যুদ্ধবিরতির পরপরই পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি দখলদার কর্তৃক হামলার শিকার হচ্ছে। মানুষের চোখ যখন গাজায়, ইসরায়েল তখন পশ্চিম তীরে সম্প্রসারণবাদী আক্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
Published : 27 Jan 2025, 11:46 PM
ডেমাক্র্যাটিক দলের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন উভয়েই অবসরে গেছেন গণহত্যার চরম লজ্জা ও ঘৃণা নিয়ে। অন্যদিকে ফ্যাসিবাদের সমর্থক বলে পরিচিত ডনাল্ড জে. ট্রাম্পের ক্ষমতায় পুনরাবির্ভাব ঘটছে একটি জয়পতাকা হাতে— গাজায় দেড়বছরব্যাপী চলা গণহত্যা বন্ধের কৃতিত্ব নিয়ে। এই চুক্তি সম্পন্ন হলো বাইডেন আমলের শেষ দিনগুলোয় ঠিক, কিন্তু তারা যেন ট্রাম্পের আদেশ পালন করল মাত্র।
ট্রাম্প ২০১৬ থেকে এ পর্যন্ত এই প্রথমবারের মতো বিশ্বশান্তির পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন। যদিও তার এবারকার প্রশাসন আগেরবারের চেয়েও বেশি যুদ্ধবাজ ও ফিলিস্তিন-বিরোধী দিয়ে ভরা। ট্রাম্পের হুমকি ছিল হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি জিম্মিদেরকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তার ওই হুমকিও বিশ্বসংবাদ হয়েছে— সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণে তিনি তো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন— এ সন্দেহের অবকাশ নেই।
৭ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প হামাসকে সব ইসরায়েলি জিম্মি ছেড়ে দিতে হবে তার ক্ষমতা গ্রহণের আগেই এমন হুমকি দেন। হুমকি দিয়েই বলেছিলেন, “আমার ক্ষমতা গ্রহণের আগেই তারা যদি আলোচনায় না আসে নরকাগ্নি ছড়িয়ে পড়বে মধ্যপ্রাচ্যে, এটা হামাসের জন্য ভালো হবে না, সত্যিকার অর্থে এটা ভালো হবে না কারও জন্যই।”
যাদের জন্য ভালো হবে না তাদের মধ্যে ইসরায়েলি নেতা নেতানিয়াহুর নামটিও প্রচ্ছন্ন ছিল। যদিও ট্রাম্প ইসরায়েলের ঘোরতম সমর্থক, নিজেকে যিনি আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম ইসরায়েলপন্থী প্রেসিডেন্ট বলে গর্ব করেন। এর ফলে ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি একতরফাভাবে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। নেতানিয়াহুও তাকে ইসরায়েলের অন্যতম বন্ধু বলে থাকেন। কিন্তু ট্রাম্পের রাজনীতি অনেকখানি তার ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি মতো চলে। বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নেতানিয়াহু তাকে অভিনন্দন জানালে ট্রাম্প ক্ষিপ্ত হন এবং তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “ফাক হিম!”
