পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এখন সবার প্রতিপক্ষ। তাকে আন্দোলনকারীরা মারে, পুলিশও মারে। আবার সাধারণ মানুষও গালাগাল করে।
Published : 03 Aug 2024, 10:30 AM
সাম্প্রতিক সহিংসতা ও তার পরবর্তী পরিস্থিতির ভেতর গত ৩১ জুলাই বরিশালের দুটি ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত এক পুলিশ সদস্যকে দুজন তরুণ কোলে করে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্য ছবিতে দেখা যাচ্ছে সংঘর্ষের ছবি তোলায় একজন সিনিয়র ফটো সাংবাদিককে লাঠি দিয়ে বেদম মারছে পুলিশ।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে লাঠিচার্জের ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের হামলার শিকার হয়েছেন বরিশালের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। আহতদের মধ্যে তিনজন হাসপাতালে ভর্তি। আরও ৪-৫ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। দৈনিক যুগান্তরের ফটো সাংবাদিক শামীম আহম্মেদ বলেন, “লাঠিচার্জের সময় আমি মাটিতে পড়ে যাই। আমার হাতে ক্যামেরা। পুলিশ তখনো আমাকে লাঠিপেটা করে। আজকের ঘটনায় পুলিশ মোটেও পেশাদার আচরণ করেনি।”
আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা বলেন, লাঠিচার্জকারী টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন উপ-কমিশনার। সাংবাদিকদের ওপর লাঠিচার্জকারী পুলিশ সদস্যদের কাছেই ছিলেন তিনি। এই পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের লাঠিচার্জ করতে নিবৃত্ত করেননি। এ সময় পুলিশ সদস্যরা সাংবাদিকদের গালিগালাজ করেছেন বলেও জানান তারা।
যে কোনো আন্দোলন বা সংকটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি অবস্থান করে সংবাদ সংগ্রহ করেন গণমাধ্যমকর্মীরা। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের লাঠিচার্জ কিংবা টিয়ার শেল নিক্ষেপের মতো ঘটনার ছবিও গণমাধ্যমের আলোকচিত্র সাংবাদিক ও ক্যামেরাপারসনরা ধারণ করেন। কিন্তু ওই ছবি তুলতে গিয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিপেটার শিকার হবেন— এটি লজ্জার। পুলিশ যদি আন্দোলনকারী এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে একই আচরণ করে, তাহলে দেশে আর সাংবাদিকতা করা সম্ভব নয়। বরং বিক্ষোভকারীদের কেউ যদি চড়াও হয়, তাদের হাত থেকে সাংবাদিকরদের রক্ষা করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। অথচ ঘটছে উল্টো। তার মানে কি এই যে, পুলিশ কিংবা রাষ্ট্র চায় না সাংবাদিকরা ঘটনার চিত্র ধারণ করুক কিংবা ঘটনাস্থলে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করুক?
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন এবং তার জের ধরে সহিংসতা চলাকালে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এসব আক্রমণের ধরন দেখে মনে হয়েছে তারা পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার। বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের গাড়িও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয় যেদিন, অর্থাৎ গত ১৯ জুলাই— সেদিন রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে সংবাদ সংগ্রহ করে ফেরার পথে হাতিরঝিল এলাকায় কতিপয় বিক্ষোভকারীর তোপের মুখ থেকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টার। তার কাছ থেকে ঘটনার যে ভয়াবহতা শুনেছি, সেটি গা শিউরে ওঠার মতো।
কেন গণমাধ্যমকর্মীরা এরকম আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলেন তার অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। গণমাধ্যমগুলো জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে কিনা বা সংকটকালে তারা কতটুকু পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে পারছেন এবং না পারলে তার কী কারণ— তা নিয়ে অনেক কথাবার্তা আছে। গণমাধ্যমের অভ্যন্তরেই এ নিয়ে আলোচনা আছে। আছে আত্মসমালোচনা। আছে সীমাবদ্ধতা নিয়ে নিজেদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ। কিন্তু অস্বীকার করার সুযোগ নেই, দিন শেষে গণমাধ্যমই ভরসা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখা যায়, তার সবকিছু সত্য নয়। সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে, ছবি ও ভিডিও এডিট করে, জোড়াতালি দিয়ে অনেক কনটেন্ট তৈরি করা সহজ। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা আরও সহজ। কিন্তু গণমাধ্যম সেটা পারে না। গণমাধ্যম এডিটেড ছবি কিংবা ভিডিও দিয়ে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করতে পারে না। তাকে একটা সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। আবার রাষ্ট্রীয় অনেক আইন-কানুন এবং রাজনৈতিক চাপও তাকে মোকাবেলা করতে হয়। ফলে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী গণমাধ্যম সঠিক সময়ে সঠিক সংবাদটি পরিবেশ করতে পারছে কিনা— তা নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়।
নানারকম সীমাবদ্ধতার ভেতরে থেকেও গণমাধ্যম কতটুকু নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ থেকে সংবাদ পরিবেশন করতে পারছে, তা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন আছে। কিন্তু এটিও মানতে হবে যে, একজন অ্যাক্টিভিস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় যত সহজে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারেন, একজন গণমাধ্যমকর্মী তার পত্রিকা, টেলিভিশন বা পোর্টালে তা পারেন না। প্রতিটি গণমাধ্যমকে অনেকগুলো পক্ষের কথা বলতে হয়। ফলে কোথাও তথ্যবিভ্রাট রয়ে যাচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে তাকে সতর্ক থাকতে হয়। যে কারণে অনেক সময়ই গণমাধ্যম জনমানুষের শতভাগ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না। উদার গণতান্ত্রিক দেশেও না। ওরকম বাস্তবতায় তথা একটা দারুণ শাঁখের করাতে অবস্থান করে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারছে এবং এর চেয়ে বেশি আর কী পারত— তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। তার অর্থ এই নয় যে, বিক্ষোভকারীরা টেলিভিশনের গাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। সাংবাদিককে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করবে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাকে রাস্তার ওপর ফেলে বেদম মারধর করবে। এটি কোনো সভ্য দেশে চলে না। