Published : 10 Jul 2023, 11:36 AM
গত শতাব্দীতে দুই মহান বাঙালি উত্তর ইউরোপের মাটিতে পা রেখে বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করে গেছেন। একজন 'বাঙালি সংস্কৃতির পাসপোর্ট' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আরেকজন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে ইউরোপের বাইরের প্রথম নোবেল পুরস্কারজয়ী প্রতিভা হিসেবে সম্মান লাভ করেছিলেন। তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করতে সুইডেনের মাটিতে প্রথম পা রেখেছিলেন ১৯২১ সালে। ওই সফরে তিনি উত্তর ইউরোপের সব থেকে প্রাচীন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তাঁকে নগরের রেলওয়ে স্টেশনে অভ্যর্থনা জানাতে জড়ো হয়েছিলেন সাড়ে তিন হাজার উৎসুক মানুষ। এই শহরের ইতিহাসে শতবর্ষ পরেও এটি একটি বিরল ঘটনা। শতবর্ষ পূর্বে এই শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ছিল অর্ধলক্ষের কিছু ওপরে। এখন এই শহরে তিন লাখের কাছাকাছি মানুষের বাস। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের শতবর্ষ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ ভবনের ভেতর রবীন্দ্রনাথের একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।
১৯৫৬ সালে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে স্টকহোমে এসেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তৎকালীন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে শান্তি সম্মেলনের জন্যে দেশটির প্রতিনিধিদলে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যাতে থাকে সেই ব্যাপারে আগেই অবগত করে রেখেছিলেন আয়োজকরা। এরপর ১৯৭১ সালে উত্তর ইউরোপের সবগুলো দেশ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম দিকে যেসব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে উত্তর ইউরোপের দেশগুলো, বিশেষ করে, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও সুইডেন অগ্রগণ্য।
এরপর কালে কালে ধাপে ধাপে দুই দেশের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তি অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিনিময় অব্যাহতভাবে বেড়েছে। কিন্তু এসব ইতিবাচক দিক ছাপিয়ে দেশের বাইরে বাংলাদেশ ঘিরে অনেক নেতিবাচক খবর বর্ণবাদী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রায় সবসময় জায়গা করে থাকে। ঠিক তেমনই হাল আমলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, কিছু কিছু ব্লগ এবং ইউটিউব চ্যানেল বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। এর বিপরীতে দেশ ও জাতির রক্ষাকবচ হিসেবে দেশের কর্তৃপক্ষ পর্যায় থেকে উল্লেখ করার মতো তেমন কার্যকর তোড়জোড় বা পাল্টা পদক্ষেপ আমার জানার পরিধির মধ্যে নেই।
এই বিষয়ে আরও একটু বিশদ কথা বলার আগে এই সময়ে বাংলাদেশ এবং উত্তর ইউরোপ ঘিরে দুটো ইতিবাচক ঘটনার কথা বলে নিতে চাই। এই বছরের মার্চ মাসে সুইডিশ লেখক স্টিগ দগেরমানের জন্মশতবর্ষের আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে উপসালায় অবস্থিত সুইডেনের সাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবদুল বাছির এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ক্যান্ডিনেভীয় বিদ্যাকেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক সৌরভ সিকদার চুক্তি স্বাক্ষর করে গেছেন। এর ফলে দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুটি দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি বিনিময়ের সম্ভাবনা জোরালো হবে।
জুনের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের বিজিএমইএ ফ্যাশন ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের একটি প্রতিনিধি দল সুইডেনের বোরস বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি শিক্ষাবিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর করে গেলেন। এই চুক্তির আওতায় এখানকার শিক্ষার্থী গবেষকরা বিজেএমইএ পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ ও গবেষণার সুযোগ লাভ করবেন। একইভাবে ওখানকরার শিক্ষার্থী এবং গবেষকরা একই অধিকার লাভ করবেন।
এই প্রতিনিধি দলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আইয়ুব নবী খান ছাড়াও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, মশিউল আজম সজল, মুজাফফর ইউ সিদ্দিকী, এফবিসিসিআই (ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিস) সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এমপি এবং বিজিএমইএ (বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স’ অ্যাসোসিয়েশন) সভাপতি মো. ফারুক হাসান ছিলেন।