ট্রাম্পের মানসিক স্বাধীনতা বাইডেনের চেয়ে বেশি। বাইডেন ইসরায়েলের ক্রীতদাস হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। গাজায় সংঘটিত ইসরায়েলি গণহত্যায় তিনি আর্থিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্রনেতিকভাবে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছেন নেতানিয়াহুকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ ও বিশ্বজনমত কারও মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করেই। ট্রাম্প ওই তুলনায় স্বাধীন। হুমকি দিয়েছেন হামাসকে, কিন্তু গ্যাঁড়াকলে ফেলেছেন নেতানিয়াহুকেও।
গ্যাঁড়াকলে ফেলেছেন খুব সহজেই। ট্রাম্প এ অস্ত্রটি ধার নিয়েছেন খ্যাতিমান ইহুদি-মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেফ্রি ডি স্যাকসের কাছ থেকে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে কেমব্রিজ ইউনিয়নের এক অনুষ্ঠানে জেফ্রি স্যাকস যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে ইসরায়েলের বিশেষ করে নেতানিয়াহুর হাতে জিম্মি হয়ে গেছে ওই ব্যাখ্যা দেন। এই জায়নবাদবিরোধী দার্শনিক-অর্থনীতিবিদ ইসরায়েল প্ররোচিত ও যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার তীব্র সমালোচনা করেন। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণের জন্য কী অজুহাত তুলেছিল আর ভুয়া যুদ্ধ মানুষকে খাওয়ানোর জন্য কী করেছে তা বলেন। গাজায় গণহত্যা সম্পর্কে বলেন, “এই যুদ্ধ কোত্থেকে এলো?” বলেন, “জানেন কী? বেশ আশ্চর্যের। এই যুদ্ধের হোতা নেতানিয়াহু।” স্যাকস ব্যাখ্যা করেন, “১৯৯৫ সালে নেতানিয়াহু যে তত্ত্ব দিয়ে এসেছে তা হলো, হামাস ও হিজবুল্লাহকে অপসারণের জন্য আমাদের একমাত্র পথ হচ্ছে যেসব সরকার তাদের সমর্থন করে তাদেরকে অপসারণ করা। তারা হলো ইরাক, সিরিয়া, ইরান।”
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও আর্থিক সহায়তায় নেতানিয়াহুর সব স্বপ্নই একে একে পূরণ হয়েছে। বাকি আছে কেবল ইরান। স্যাকস তাই বলেন, “লোকটি মানসিক বিকারগ্রস্ত বৈ কিছু নয়। সে এখনো আমাদেরকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে নামাতে চাচ্ছে, আজকের দিন পর্যন্ত, এই সপ্তাহ পর্যন্ত।” এরপরই বলেন, “সে একটা চরম ঘৃণ্য সান অব এ বিচ, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে।” তিনি বলেন, “সে আমাদেরকে দিয়ে বহু যুদ্ধ করিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে তার প্রভাবের কারণে সে এসব করতে পেরেছে।”
নেতানিয়াহু “একটা চরম ঘৃণ্য সান অব এ বিচ”— ভিডিওর এই ক্লিপটা ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করে দেন। বাইডেনকে প্রশংসা করার শাস্তি হিসেবে জেফ্রি স্যাকসের হাত দিয়ে নেতানিয়াহুকে এই চড়টি মারেন তিনি। আর স্টিভ উইটকফের মাধ্যমে বার্তা দেন যে, হামাসের সঙ্গে তাকে চুক্তিতে বসতে হবে। যে চুক্তিটা আসলে ছিল মে মাসের খসড়া যা হামাস তখনই মেনে নিয়েছিল, কিন্তু নেতানিয়াহুর গোঁয়ার্তুমি ও হামাসের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার বদকৌশলের কারণে তখন সফল হয়নি। ওই একই চুক্তি হলো ৭ মাস পর— আরও কয়েক হাজার হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে।
ট্রাম্পের এই সাফল্য আবারও একটি সত্য উদঘাটন করে যে, ইসরায়েলের এই ১৫ মাসের গণহত্যার পেছনের শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন-কমলা প্রশাসন। অনেকেই তখন বলেছে, ইসরায়েলের এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক মিনিটের বিষয়— শুধু বাইডেন বা কমলার পক্ষ থেকে নেতানিয়াহুকে একটা ফোন এই বলে যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে আর এক পয়সাও সাহায্য করবে না। স্যাকসের একটি ভিডিও ক্লিপ আপলোড করেই ট্রাম্প আরও সহজে কাজটি সমাধা করলেন। যদিও ইসরায়েলি প্রশাসনের ওপর চাপ তৈরির জন্য উইটকফের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য ছিল।
তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে ইসরায়েলের প্রচলিত রাষ্ট্রনীতির অন্যতম সমর্থক ডনাল্ড ট্রাম্প ঠিক কী কারণে নেতানিয়াহুকে হামাসের সঙ্গে চুক্তিতে বাধ্য করলেন? ট্রাম্প কি ২০২৫ সালে বিশ্বশান্তির অন্যতম ধারক-বাহক হয়ে উঠলেন? মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শান্তি স্থাপনের তিনিই কি অন্যতম নিয়ামক? তার এই নতুন শান্তিবাদী চেহারা কতটা আন্তরিক?
