বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিতে ধীরগতি!

বীরাঙ্গনাদের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করা গেলে তাদের অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা বাড়বে। পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক ও গণমাধ্যমে তাদের ইতিহাস তুলে ধরা, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসসহ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নির্যাতনের শিকার নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পৃক্ত করাসহ তালিকাভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় যেন অনিয়ম ও দুর্নীতি না হয় সেদিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 29 March 2023, 11:41 AM
Updated : 29 March 2023, 11:41 AM

গণহত্যার ইতিহাস তুলে আনতে একবার পা রাখি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। কথা হয় একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা বা বীরাঙ্গনার সঙ্গে। নাম তাঁর লাইলী বেগম। তার কাছে জানতে চাই একাত্তরে কীভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন তিনি?

তার ভাষায়, “আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, পিপিএম হাইস্কুলে। একটু দুষ্টু ছিলাম। ছিলাম প্রতিবাদীও। বাবা আব্দুল লতিফ ছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জের ফরিদপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ সভাপতি। দেশে তখন যুদ্ধ চলছে। ফেঞ্চুগঞ্জে পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প বসায় কাইয়ার গুদামে। তাদের সহযোগিতায় ছিল শান্তি কমিটি ও রাজাকারের লোকেরা। পাকিস্তানি সেনারা আসার পরই হানা দেয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে। ভয়ে বাবা পালিয়ে বেড়ান। তখন চাচা কালা মিয়াই দেখভাল করতেন আমাদের। এভাবে কাটে তিন-চার মাস। অতঃপর একদিন গোপনে বাবা গ্রামে আসেন দেখা করতে। সঙ্গে ছিলেন পাল পাড়ার বানু মিয়া। দুপুরে তার বাড়িতেই ওঠেন।

তারা গ্রামে ঢুকলেই কেউ একজন খবর দিয়ে দেয় রাজাকারদের। ওরা দ্রুত খবর পাঠায় পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে। খবর পেয়ে ওরা অ্যাটাক করে বানু মিয়ার বাড়িতে। বাবা দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারলেও বানু মিয়া পারেননি। খাওয়া নাকি কোরআন শরিফ পড়ার মতো! অথচ ভাত খাওয়া অবস্থাতেই তাকে গুলি করে মারে ওরা। ওইদিন সন্ধ্যার পর বাবার খোঁজে বাড়িতে আসে পাঁচ-সাতজন রাজাকার। ফরিদপুর গ্রামের রাজাকার মঈন মিয়া, রশিদ মিয়া, মনাই মিয়া, তোতা মিয়া ছিল। আমি তখন পড়তে বসেছি। ওরা আমার চাচারে ধইরা নিতে চায়। তারে উঠানে নিলেই আমি সাহস করে সামনে যাই। জানতে চাই তার অপরাধ কী? ওরা বলে ‘ইন্ডিয়ার খবর শুনে কেনে। সভাপতি চেয়ারম্যানের কাছে নিয়া ছেড়ে দিমু।’ তখন চাচার লগে ওরা আমারেও তুইলা নেয়। নিয়ে যায় কাইয়ার গুদামে।

ওটা ছিল পাঞ্জাবিদের টর্চার সেল। খুবই অন্ধকার জায়গা। ওই পরিবেশ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মানুষের গোঙানির শব্দ পেতাম। আরও নারীরা ছিল। মাঝেমধ্যে তাদের কান্না আর চিৎকার সহ্য করতে পারতাম না। সেখানে আমার ওপরও চলে শারীরিক নির্যাতন আর অত্যাচার। ওই নির্যাতন কোনো নারীই মুখে বলে বোঝাতে পারবে না।

সেখানে রাখে এক মাস, চলে পালাক্রমে নির্যাতন। রাজাকার আর শান্তি কমিটির লোকেরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় আসা-যাওয়া করত। আমরা শব্দ পেতাম। খাবার দিত না ওরা। দুই-তিন দিন পর মন চাইলে এক বেলায় দিত রুটির সঙ্গে একটু ডাল।

