বিদায়বেলায় ‘জেনোসাইড জো’ নামে পরিচিতি পাওয়া বাইডেন কি অনুতপ্ত? নিজের দলের এত বড় হারের পরে তিনি কি বুঝতে পারছেন গত নির্বাচনে তরুণদের ও মুসলমানদের ভোট ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কি-যে প্রয়োজন ছিল! বাইডেন সেদিন যে বইটা কিনেছেন এটা যদি চার বছর আগে কিনতেন, তাহলে গাজা যুদ্ধ কি অন্য রকম হতো?
Published : 23 Dec 2024, 12:48 PM
জো বাইডেন এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প শপথ না নেওয়া পর্যন্ত তিনিই প্রেসিডেন্ট থাকবেন। তবে ‘লেম ডাক’ বা ‘খোঁড়া হাঁস’ প্রেসিডেন্ট হয়ে। এই সময়টাতে তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিবেন, হোয়াইট হাউস ছাড়ার জন্য নিজের জিনিসপত্র গোছাবেন, টুকটাক ছোটখাট কাজ করবেন। কিন্তু দেশের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী কোনো ব্যাপারে তার কোনো ভূমিকা নেই, যদি না কোনো বড় রকমের সংকট দেখা দেয়। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোও সাধারণত সংবাদ প্রকাশের ব্যাপারে সাবেক হওয়ার অপেক্ষায় থাকা প্রেসিডেন্টকে উপেক্ষা করে। তাদেরকে দোষ দেওয়া যায় না, নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের নানান ধরণের খবরের ভিড়ে স্থান বা সময় সংকুলান করা সহজ ব্যাপার নয়।
এত কথা বলার কারণ শুধু একটাই– প্রেসিডেন্ট বাইডেন ২০২৪ সালের ২৯ নভেম্বর, থ্যাঙ্কস গিভিংয়ের পরের দিন ম্যাসাচুসেটসের নান্টকেটের এক বুক স্টোরে নিজে গিয়ে একটা বই কিনেছেন। এই বই কেনাটাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ আর জল্পনা-কল্পনা চলছেই।
নিউ ইয়র্কের জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’ বাইডেনের এই বই কেনা নিয়ে তাদের ২৯ নভেম্বর তারিখের অনলাইন এবং ৩০ তারিখের প্রিন্ট সংস্করণে ছবিসহ বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করেছে। তারা মন্তব্য করেছে, “যারাই বাইডেনের হাতে এই বইটা দেখেছে তারা সবাই খুব বিস্মিত হয়েছে।” তারা হোয়াইট হাউসের মন্তব্যও চেয়েছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। লেখক রাশিদ খালিদিও ‘নিউ ইয়র্ক পোস্টে’র সঙ্গে খুব বেশি কথা বলতে চাননি, তিনি শুধু পাঁচটা শব্দ বলেছেন, “চার বছর দেরি হয়ে গেছে।”
রবার্ট মুরডকের ‘ফক্স নিউজ’ লিখেছে, “প্রেসিডেন্ট বাইডেন একটা বই কিনেছেন যেটাতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের মুখে ইসরায়েলকে একটা ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও তিনি সবসময় ইসরায়েল রাষ্ট্রকে সহায়তা করে আসছেন।”
ইসরায়েলের সংবাদপত্র ‘জেরুসালেম পোস্ট’ নভেম্বরের ৩০ তারিখ শিরোনাম দিয়েছে, “বাইডেনেকে দেখা গেছে একটা ইসরায়েল বিরোধী বই হাতে, যেটাতে ইসরায়েলকে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।”
ব্রিটেনের পত্রিকা ‘ডেইলি মেইল’ লিখেছে– “প্রেসিডেন্ট বাইডেন ব্ল্যাক শুক্রবারের বাজারে গিয়ে ‘ফিলিস্তিনিদের উপর শত বছরের যুদ্ধ: বসতি স্থাপনকারী ঔপনিবেশিকতাবাদের আগ্রাসন ও প্রতিরোধ, ১৯১৭ তো ২০১৭’ বইটা কিনে এবং তা প্রদর্শন করে অনেক পত্রিকার শিরোনামে এসেছেন। এই বই কিনার ঘটনাটা ঘটেছে, বাইডেনের ৬০ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নেতানিয়াহু যখন অগ্রাহ্য করেন, তার পরপরই।”
বাইডেনের নামের আগে গাজায় গণহত্যার জন্য ‘জেনোসাইড’ শব্দটা গেঁথে গেছে। বিদায়বেলায় ‘জেনোসাইড জো’ নামে পরিচিতি পাওয়া বাইডেন কি অনুতপ্ত? নিজের দলের এত বড় হারের পরে তিনি কি বুঝতে পারছেন গত নির্বাচনে তরুণদের ও মুসলমানদের ভোট ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কি-যে প্রয়োজন ছিল! বাইডেন সেদিন যে বইটা কিনেছেন এটা যদি চার বছর আগে কিনতেন, তাহলে গাজা যুদ্ধ কি অন্য রকম হতো? তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি চিরকালই ইহুদিবাদের ঘোর সমর্থক ছিলেন, এই বইটা পড়ার পর বাইডেন কি মত পাল্টাবেন? নাকি পুরোটাই তার লোক দেখানো।
বাইডেনের এই একটা বই কেনা নিয়ে কেন আমরা এত সব জল্পনা-কল্পনা করছি? সাধারণত একজন ক্রেতা যখন একটা বই কিনেন, দোকানদার টাকা নিয়ে বইটা একটা থলিতে ঢুকিয়ে ক্রেতার হাতে তুলে দেন। ক্রেতা থলেটা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন। কি বই, কিসের বই, কারো জানার উপায় নেই, সম্ভবত প্রয়োজনও নেই। কিন্তু বাইডেন বইয়ের থলেটা দোকানের ভেতরেই ফেলে দিলেন, বইটা তিনি তার বুকের নিচে ধরে এমন ভাবে বের হয়ে আসলেন যেন বাইরে দাঁড়ানো সব সাংবাদিকেরা ও অন্যান্য জনগণ সবাই বইটার নামধাম ও ওপরের বড় লেখাগুলো ভালোভাবে দেখে। দেখা গেল বাইডেনের হাতে যে বইটি তার নাম– ‘দ্য হান্ড্রেড ইয়ার্স ওয়ার উইথ প্যালেস্টাইন’ (‘ফিলিস্তিনিদের ওপর শত বছরের যুদ্ধ’), লেখক রাশিদ খালিদি যিনি এককালে ফিলিস্তিনি লিবারেশন সংস্থার সদস্য ছিলেন, বর্তমানে তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এই বইটা ফিলিস্তিনিদের ওপর ইহুদিবাদীদের সহিংসতা ও ঔপনিবেশকতার একটা প্রামাণ্য দলিল।
জো বাইডেন হঠাৎ এই বইটা কিনতে গেলেন কেন? আর কিনলেও বা এটাকে এত ঘটা করে প্রকাশ্যে সবাইকে দেখানোর কারণইবা কি? ‘মাইক্রোসফট নেটওয়ার্ক নিউজ’ লিখেছে, “বইটা ১৯১৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের দখলবাজ ও ঔপনিবেশিকতার একটা ইতিহাস। এই বইতে খালিদি যুক্তি দিয়েছেন যে, ফিলিস্তিনিরা যেহেতু ইসরায়েলি সামরিক দখলদারিত্বে বাস করছে, তাদের অধিকার আছে সশস্ত্র সংগ্রাম করে এর থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করার। অনেক আরব মার্কিনি যারা সাধারণত ডেমোক্রেটিক পার্টিকে সবসময় ভোট দিয়ে আসছে, কিন্তু এবার ভোট পরিবর্তন করে তারা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে, কারণ বাইডেন গাজা যুদ্ধে যেভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়েছেন সেটা তাদের ক্ষুব্ধ করেছে।”
এই বইটা প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালে। রাশিদ খালিদি এই বইয়ের একদম শেষে লিখেছেন, “ফিলিস্তিনি জনগণ যারা ইসরায়েলি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ এক কঠিনতম যুদ্ধে রূপ দিয়েছে, তারা খুব সহসা এর সুফল আশা করবেন না। তারা অস্বাভাবিক ধৈর্য্য, সাহসিকতা, ঐকান্তিকতা ও দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, নিজেদের অধিকারক প্রতিষ্ঠিত করতে। সেই জন্যই আজও তাদের স্বাধীনতার অধিকার জ্বলজ্বলে জীবিত।”
রাশিদ খালিদি ২০২০ সালে যা বলেছেন, আজ এতদিন পরে তা আরো শতগুণ সত্য হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। গাজায় পঞ্চাশ হাজার নিরীহ জনগণকে ইসরায়েলিরা হত্যা করার পরও, ফিলিস্তিনিরা এখনো মাথা উঁচিয়ে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে এবং জানান দিচ্ছে তাদের স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে।