বাংলাদেশের ব্যবসার প্রসার, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের মিশনের অংশ হিসেবে আরও কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ কর্মসূচির মাঝে শিক্ষাবিনিময়ের এই উদ্যোগকেও বাণিজ্যমন্ত্রী গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করতে চাই বোরসের এই বিশ্ববিদ্যালয় ইউরোপের উল্লেখযোগ্য বিশেষায়িত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে ফ্যাশনবিদ্যা ও গ্রন্থাগারবিদ্যায় পাঠদান ও গবেষণার জন্যে সুইডেনের দক্ষিণপূর্বের বৃহত্তম বন্দর বাণিজ্য আর ইউনেসকো সাহিত্যনগরী গোথেনবার্গের অদূরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টি বেশ নামকরা।
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মশিউল আজম সজল আমার লেখা এপিক মনোলোগ ‘আমি শেখ মুজিব’-এর ইংরেজি সংস্করণের আন্তমহাদেশীয় বিতরণ কর্মযজ্ঞের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ওই বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকায় একযোগে। যে আয়োজনে বাণিজ্যমন্ত্রীও যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে। সেই সুবাদে তিনি আমার লেখালেখির ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পেয়ে থাকতে পারেন। ওনার দাওয়াতে স্টকহোমের স্ক্যান্ডিক হোটেলে জুন মাসের ৮ তারিখে প্রাতরাশে প্রথম সাক্ষাৎ এবং বেশকিছু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। এই প্রাতরাশপর্বে অন্যান্যের মধ্যে মশিউল আজম সজল, বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আইয়ুব, বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসানও ছিলেন।
মশিউল আজম সজল এবং মো. ফারুক হাসান আলাপের একপর্যায়ে দেশের বাইরে অবস্থানকারীদের বাংলাদেশবিরোধী ইউটিউবে তৎপরতার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী শুনলেন। তিনি সবকিছু শুনে মৃদুকণ্ঠে দৃঢ়তার সঙ্গে জানতে চাইলেন এসব নেতিবাচক প্রচার ও মিথ্যাচারের বিপরীতে করণীয় কী হতে পারে? প্রশ্নটা সকলের উদ্দেশে বললেও, তাঁর আগ্রহ ছিল আমি কী বলি সেদিকেই। সেটা আমি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলাম। কিন্তু প্রসঙ্গের বিশদ আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। কেননা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রাচার কর্মকর্তা মন্ত্রীর জন্যে গাড়ি নিয়ে হাজির। গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠকে মন্ত্রীকে নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি। এই প্রাতরাশ বৈঠকে আলাপচারিতার বিষয়গুলো বিশেষ করে মন্ত্রীর প্রশ্নটি নিয়ে আমি ভেবেছি।
আমাদের আলাপচারিতার অসমাপ্ত প্রসঙ্গে আমার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরার আগে দুটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসতে চাই। প্রশ্নগুলো এরকম:
১. ইউটিউব এবং ইউটিউবের বাইরে নেতিবাচক প্রচারণায় তৎপর এরা কারা?
২. এ ধরনের প্রচারণায় এদের কী লাভ?
এই রকম প্রচারণার কাজে যারা ব্যতিব্যস্ত এদের রাজনৈতিক পরিচয়ের গোড়ার সন্ধান করতে গেলে বেরিয়ে পড়ে বেশিরভাগের পারিবারিক গণ্ডি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। এদের বাবা, দাদা, চাচা, নানা, মামাদের কেউ না কেউ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সিলসিলার সঙ্গে জড়িত ছিল। আর তাও যদি না হয়ে থেকে এদের শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে কারও না কারও রাজাকার সংযোগ না থাকার অবকাশ খুব একটা নেই। এই সিলসিলার বাইরে কেউ কেউ তথাকথিত আঁতেল বুদ্ধিজীবী, ব্লগবাজি, ভেতরে জামায়াত-শিবির চৈতন্য আর বাইরে নিরপেক্ষতার লেবাস পরে রোজগারে খতিব সুবিধা মুসাফির।
আদতে বিদেশের কর্মবাজারে এরা যে খুব একটা সুবিধা করতে পেরেছে তা নয়। ইউটিউব চ্যানেল চালিয়ে রোজগারের একটা আংশিক গতি তারা পেয়েছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলে, সরকারকে তুলোধুনো করে সত্য আর মিথ্যার খিচুড়ি প্রচার করে যদি বিদেশের মাটিতে বসে ডলার কামাই করা যায় তাতে মন্দ কী? রথ দেখাও হলো, কলা বেচাও হলো। আর কিছু আছে নানা সমর্থিত এবং অসমর্থিত দেশি-বিদেশি উৎস থেকে অর্থকড়ি পেয়ে থাকে।
একদিকে এদের বেশিরভাই আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভোগে। আদতে এদের আত্মপরিচয় এবং আত্মমর্যাদা বলে কিছু নেই। এই দুইটার যেকোনো একটা থাকলে মতপ্রকাশের দোহাই দিয়ে বস্তুনিষ্ঠতার বাইরে গিয়ে বিদেশের মাটিতে বসে দেশের বিরুদ্ধে কথা বলার এমন কী আছে? যেসব দেশে এইসব অপপ্রচারকারীরা থাকে ওসব দেশের মূলধারার গণমাধ্যমের ধারেকাছেও ভিড়তে পারে না এরা। ওসব দেশের কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা তো দূরের কথা!