একদিন শারীরিক নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে যাই। ওরা তখন আমারে এনে ফেলে দেয় মাইজগাঁও স্টেশনের পাশে। অতঃপর হাসপাতালে চলে দুই মাস চিকিৎসা। কাইয়ার গুদামের বড় বড় বাঙ্কার ছিল। সেখানে রাখা হতো শত শত নারীকে। স্বাধীনের পর আড়াই থেকে তিনশর মতো নারীকে বের করা হয়েছিল ওই বাঙ্কার থেকে। আমার মাথায় কাটার দাগ এখনো আছে। বাইশটা শিলি পড়ছিল। দেখেন মুখে ক্ষত। বেওনেট দিয়ে পাঞ্জাবিরা গুতা দিছে। ডান হাতটা ভাঙ্গা। পায়ের ক্ষতি করছে। রানের ভেতরও বেওনেটের খোঁচার দাগ আছে অগণিত।

অনেক কথাই মনে আছে। প্রজন্মের কাছে এখন টর্চারের কথা বলতে লজ্জা লাগে, ভয়ও লাগে। এখন তো কিছু মরা, কিছু জিন্দা হিসেবে বেঁচে আছি। সরকার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিছে বলেই ভালো আছি। আগে মানুষ কুকুর-বিড়ালের মতো ব্যবহার করত। এখন সম্মান দেয়। পুরুষ মুক্তিযোদ্ধারাও আগ্রহ নিয়ে কথা বলে। আর সরকার ভাতা না দিলে পথে পথেই অপমানে মরতে হতো।”

কথা হয় খোদেজা বেগম আর মনু বেগমের সঙ্গেও। তাঁরা দুই বোন। বাড়ি মোমিনপুরে। একাত্তরে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পাশেই ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। রাজাকারদের সহযোগিতায় একদিন পাঞ্জাবিরা তুলে নেয় দুই বোনকেই। তিনদিন রাখে কাইয়ার গুদামে। ওই দিনগুলো আজও তাদের কাছে অভিশপ্ত মনে হয়। তাদের ভাষায়, “কাইয়ার গুদামে বহুত পাকিস্তানি আছিল। আমাদের অত্যাচার করে ওরা মরার মতো ফালাইয়া রাখছে। অনেক মানুষ ছিল ওইখানে। খাবার দিত না। বহুত মানুষকে নিয়া নির্যাতন করছে ওরা। আমাগো টর্চার করে আধমরা করে ফেলে রাখত। কাঁদলেই রাইফেল দিয়া বাড়ি দিত। পরে মুক্তিযোদ্ধারা আমগো উদ্ধার করছে। এগুলা আগে বলতে পারতাম না। মানুষও খারাপ ভাবত। এহন ওই সময়টা নাই ভাই।”

অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা৷ বাংলার চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে লাখ লাখ ছাত্র-যুবা, কৃষক-শ্রমিক, মুটে-মজুর যেমন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, তেমনি বাংলার অসংখ্য নারীও প্রাণ দিয়েছেন, হয়েছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার৷ পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের বর্বরতার শিকার ওই নারীদের এতদিন শুধু ‘বীরাঙ্গনা’ বলেই সম্মান জানানো হতো৷ তবে স্বাধীনতার চার দশক পরেও সমাজে তাঁরা ছিলেন যেন অবাঞ্চিত৷লাঞ্চনা, ধিক্কার ও তিরস্কার ছিল তাঁদের অনেকের নিত্যসঙ্গী৷ একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিতে নির্যাতনের শিকার নারীরা সামাজিকভাবে কতটুকু সম্মানিত হয়েছেন তা লাইলী বেগম, খোদেজা বেগম আর মনু বেগমের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হওয়া যায়।

স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেওয়া হয়। পরের বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি তাদের সম্মানিত করার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগও নেন তিনি। ১৯৭২ সালে সিরাজগঞ্জে বীরাঙ্গনা নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ শহরের বিএ কলেজ মাঠে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেন নারী নেত্রী সাফিনা লোহানী। ওই সময় লাঞ্চিত এসব নারীকে সামাজিকভাবে নানা গঞ্জনার শিকার হতে হয়েছে৷ জেলায় অসংখ্য বীরাঙ্গনা থাকলেও, তাঁদের মধ্যে ৩৬ জন বীরাঙ্গনা আশ্রয় নেন এ পুনর্বাসন কেন্দ্রে৷ যাঁদের পরিবার বিষয়টি মেনে নিয়েছে তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে আসেননি৷ ৭৫-এর ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের সামরিক আদেশে এ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়৷ তখন আশ্রয় নেয়া অসহায় বীরাঙ্গনা নারীরা নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন৷ পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রও যখন পাশে থাকেনি, তখন তাঁদের জন্য লড়েছেন সাফিনা লোহানী৷