যে ঘটনাটা রাশিদ খালিদির বইতে নেই, সেটাও ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রথম যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তিনি ছিলেন হ্যারি ট্র্রুম্যান, যিনি ছিলেন তুমুল ইহুদিবিদ্বেষী এবং সবার সামনে ইহুদিদেরকে খুব বাজে ভাষায় গালিগালাজ করতেন। তার একজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, যার নাম ইডি জ্যাকোবসন, যিনি এককালে ট্র্রুম্যানের ব্যাবসায়িক অংশীদার ছিলেন এবং দুজন একসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১৩ মার্চের সকালবেলা ইডি কোনো আগাম জানান না দিয়েই চলে এলেন হোয়াইট হাউসে। এসে বললেন, “হ্যারি তোমাকে একটু চাইম ওয়াইজম্যানের সঙ্গে দেখা করতে হবে, তিনি ইহুদিবাদীদের একজন আধ্যাত্মিক নেতা এবং আমি তার খুব বড় ভক্ত।”
ট্র্রুম্যান খুব রেগে গেলেন, চেয়ার ঘুরিয়ে ইডিকে পেছন দেখিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় গালিগালাজ করলেন। ইডি জ্যাকোবসনও ছাড়ার পাত্র নন। উপায় না দেখে ট্র্রুম্যান বললেন, “কুত্তার বাচ্চা, টাকওয়ালা, যা তোর ওয়াইজম্যানের সঙ্গে একবার দেখা করব।”
ওয়াইজম্যান একদিন দেখা করলেন ট্র্রুম্যানের সঙ্গে। বন্ধুর খাতিরে ট্র্রুম্যান রাজি হলেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করতে। এই সাক্ষাতের এগারো মিনিট পর ইসরায়েল তার স্বাধীনতা ঘোষণা করল। ট্র্রুম্যান ১৯৪৮ সালের মে মাসের ১৮ তারিখে তার স্টেট ডিপার্টমেন্টকে এক মেমো পাঠালেন, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার সব ব্যবস্থা করতে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট, কংগ্রেস ও সিনেটের নেতৃবৃন্দ প্রথমে খুব বিরোধিতা করছিলেন, সবাই ছিল ঘোর ইসরায়েলবিরোধী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বৈদেশিক নীতিতে প্রেসিডেন্টই সর্বেসর্বা। ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্কই শুরু হয়েছিল দুজন লোকের বন্ধুত্বে, পঁচাত্তর বছরে এত এত প্রেসিডেন্টের আসা–যাওয়ার মধ্যেও এই সম্পর্কের কোনো চিড় ধরেনি, সব প্রেসিডেন্টই এই দুই বন্ধুর লাগানো জোয়াল এখন পর্যন্তই টানছেন। আর এই বন্ধুত্বের জোয়ালের জন্য ফিলিস্তিনিদেরকে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে বছরের পর বছর।
জানুয়ারির ৪ তারিখ জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে যাবেন। এরপর আসবেন ডনাল্ড ট্রাম্প, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে ট্রাম্পের কথাই হবে শেষ কথা। জো বাইডেন ফিলিস্তিন নিয়ে মত পরিবর্তন করেছেন না অন্য কোনো সংকেত দিচ্ছেন, তাতে কিছুই যায় আসে না। ইসরায়েলিদের জন্য ফিলিস্তিনিদের যতটুকু ক্ষতি করার দরকার ছিল, তা তিনি করে গেছেন। অবসর নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি এমনকি ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বেও তার কোনো প্রভাব থাকবে না। সুতরাং বাইডেনের এই বইটা কেনা নিয়ে যারা এত হৈ চৈ করছেন, তারা বৃথাই সময় নষ্ট করছেন। তবে অন্য প্রেসিডেন্টদের জন্য এর থেকে একটা শিক্ষা রয়েছে– মধ্যপ্রাচের নীতিনির্ধারণের আগেভাগে দয়া করে বইটা পড়ে নিন, বাইডেনের মত চার বছর দেরি করবেন না।