স্বৈরতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউয়ে দেখা যায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই একসময় স্বৈরশাসকে পরিণত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এসে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নষ্ট করে ফেলছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে ব্যবহার করছে, যেমনটা করেছে শেখ হাসিনা সরকার।
Published : 09 Aug 2024, 10:51 AM
বর্তমানে বৈশ্বিক রাজনীতিতে স্বৈরতন্ত্রের যে ঢেউ চলছে সেটিকে ‘স্বৈরতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ’ বলা হয়। এই ঢেউ শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। স্বৈরতন্ত্রের প্রথম ঢেউ ছিল ১৯২৬ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। আর ১৯৬১-১৯৭৭ সালের মধ্যবর্তী সময়টাকে দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে ধরা হয়। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন তার ‘দ্য থার্ড ওয়েব: ডেমোক্রাটাইজেশান ইন দ্য লেইট টুয়েলভ সেঞ্চুরি’ বইয়ে সর্বপ্রথম স্বৈরতন্ত্রের প্রথম দুই ঢেউয়ের কথা উল্লেখ করেন। যাকে তিনি ‘ওয়েব অব রিভার্সাল’ নাম দেন। পরে গবেষকরা ১৯৯৪ সাল থেকে বর্তমান সময়টাকে ‘তৃতীয় ঢেউ’ বলে উল্লেখ করতে শুরু করেন। সেই হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ যে গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হলো সেটি এই তৃতীয় ঢেউয়ের অংশ। এই ঢেউটা কিছুটা অভিনব ও জটিল। কারণ স্বৈরতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউয়ে দেখা যায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই একসময় স্বৈরশাসকে পরিণত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এসে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নষ্ট করে ফেলছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে ব্যবহার করছে, যেমনটা করেছে শেখ হাসিনা সরকার। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, রাশিয়া, সাইবেরিয়া, তুরস্কের কথাও বলা যায়। এই দেশগুলোতে এই একই কৌশলের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়।
দ্রোহ যাত্রা: প্রাণহানির দায় নিয়ে সরকারের পদত্যাগ দাবি আনু মুহাম্
এই ধরনের স্বৈরতন্ত্র যখন কোনো জাতির বুকে জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসে তখন স্বৈরতন্ত্রের দোসররা শোষণ বজায় রাখার জন্য একটা ‘ইকোসিস্টেম’ বা প্রতিবেশ তৈরি করে। এটাকে নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের একধনের ‘কায়েমীব্যবস্থা’ও বলা যায়। এই কায়েমীব্যবস্থা শুধু যে স্বৈরতন্ত্রকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাহায্য করে তা নয়। সেটি একসময় যেন অবিনশ্বর এক ব্যবস্থায় রূপ নেয়। ক্ষমতার দৈর্ঘ্য যত বাড়ে এই ‘ব্যবস্থা’র ব্যাপ্তিও তত দীর্ঘ হয়। মজবুত হয় তার শোষণের ভিত। যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বৈরশাসকের পথ আরও মসৃণ করে তোলে। ফলে, রাজনীতি থেকে শুরু করে প্রশাসন– সব জায়গায় তৈরি হয়, এমন ছোট ছোট ইকোসিস্টেম। প্রথমে তারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে একটা কায়েমীব্যবস্থায় পরিণত করে, যে ব্যবস্থায় মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে পুরো রাজনৈতিক কাঠামো গণমুখী না হয়ে ক্ষমতামুখী প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। যা দলের পরিবর্তে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রধান্য দেয়। তারপর এই রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলোকে এই ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসে। প্রশাসন, বিচারবিভাগসহ অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠান এই ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। তথাপি, রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভ, একেকটা শোষণের নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। একসময় শোষণের এই নিউক্লিয়াসগুলো একজোট হয়ে এই স্বৈরতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ভেঙে পড়ে সমগ্র বিচারব্যবস্থা। দুর্বল হয়ে পড়ে গণতান্ত্রিক সব কাঠামো। সর্বোপরি সামগ্রিক ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দলের অধীনে কাজ করতে থাকে। ফলে, জনগণের জন্য যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা সেটি ব্যক্তি বা দলের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হয়ে উঠে। যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো বর্তমান বাংলাদেশ। ফলে দেখা যায় জন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই ধরনের স্বৈরতন্ত্রের পতন হলেও সেই একই নীপিড়নতন্ত্র জাতির বুকে আবার চেপে বসে। স্বৈরতন্ত্রের বর্ম পরে শাসকগোষ্ঠী খুনি শকুন হয়ে চেপে ধরে গণতন্ত্রের টুটি। গণের শক্তিকে দমিয়ে রাখে ওই কায়েমীব্যবস্থার শক্তির বলে।
বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র বাংলাদেশ যেমন গণঅভ্যুত্থানের দেশ বা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের দেশ তেমনি অভ্যুত্থান ‘বেহাত’-এরও দেশ। কারণ ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় এই বাঙালি জনগোষ্ঠী সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ বা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বহুবার রক্ত দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। কিন্তু কোনও অভ্যুত্থানের ফসল সঠিকভাবে ঘরে তুলতে পারেনি এই দেশের মানুষ। প্রতিটা অভ্যুত্থানের পরেই শাসকগোষ্ঠী ঠিক একই ইকোসিস্টেম কাজে লাগিয়ে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে গণঅভ্যুত্থান গণের বিপক্ষেই ব্যবহার করেছে। ফলে সেই একই বৈষম্য বারবার ফিরে এসেছে সমাজে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথাই বলা যায়। দীর্ঘ নয় মাসে জাতি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ৩০ লাখ শহীদ রক্ত দিয়েছিলেন একটি বৈষম্যহীন দেশ গড়ার জন্য। তাদের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তানিদের আরোপিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকসহ বহু ধরনের বৈষম্যের শেকল ভেঙে সমতার এক নতুন বাংলাদেশ গড়া। স্বপ্নের সেই বৈষম্যহীন সমাজ কখনও পায়নি বাংলাদেশের মানুষ। হয়তো সে কারণেই বলা হয় ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’। যার পুনরাবৃত্তি আমরা আবার দেখি ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর।
১৯৯০ সালে গণতন্ত্রের জন্য যে দেশের মানুষ জীবন দিয়েছিল। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করেছিল। সে গণঅভ্যুত্থানও একসময় অগণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কারণে বেহাত হয়ে যায়। দেখা যায় জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারগুলো আরও বেশি স্বৈরাচারী হয়ে উঠে। সব শেষে উদাহরণ হলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকারের পতন।
স্বাধীনতার যুদ্ধ করা বাংলাদেশের অন্যতম পুরাতন দলও সেই একই ইকোসিস্টেমে বন্দি হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করা এই দল কায়েমীব্যবস্থার ঘেরাটোপ না ভেঙে বরং তার ব্যাপ্তি বাড়াতে থাকে। ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক ধারা থেকে বের হয়ে ক্ষমতার লালসায় ডুবে সেই কায়েমীব্যবস্থার জালে জড়িয়ে পড়ে। যে গণতন্ত্রের জন্য আওয়ামী লীগ গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে। সে গণতন্ত্রই প্রাণ হারায় এই দলের শাসনামলে। গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার দল মানুষের গণতন্ত্র হরণে লিপ্ত হয়। যার ফলে অতীতের মত এবারও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশের তরুণরা, বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীরা, রাস্তায় নেমে পড়ে। আন্দোলনকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়। রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে নতুন ভোর। এই তরুণদের লক্ষ্যও বৈষম্যহীন স্বপ্নের নতুন এক বাংলাদেশ গড়া। যেখানে মতাদর্শ, ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য চলবে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অনেকক্ষেত্রে ২০২৪-এই আন্দোলনের চেতনাকে ১৯৭১ সালের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ যেমন পাকিস্তানের তৈরি শোষণের ইকোসিস্টেম থেকে বের হতে পারেনি। বাংলার মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। একইভাবে বর্তমানের শোষণের ইকোসিস্টেম ভাঙতে না পারলে আবার সুফল থেকে বঞ্চিত হবে দেশের মানুষ। তাই, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এই প্রক্রিয়ায় আমাদের সজাগ থাকতে হবে এই অভ্যুত্থানও যেন বেহাত না হয়ে যায়। এই বিপ্লব যেন কোনো মৌলবাদী শক্তির হাতে চলে না যায়। সাম্প্রদায়িক কোন অপশক্তি যেন এই ব্যবস্থায় ঢুকে সোনালি ফসল নষ্ট না করে দেয়। এই ধরনের অপশক্তিকে রুখতে ঢাল নির্মাণ করতে হবে। সেটা যদি সঠিকভাবে করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে এই ধরনের অপশক্তি আর ডালপালা মেলতে পারবে না।
যেহেতু নতুন কিছু গড়তে হলে ভাঙতে হয়। শোষণের এই আগল ভাঙার প্রক্রিয়ায় সর্বগ্রাসী ইকোসিস্টেমটাও ভাঙতে হবে। এই ব্যবস্থা ভাঙতে পারলে নতুন করে কেউ স্বৈরতান্ত্রিক হতে চাইলেও হতে পারবে না। সেই পথ বন্ধ করা যাবে চির তরে।
'সবার সরকার' গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইউনূস সরকারের যাত্রা