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদেরকে আগে আরও কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথমত, এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি ফিলিস্তিনে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে একটি প্রাথমিক ও সাময়িক পদক্ষেপ। যদিও ১৫ মাসে ফিলিস্তিন জুড়ে খুন, জখম ও গুমের যে নরক ইসরায়েল চালু করেছিল এই যুদ্ধবিরতি ফিলিস্তিনবাসীকে তা থেকে সাময়িক মুক্তি দেবে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। এ কৃতিত্ব ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার টিমকে দিতেই হবে।
নেতানিয়াহু যে সুড়সুড় করে মে মাসের পুরনো চুক্তিতেই রাজি হয়ে গেলেন তাকে প্রশ্নের চোখে দেখার কারণ আছে। কারণ এখনো নিশ্চিত নয়, হুমকি দেওয়া ছাড়াও আর কী উপায়ে ট্রাম্প ও উইটকফ তাকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়েছেন। উল্লেখ্য, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে চুক্তি সম্পাদন পর্যন্ত ইসরায়েল ১০০ জন ফিলিস্তিনবাসীকে হত্যা করেছে। এই যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন হবে ৮৪ দিনব্যাপী ৩টি ধাপে। প্রথম ধাপ মাত্র চলমান। কিন্তু পরের ধাপগুলোর ভাগ্য এখনো অনিশ্চিত। ট্রাম্প নিজেও বলেছেন, তিনি এ ব্যাপারে ভরসা পাচ্ছেন না।
নেতানিয়াহু নিজেও এই যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রতি আন্তরিক নন। নেতানিয়াহু সরকারের কোয়ালিশন সদস্য জুয়িশ পাওয়ার পার্টির নেতা জাতীয় প্রতিরক্ষা মস্ত্রী ইতামার বেন-গেভির যুদ্ধবিরতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। একইভাবে কোয়াশিন ত্যাগের হুমকি দিয়েছে আরেক সদস্য রিলিজিয়াস জায়োনিস্ট পার্টি। এর নেতা অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ শেষ মুহূর্তে নেতানিয়াহুকে ছেড়ে যাননি এই আশ্বাসে যে, গাজায় আবার হামলা শুরু হতে যাচ্ছে। ১৬ জানুয়ারি দ্য টাইমস অব ইসরায়েলে প্রকাশিত হয় যে, হামাসকে পুরোপুরি পরাজিত না করা পর্যন্ত তারা গণহত্যা থামাতে রাজি না। নেতানিয়াহুর কাছ থেকে অচিরেই যুদ্ধে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আশ্বাস লাভের পরই কেবল তারা সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির পরপরই পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি দখলদার কর্তৃক হামলার শিকার হচ্ছে। মানুষের চোখ যখন গাজায়, ইসরায়েল তখন পশ্চিম তীরে সম্প্রসারণবাদী আক্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে গাজা ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত যা পুনর্নির্মাণ করতে কমপক্ষে ৮০ বছর লাগবে বলে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা মনে করেন। কিন্তু ৮০ বছর দূরে থাক, গাজা পুনর্নির্মাণে ফিলিস্তিনিরা শান্তিপূর্ণ ৮০ দিন পাবে কিনা তাই অনিশ্চিত। কেননা ট্রাম্প আর নেতানিয়াহুরই জানা কেবল নিজেদের মনের কথা।
তবে উগ্র জাতীয়তাবাদী ট্রাম্প যদি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে সত্যি ইসরায়েলের খপ্পর থেকে মুক্ত করতে উদ্যোগ নেন, সেটাই হবে এক নতুন মোড়। একইসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, সবচেয়ে বেশি ফিলিস্তিন-বিরোধী দিয়ে ঠাসা কিন্তু বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন।