে এই বাজেট একটি পরীক্ষা। তারা কি সত্যিই সংস্কৃতির উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ বাড়াবে? নাকি তারা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর চাপ ও মদদে এমন পদক্ষেপ নেবে, যা আরও বেশি সংকোচন ও দমননীতিকে উৎসাহিত করবে?"
শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমির মত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রকৃত দায়িত্ব পালন করছে না, বরং তারা কোনো কোনো সময় নিরপেক্ষতার বদলে অনুগত শিল্পীদের প্রাধান্য দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেন, "অনুগত শিল্পী দিয়ে কোনো রাষ্ট্র সৃজনশীল ভবিষ্যৎ গড়তে পারে না।"
অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক মামুনুর রশীদ বলেন, "সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়ার পাশাপাশি দরকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও নীতির পুনর্গঠন।"
নাট্যদল ও নাট্যশিল্পীদের জন্য ‘স্যালারি গ্রান্ট’ চালু করার দাবি তোলেন মামুনুর রশীদ।
শহরে মঞ্চনাটকের অবকাঠামোগত সংকট তুলে ধরে মামুনুর রশীদ বলেন, "মিরপুর, উত্তরা, বসুন্ধরা, বনানী—এত বড় জনপদেও একটি থিয়েটার হল নেই; নেই বইয়ের দোকান কিংবা সিনেমা হল। অথচ ধানমন্ডিতে হাজারো রেস্টুরেন্ট।
“অর্থাৎ আমাদের সমাজে ‘খাওয়া’ হয়ে উঠেছে প্রধান বিনোদন। এটা এমন এক মানসিকতা, যেখানে জাতির মনন তৈরি হওয়ার সুযোগ কমে গেছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে হয়ত ধনী হচ্ছি, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও মানসিকভাবে গরীবই থেকে যাচ্ছি।"
অপু শহীদের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও অংশ নেন অভিনেতা তারিক আনাম খান, নৃত্যশিল্পী ও গবেষক লুবনা মারিয়াম, সংগীতশিল্পী শেখ জসিম ও সুজিত মোস্তফা, আবৃত্তিশিল্পী গোলাম সারোয়ার, চিত্র সমালোচক মঈনুদ্দিন খালেদ, আলোকচিত্রী কে এম জাহাঙ্গীর আলম, যন্ত্রসংগীত শিল্পী রিপন খান ও বাজেট বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে আজাদ আবুল কালাম বলেন, "আমরা প্রায়ই বিভিন্ন দাবি তুলে ধরি, কিন্তু সেই দাবি সুনির্দিষ্টভাবে কোথায় পৌঁছাবে, কাকে লক্ষ্য করে বলছি—তা নির্ধারণ করি না। এই সেমিনারের লক্ষ্য ছিল সেই দায়বদ্ধতা তৈরি করা। এই আলোচনা ও প্রস্তাবনাগুলো আমরা লিখিত আকারে অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পেশ করব।"
আমলাতন্ত্র এখনও মনে করে, রাষ্ট্রের সমস্ত সম্পদে কেবল তাদের অধিকার, শিল্পীদের নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে বলেও মন্তব্য করেন আজাদ আবুল কালাম।
"শুধু এই সেমিনারে কথা বলে সংস্কৃতির প্রাপ্য আদায় করা যাবে না। আমাদের রাস্তাতেও দাঁড়াতে হবে, জনতার সামনে, রাষ্ট্রের সামনে দাবি উত্থাপন করতে হবে। আজকের আয়োজন সেই ঐক্য গঠনের একটি প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করেছে।"