তাহলে প্রশ্ন জগতে পারে, পশ্চিমা কূটনীতিকরা এইসব ব্লগ আর ইউটিউব ‘মুঘলদের’ কথাবার্তায় এত নড়চড় করছে কেন? কথায় আছে না, ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী’। ব্লগ, ইউটিউব মুঘলদের বিদ্যার দৌড় তো তথৈবচ। আর কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সম্পর্কে ঝাপসা ধারণার ওপর ভর করে এইসব ব্লগ আর ইউটিউব চ্যানেলগুলোকে সাক্ষী জগন্নাথ হিসেবে ধরে নিয়ে কূটনীতিক পাড়ায় ষড়যন্ত্র করছে। আর এর পেছনে কুশীলবের তো অভাব নেই। মূলধারার গণমাধ্যমের কতিপয় মুঘল এবং বিদেশি তহবিলে ফুঁলে ফেঁপে থাকা কতিপয় সুশীল। ভেতরে ভেতরে বাম আর ডান উভয় ঘরানার যোগাযোগ বলয় এসব প্রচারণায় তালি বাজাচ্ছে।
এদিকে প্রকাশ্য মাঠে তো বিএনপি আছেই। আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তো বিলেতে বসে এসব প্রচারণায় জ্বালানি সরবরাহ করে যাচ্ছেন। এসব কাণ্ডে সাময়িক যেমন আর্থিক লাভের যোগ আছে আর আখেরে যদি সরকার পাল্টে যায় তাদের কপাল ফিরবে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বিস্তৃত হয়ে। তাই তারা আদা-জল খেয়ে নেমে পড়েছেন। আর বলে যাচ্ছেন দেশে তো ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই’, তাই বিদেশে বসে দুনিয়া উদ্ধার করছেন। মতপ্রকাশের এইসব ‘বীরেরা’ সামরিক শাসনের সময় লেজ গুটিয়ে থাকেন, জামায়াত-বিএনপির শাসনামলে পরহেজগার নয়তো নিরপেক্ষ মৃদুভাষী হয়ে যান।
তবে দুর্নীতি অনিয়ম সম্পর্কে অবশ্যই কথা বলার আছে। কিন্তু বিদেশিদের ত্রাণকর্তা প্রভু মনে করে নিজের দেশ সম্পর্কে যাচ্ছেতাই প্রচার করে যাওয়ার বিষয়টা একদমই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর এটাকেই বলে ‘মীরজাফরি’, যার গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৭৫৭ সালে।
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতির গূঢ় রহস্য হচ্ছে ইনিয়ে বিনিয়ে পশ্চিমারা ‘অদেশপ্রেমিক’ কর্তৃত্ববাদী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দৃশ্যে-অদৃশ্যে সমঝেই চলে। পশ্চিমাদের উৎপাদিত অস্ত্র বিক্রির মুসাবিদা করে থাকে এরকম ‘মুনাফেকি’ কূটনীতির মাধ্যমে। তারা মধ্যপ্রাচ্যের কতৃত্ববাদী সৌদি, কাতার, আমিরাতসহ অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর ব্যাপারে তো এসব ‘সুশীল কুশীল’ প্রসঙ্গের অবতারণা করছে না। পরোক্ষে সেনানিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান নিয়ে চুপসে আছে কেন? আজকের গণতন্ত্রের ছবকদার মার্কিন মুল্লুক ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাঙালি নিধনকে সমর্থন দিয়েছিল কেন? ইসরাইলকে তারা কিছু বলছে না কেন? ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে আশকারা দিয়ে, সেই সাদ্দামকে কেল্লাফতে করে, প্রাচীন সভ্য দেশটাকেই ধ্বংস করে গেল কেন? আফগানিস্তান ধ্বংস করে লেজ গুটিয়ে চলে গেল কেন? লিবিয়াকে বিপদগ্রস্ত করে নীরব গৃহযুদ্ধের মুখে ঠেলে দিল কেন? অতএব সাধু সাবধান। বিদেশের ‘ত্রাণকর্তা প্রভু’র চেয়ে অপ্রিয় স্বদেশি অনেক ভালো।