এরপর কেটে যায় অনেক বছর। ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিতে উচ্চ আদালতে পিটিশন দায়ের করে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। ওই বছরের অক্টোবর মাসে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) বীরাঙ্গনাদের নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবও পাস হয়। তাতে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করা, মাসিক ভাতাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সব সুবিধা দেওয়া এবং আর্কাইভ তৈরির কথা বলা হয়। ওই প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪১ বীরাঙ্গনাকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ করে ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর।

কিন্তু ২৪ মে ২০২২ পর্যন্ত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মাত্র ৪৪৮ জন। যার মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ১০৭ জন, রংপুর বিভাগে ৬১ জন, ঢাকা ও সিলেট বিভাগে ১০৬ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫১ জন, খুলনায় ৫০ জন, বরিশালে ৪৩ জন ও চট্টগ্রাম বিভাগে আছেন ৩০ জন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এমআইএস-এ গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনার সংখ্যাও হালনাগাদ নয়। এ ছাড়া গেজেটে নাম-ঠিকানায় ভুলও রয়েছে অনেকের।

আবার কতজনের আবেদন বর্তমানে আছে বা বিবেচনাধীন রয়েছে এই বিষয়ক কোনো তথ্যও স্পষ্ট নেই। ফলে গেজেটভুক্ত সংখ্যা হতাশাজনক এবং তা দ্রুত বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা। কেননা একাত্তরে নির্যাতনের শিকার নারীদের সংখ্যা সরকারি হিসেবেই বলা আছে দুই লাখ।

গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনার সংখ্যা কেন এত কম? গতবছর টিআইবি এ বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদন গণমাধ্যমে উপস্থাপন করেছে। তারা বলছে, সরকারি বা এলাকাভিত্তিক কোনো তালিকা না থাকায় এবং বীরাঙ্গনাসহ তাদের পরিবারের অসহযোগিতার কারণে বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিতদের’ দ্বারাও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে বলেও উল্লেখ করে তারা। স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বীরাঙ্গনারা এখনো প্রান্তিকীকরণের শিকার। তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের প্রক্রিয়াটিও গতানুগতিক অন্যান্য প্রক্রিয়ার মতো না হওয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করে টিআইবি।

বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করার সুনির্দিষ্ট কাঠামো ঠিক করা প্রয়োজন। উপজেলা পর্যায়ে গেজেটভুক্তির আবেদন প্রক্রিয়া তদারকি করতে মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান, আবেদন নিষ্পন্ন করার সময়সীমার বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা এবং ওই অনুযায়ী প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার বিষয়টিও উঠে আসে ওই গবেষণায়।

এ ছাড়া সার্বিক তথ্য-প্রমাণ যাচাইয়ে সত্যতা পেলে বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার বাদ দেওয়া, গেজেটে তথ্যের নির্ভুলতা নিশ্চিত করা এবং তথ্যগত জটিলতা এড়াতে জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স সংক্রান্ত ভুল সংশোধনে আলাদাভাবে দ্রুত ও বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন গবেষকরা, যা সরকার বিশেষ বিবেচনায় নিতে পারে।

উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও বীরাঙ্গনাদের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করা গেলে তাদের অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা বাড়বে। পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক ও গণমাধ্যমে তাদের ইতিহাস তুলে ধরা, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসসহ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নির্যাতনের শিকার নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পৃক্ত করাসহ তালিকাভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় যেন অনিয়ম ও দুর্নীতি না হয় সেদিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আর সেটি নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। পাশাপাশি বীর নারীদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কাজটি করতে হবে সকলে মিলেই।