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এখন সবার প্রতিপক্ষ। তাকে আন্দোলনকারীরা মারে, পুলিশও মারে। আবার সাধারণ মানুষও গালাগাল করে।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত চারজন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনলাইন পোর্টাল ঢাকা টাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার মেহেদী হাসান ও তৌহিদ জামান প্রিয় নিহত হয়েছেন রাজধানী ঢাকায়। আর সিলেটে নিহত হয়েছেন নয়া দিগন্ত পত্রিকার সাংবাদিক এটিএম তুরাব এবং গাজীপুরে ভোরের আওয়াজ পত্রিকার রিপোর্টার মো. শাকিল হোসেন। এছাড়া ছররা গুলিতে আহত হয়েছেন ৩৫ জনের বেশি। গুলি বা হামলার শিকার হয়ে আহত হয়েছেন প্রায় আড়াইশো গণমাধ্যমকর্মী। তাদের মধ্যে গুরুতর অবস্থা অন্তত ৬৭ জনের।
প্রসঙ্গত, মেহেদী হাসান গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ী এলাকায় সহিংসতার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। পরদিন ১৯ জুলাই দুপুরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে আন্দোলনের ছবি তোলার সময় ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক তৌহিদ জামান প্রিয় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। তিনি পুলিশ নাকি অন্য কারও গুলিতে নিহত হয়েছেন সেটি এখনও নিশ্চিত নয়।
সহিংসতার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে ডিবিসি, চ্যানেল আই, নাগরিক, বাংলাভিশন, এখন, এনটিভি, বৈশাখী, ৭১ টিভি, এশিয়ান টিভি, এটিএন বাংলা, নিউজ টোয়েন্টিফোর, মোহনা টিভি, দেশ টিভি, এসএ টিভি, একুশে টিভি, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, আরটিভি, যমুনা টিভি, সময় টিভির একাধিক রিপোর্টার ও ক্যামেরাপারসন আহত হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশে বিদেশি সংবাদমাধ্যমে কর্মরত তিন জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন বলেও জানা গেছে।
আর পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালের যে সাংবাদিকরা আহত হয়েছেন তাদের মধ্যে প্রথম আলোর তিন জন, কালের কণ্ঠ পত্রিকার ছয় জন, প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকার তিন জন, বাংলা ট্রিবিউনের পাঁচ জন, ঢাকা ট্রিবিউনের একজন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের দুজন, সমকালের দুজন, ডেইলি স্টারের তিন জন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের একজন, দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার নয় জন, জনকণ্ঠের চার জন রয়েছেন। মানবজমিনের ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের শরীরে ছয়টি ছররা গুলি লাগে। এর বাইরে আরও অনেক পত্রিকার রিপোর্টার ও ফটোসাংবাদিক আহত হয়েছেন।
এরকম পরিস্থিতিতে গত ৩১ জুলাই নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেছেন, বাংলাদেশে গুলি ব্যবহারের যে দৃশ্য জাতিসংঘ দেখেছে, তারা তার নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেকোনো দেশে মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার সরকারকে রক্ষা করতে হবে। এ সংক্রান্ত খবরটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রে ০১ অগাস্ট ২০২৪ প্রকাশিত হয়েছে।
২.
গণমাধ্যমকর্মীরা এরকম আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু যে এই প্রথম হলেন তা নয়। করোনা মাহামারীর সময়েও ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (বর্তমান নাম সাইবার নিরাপত্তা আইন) ও অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টে অসংখ্য সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেকে জেল খেটেছেন। এর বাইরে মানহানির মামলা অহরহ। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এসব মামলার পেছনে রয়েছে ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশজনিত ক্ষোভ। অর্থাৎ যার বিরুদ্ধে সংবাদ যায়, তিনিই তখন সাংবাদিকের প্রতিপক্ষ।
বাস্তবতা হলো, পৃথিবীর কোনো দেশের গণমাধ্যমই তার দেশের জনগণের শতভাগ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না। এটি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রকাঠামো, গণমাধ্যমের ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষা এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের আইন ও নীতিমালার ওপর। তবে কোনো একটি ইস্যুতে একইসঙ্গে সব গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠান একই ধরনের আচরণ করবে, এমন নয়। যেমন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়েও সব পত্রিকার সংবাদ ট্রিটমেন্ট এক নয়। কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সাহসী ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করে। এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের মালিকানা এবং পরিচালনায় যারা আছেন, তাদের সাহস, নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা, পেশাদারি এবং সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ওপর। ফলে দিনশেষে বিচারের ভার পাঠক ও দর্শকের কাছেই। কোনটি সত্যিই গণমাধ্যম আর কোনটি প্রচার-প্রোপাগান্ডা মেশিন, সেটি বোঝার মতো জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান মানুষের আছে।
মোদ্দা কথা হলো, গণমাধ্যম যদি কোনো কারণে সঠিক সময়ে সঠিক সংবাদটি পরিবেশন করতে নাও পারে বা জনগণের প্রত্যাশা শতভাগ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তারপরও তার ন্যূনতম পেশাদারি বজায় রাখার চেষ্টা করা উচিত। সত্য বলতে না পারলেও তাকে যাতে অন্তত মিথ্যা বলতে না হয় বা মিথ্যার পক্ষে সাফাই গাইতে না হয়—সেরকম একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা দরকার।