এবার বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের আলাপের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এসব দেশবিরোধী প্রচারণা ঠেকানোর চেষ্টা করে খুব একটা লাভ হবে না। তার চেয়ে বরং আবিষ্কার করতে হবে এসবের বিরুদ্ধে ‘জীবাণু-প্রতিরোধী’ উপায়। এরকম পন্থার জন্যে প্রথম উদ্যোগ থাকতে হবে দলীয় পর্যায়ে। দলকে দুর্নীতিমুক্ত গণতন্ত্রিক চর্চার মধ্যে দিয়ে সাংগঠনিকভাবে চাঙ্গা করে প্রতিটি একক শাখায় পাঠচক্র কর্মশালা করে জ্ঞানগরিমা তথ্য-উপাত্ত ইতিহাসের ধারণা দিয়ে দলীয় কর্মীদের সমৃদ্ধ করা যায়। গণমুক্তি গণসমৃদ্ধি আর গণসম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিকল্প নেই। একই সঙ্গে দলীয় পর্যায়ে প্রযুক্তিতে দক্ষ প্রশিক্ষক দল গড়ে তুলে স্তরে স্তরে দেশব্যাপী দায়িত্বপালনের জন্যে ছড়িয়ে দেয়া যায়। আর আন্তর্জাতিক চক্রকে মোকাবিলার জন্যে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য কোনো জনসংযোগ কোম্পানির সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করা।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তথ্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধটাকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। তবে তার আগে সংশ্লিষ্ট সকল দলের ও সরকারের ভেতরে এবং বাইরের নিজ নিজ দলের ভেতরের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা; নিদেনপক্ষে নিগৃহীত করার মাধ্যমে আস্থার জায়গাটা পোক্ত করা। আর তা না হলে মানুষ একূলে-ওকূল দুই কূলে বিপদ দেখে ‘মীর জাফরদের’ খপ্পরে পড়ে গেলে কিছু করার থাকবে না। দেশের ভেতরে ও বাইরে তো ‘রবার্ট ক্লাইভে’র অভাব নাই।
এরকম অবস্থায় চীন কী করে, তার একটা উদাহরণ দিয়ে লেখাটির সমাপ্তি টানতে চাই। ২০১০ সালে চীনবিরোধী মার্কিন দোস্ত ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন আগ্রাসনের ঘোরতর সমর্থক চীনা লেখক লিও জিয়াবো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বসলেন। এই অবস্থায় চীন কী করল? দেশটি খুঁজে খুঁজে একটি বইয়ের তালাশ পেল। বইটি লিখেছিলেন নরওয়ের শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ এবং লেখক ফ্রেডরিক স্ট্যাঙ হেফারমেল (Fredrik Stang Heffermehl)। বইটির নাম ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার: আদতে নোবেল কি চেয়েছিলেন’ (Nobel Peace Prize, the: What Nobel Really Wanted)।
নোবেল পুরস্কার নিয়ে যত অনিয়ম, অগণতান্ত্রিক চর্চা ও দুর্নীতি, মিথ্যাচার আর শান্তির নামে অশান্তির পক্ষে আশকারা দেবার যত খতিয়ান সব তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। মূল বইটি ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, চীনের ‘শত্রু’ জিয়াবোকে নোবেল পুরস্কার দেবার বছর দুই আগে। চীনা কর্তৃপক্ষ বইটি সংগ্রহ করে মোটা অংকের টাকা খরচ করে মেধাবী দক্ষ অনুবাদক দল দিয়ে রাতারাতি বইটি চীনা ভাষায় অনুবাদ করিয়ে, বই আকারে প্রকাশ করিয়ে ব্যাপক হারে বিতরণ প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করেছে।
এই ঘটনা থেকে সংশ্লিষ্ট মহল তাদের করণীয় ঝালাই করে নিতে পারেন।