Published : 18 May 2020, 10:07 PM
সারা পৃথিবীতে গত কয়েক মাস ধরে করোনাভাইরাস জনিত মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে যে ভয়ংকর দুর্যোগ দেখা দিয়েছে তা মানবেতিহাসে বিরল। এর প্রভাবে আমাদের সবার জীবন ভীষণভাবে বিপর্যস্ত। এই দশা থেকে, স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের প্রকাশনা শিল্পও বাদ পড়েনি। তবে এই শিল্প এখন আরো নাজুক দশায় এই কারণে যে, এটি একটি অতি রুগ্ন শিল্প-রাষ্ট্রের কোনও নেক নজর আজ অব্দি সেটার ওপর পড়েছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। সেই সঙ্গে একথাও বলা যায় যে এটি আদৌ একটি শিল্প হিসেবে এদেশে গড়ে উঠেছে কিনা- এই প্রশ্ন কেউ উত্থাপন করলে জবাবটি ইতিবাচক হবে না।
এই অবস্থায় পুস্তক প্রকাশ ও বিপণন গত প্রায় দুমাস ধরে স্থবির হয়ে ছিল। সম্প্রতি সরকার লকডাউন খানিকটা শিথিল করার কারণে সীমিত পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্য আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ থাকায় পুস্তক বিপণীতে লোকসমাগম খুবই কম। পাঠকের পড়াশোনা এখন মূলত তাদের ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রহ এবং ইন্টারনেটে লভ্য সফট কপি নির্ভর। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেয়া না হলে প্রকাশনার সঙ্গে জীবিকার কারণে জড়িত জনগোষ্ঠীর অবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়বে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের প্রণোদনার আওতায় প্রকাশনাকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছি। সেই সঙ্গে, অনলাইনে বইপত্র কেনা বেচার ব্যাপারটিও জোরদার করা দরকার। বইপত্র যাতে সহজে পাঠকের দোরগোড়ায় কাছে পৌঁছাতে পারে সেজন্যে বিদ্যমান সরকারী ডাকঘর এবং কুরিয়ার সারভিসগুলোর সাহায্য নিয়ে প্রকাশক এবং পুস্তক বিপণীগুলো আলাদাভাবে বা যৌথভাবে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। সেইসঙ্গে, সামনের দিনগুলিতে মহামারীজনিত দীর্ঘকালব্যাপাী অচলাবস্থার কথা বিবেচনা ক'রে, প্রকাশকরা নিরাপদ ই-বুক প্রকাশের দিকেও নজর দিতে পারেন।
বই পড়ার উপকারিতার কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই্। তারপরেও খুবই তাৎপরযপূর্ণ একটি তথ্য উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে রুশ বিপ্লব সংঘটনের অব্যবহিত পরে — বিপ্লবীরা সবে মাত্র শীত প্রাসাদ দখল ক'রে নিয়েছেন, তার পরের রাতেই ভ ই লেনিন লুনাচারিস্কিকে এক পাশে ডেকে নিয়ে প্রথমে বলেছিলেন, "গ্রন্থাগারের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে সবার প্রথমে।"
এবং শুধু কথার কথা নয়, প্রদোষকুমার বাগচী রচিত "লেনিনের গ্রন্থাগার ভাবনা এবং উন্নয়ন" নামক গ্রন্থের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি লেনিন দেশের মানুষের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি, গ্রন্থাগারগুলো ঢেলে সাজানো ও আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৮৯৭ সালে তাঁকে পূর্ব সাইবেরিয়ার এক নির্জন স্থানে নির্বাসিত করা হয়। সেই নির্বাসিত অবস্থায় তিনি যে কেবল অক্লান্তভাবে অধ্যয়ন করে গেছেন, নানানভাবে বইপত্র জোগাড় করেছেন তা নয়, এই নির্বাসিত অবস্থাতেই তিনি ৩০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যার মধ্যে অন্যতম ছিল "রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ" নামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বইটি।গ্রন্থাগার, প্রকাশনা শিল্প, এবং এমনকি আপৎকালীন পরিস্থিতিতেও পাঠাভ্যাসের গুরুত্ব বোঝাতে আর কোনো উদাহরণের প্রয়োজন পড়ে না।
এই করোনা মহামারীর সময়ে বই এর ভূমিকার কথা আলোচনায় ভারতের কেরালা রাজ্যের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ভারতের এই প্রদেশটি মহামারী মোকাবেলায় অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। সেখানে এই মহাদুর্যোগের সময়ও বইয়ের দোকান ও গ্রন্থাগার খোলা রাখা এবং পাঠকের হাতে বই-পত্র পৌঁছানোর ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়েছে। কেরালায় শিক্ষিতের হার এমনিতেই বেশি। আর মহামারীর এই কঠিন সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যে বই পড়া অত্যন্ত জরুরি সেকথাটি প্রদেশটির জনগণ তো বটেই অনেক নেতাও উপলব্ধি করেন। এমনকি, যখন দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হয়েছিল, তখন মালায়ালাম চলচ্চিত্রের দুজন অত্যন্ত বড় তারকা টোভিনো থমাস এবং মঞ্জু ওয়ারিয়র তাড়াতাড়ি দোকানে গিয়ে বিপুল পরিমাণ বই ক্রয় করেছিলেন।
মহামারীর সময়ে গ্রন্থপাঠ জরুরি এই কারণে যে তা মানুষকে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি অবস্থায় থাকার সময়ের অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, হতাশা, ভীতি, ইত্যাদি থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে। একথা ঠিক যে আজকাল ইন্টারনেটে প্রচুর বইপত্র পাওয়া যায়। কিন্তু 'রক্ত-মাংসের' বই আর ই-বুক বা পিডিএফ বা ইপাব পাঠের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশের মতো দেশে সবার কাছে ইন্টারনেট এখনো সহজলভ্য নয়। বা হলেও, অনেকেই- বিশেষ করে যাঁদের বয়স ৪০ এর কোঠায় তারা- সাধারণত এভাবে বই পড়তে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। তাই 'সত্যিকারের' বই হাতে পাওয়া পাঠকের জন্য খুবই দরকার। তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যেন বইয়ের প্যাকেট ও বই জীবাণুমুক্ত হয়। আর, বই ক্রয়-এর মাধ্যম ইলেকট্রনিক হলে নগদ টাকা লেনদেন জনিত সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যায়।
আমাদের জীবনে সংকট কোনো নতুন বিষয় নয়। নানান সময়ে নানান সংকটের মুখোমুখি আমাদের হতেই হয়। এবারের পরিস্থিতি প্রকাশনা শিল্পসহ অন্যান্য ক্ষেত্রের জন্য অভাবিতপূর্ব ঠিকই, কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলা আমরা করতে পারবো বলে আশা রাখি।