রুমিন ফারহানার ভবিষ্যদ্বাণী কিসের ইঙ্গিত?

রুমিন ফারহানার ভবিষ্যদ্বাণী কি শুধুই কথার কথা? না এর পেছনে আছে অন্য কোনো কারণ?

বিপ্লব কুমার পালবিপ্লব কুমার পাল
Published : 29 Nov 2022, 11:46 AM
Updated : 29 Nov 2022, 11:46 AM

“২০২৪ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে বিএনপি।” এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা। বলেছেন, “২০২৪ সালে আমরা ক্ষমতায় যাব। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। ইভিএম মানি না। সারা দুনিয়ায় যখন ব্যালটে ভোট, শেখ হাসিনা কেন ইভিএমে ভোট চায় বুঝি না।”

রুমিন ফারহানার এই বক্তব্য ঘিরে চলছে সমালোচনা। অনেকে বলছেন, সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা কবে থেকে জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করছেন? তিনি কীভাবে নিশ্চিত ভবিষ্যত দেখতে পেলেন? কুমিল্লায় বিএনপির বিভাগীয় সমবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে রুমিন আরও বলেন, “১৪ বছরে দেশটারে লুট করছেন। যা যা করছেন তার হিসাব নেব।”

প্রধানমন্ত্রীর কাজের হিসেব নিতে চেয়েছেন রুমিন ফারহানা। দিয়েছেন হুমকিও। তবে রুমিন নিজের মোবাইল ফোনটি রক্ষা করতে পারেননি। সমাবেশে তার ব্যাগ থেকে মোবাইলটি চুরি হয়ে গিয়েছে। রুমিন ফারহানা বলেন, “শুক্রবার রাতে কুমিল্লার টাউনহল মাঠে জনস্রোত দেখতে আসি। এরপরই আমার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি চুরি হয়ে যায়।” ওইদিন শুধু রুমিন ফারহানার নয় অনেকের মোবাইল ফোনই চুরি হয়েছে। সমাবেশে আসা একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর ফোন চুরি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, নিজের লোকজনের কাছ থেকে নিজের মোবাইল যারা রক্ষা করতে পারে না, তারা আবার দেশের মানুষকে কীভাবে রক্ষা করবে? তাছাড়া রুমিন ফারহানা কোন গ্রহ-নক্ষত্র গণনা করেছেন, যার ফলে তিনি দেখতে পেয়েছেন ২০২৪ সালে ক্ষমতায় আসবে বিএনপি।

রুমিন ফারহানা হঠাৎ করে কেন এই ভবিষ্যদ্বাণী করলেন? শুধুই কি কথার কথা? না এর পেছনে আছে অন্য কোনো কারণ? তাছাড়া ১০ ডিসেম্বর নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত কেন বিএনপি? এই সূত্র কি একই সুতোয় বাঁধা? এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে।

তবে ১০ ডিসেম্বর কী হতে পারে তারও একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন রুমিন ফারহানা। কুমিল্লার সমাবেশ থেকে পুলিশের উদ্দেশে রুমিন বলেন, “র‍্যাব আমাদের ভাইদের গুলি করছে। তাদের আমেরিকা নিষিদ্ধ করেছে। আপনারা গুলি করবেন না, তাহলে আপনাদেরও নিষিদ্ধ করবে।”

সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। আগামী ১০ ডিসেম্বের বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর।

গত বছরের ওই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করেই আসেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, কখনো কখনো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এবং দেশকে শাস্তি দিতে নিষেধাজ্ঞা আসে। আবার কখনো সতর্ক করতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। র‍্যাবের বিরুদ্ধে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট সিনেটরদের একটা দল তখনকার ট্রাম্প সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর কাছে একটা চিঠি দিয়েছিল। তাতে তারা র‍্যাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল। আর গত বছরের অগাস্টে কংগ্রেসে র‍্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে শুনানি হয়। তাতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি জবানবন্দি দিয়েছিলেন। এই দুটো ঘটনা এবং নিষেধাজ্ঞার মধ্যে যদি সরলরেখা টানা হয়, তাহলে এই ঘটনাগুলো একটার সাথে আরেকটা সম্পর্কিত– যার পরিণতি এই নিষেধাজ্ঞা।

রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট সিনেটরদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে তদবির করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট ফার্মের পেছনে তিন বছরে বিএনপি দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১৭ কোটি টাকা) খরচ করেছে। গত ১৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছিলেন, ২০১৫ সালে বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের ঠিকানায় একটি সংস্থার (লবিস্ট ফার্ম) সঙ্গে মাসিক ৫০ হাজার ডলারের চুক্তি হয়েছিল। তিন বছর তা অব্যাহত ছিল। খরচ হয় দুই মিলিয়ন ডলার।

বিএনপি-জামায়াত লবিস্ট নিয়োগ করে তাদের অপচেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নামে নিষেধাজ্ঞা আনার ষড়যন্ত্র চলছে। অবশ্য কোনো ঘোষণা না আসা পর্যন্ত কিছু বলা যায় না। তবে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা। কুমিল্লার সমাবেশে পুলিশের উদ্দেশে করা তার মন্তব্য এমন কিছুরই ইঙ্গিত হয়ত।

আগামী ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে বিএনপি খুব সক্রিয়। তারা আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, ১০ ডিসেম্বরের পর সবকিছু চলবে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে। হঠাৎ করে বিএনপি এত জোর কোথায় পাচ্ছে? সরকারকে দিনক্ষণ বেধে দিয়ে হুমকি দিচ্ছে কেন? এটা কি শুধুই তাদের কথার কথা? না এর পেছনে কোনো আশ্বাস আছে? যে বিএনপি গেল ১৪ বছরে কোনো ইস্যুতে সরকারবিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, তারাই এভাবে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে কীভাবে?

আগামী ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে সমাবেশ করে বড় ধরনের শক্তি দেখাতে চায় বিএনপি। যদিও তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি পেয়েছে। তারপরও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “সময় থাকতে কেটে পড়েন, না হলে পালানোর জায়গা পাবেন না। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ পল্টনেই হবে।”

২০১৩ সালেও সরকারকে পদত্যাগের জন্য এভাবে দিনক্ষণ বেধে দিয়েছিলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। ৫ মে হেফাজতে ইসলামের পূর্বঘোষিত কর্মসূচির কারণে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার পরিবর্তে তিনি ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেধে দিয়েছিলেন। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছিল প্রেসিডেন্ট হবেন আল্লামা আহমদ শফী এবং প্রধানমন্ত্রী জুনায়েদ বাবুনগরী। একই দিন সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকেও বার্তা এসেছিল, হেফাজতের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বিএনপি এবং তার অঙ্গ-সংগঠনের সকল নেতা-কর্মীদের হেফাজতের পাশে দাঁড়ানোর।

নয় বছর পর আবারও সেই ‘ছয়’-এর ইঙ্গিত। মানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বাইরে ‘নয়-ছয়’-এর ছক। কিন্তু এবার তো হেফাজতে ইসলাম মাঠে নেই। তাহলে ছকটা হবে কীভাবে? সেটা কিছুটা খোলসা করেছেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা। বিএনপির বিশ্বাস, র‍্যাব বিএনপি নেতা-কর্মীদের হত্যা করেছে, তাই আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে, সরকার পুলিশ দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করছে, হত্যা করছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে পুলিশের ওপর যদি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে সরকারবিরোধী আন্দোলনের বড় অস্ত্র পাবে বিএনপি। তীর্থের কাকের মতো সেদিকপানেই চেয়ে আছে সরকার বিরোধীদলগুলো।