আমাদের সন্তানদের আত্মত্যাগ, রক্ত, চোখের জল বৃথা যেতে পারে না। এ জন্য ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। কেউ যেন ফ্যাসিস্ট হতে না পারে, ফ্যাসিস্ট হয়ে ক্ষমতায় থাকতে না পারে, তেমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
Published : 08 Aug 2024, 05:25 PM
এবার শ্রাবণ মাসটা বড় বিষাদের কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। এই মাসে মেঘলা আকাশ এমনিতেই মনটাকে ভারাক্রান্ত করে। বৃষ্টি নামলে তো মনটা আরও আনমনা হয়ে যায়। এবার শ্রাবণে অবশ্য তেমন বৃষ্টির দেখা মেলেনি। তবে বেশিরভাগ দিনই আকাশে মেঘ দেখা গেছে। বৃষ্টি না ঝরলেও এবার শ্রাবণজুড়ে দেশের মানুষ ভিজেছে। হ্যাঁ, ভিজেছে ক্ষোভ-প্রতিবাদের উষ্ণ ঘামে। প্রিয়জনের রক্তবৃষ্টিতে! শোকের কান্নায়।
তিন সপ্তাহের আন্দোলনে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে চরম ফ্যাসিস্ট শাসক হিসেবে আবির্ভূত শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিরীহ একটি আন্দোলন থেকে এই গণঅভ্যুত্থান। সেই অভ্যুত্থানে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিভে যায় শত শত প্রাণ। এর বিনিময়ে অবিস্মরণীয় এক জয়ের দেখা পেয়েছে ছাত্র-জনতা। জনবিক্ষোভ দমাতে নির্বিচারে গুলি চালিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি শেখ হাসিনার। অবশেষে গত ৫ অগাস্ট যবনিকা ঘটে সাড়ে ১৫ বছরের একচ্ছত্র শাসনের। ওইদিন দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে তিনি ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে উড়াল দেন। এর আগেই দেশজুড়ে কোটি মানুষ পথে নেমে বিজয় উল্লাসে মাতেন; নেন গণভবনের দখল।
রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের আত্মত্যাগের পথ ধরে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, মজুরসহ শত শত মানুষ শ্রাবণের ২১ দিনে চরম ফ্যাসিস্ট শাসকের বন্দুকের নলের সামনে বুকে পেতে দাঁড়ানোর নজিরবিহীন সাহস দেখান। বিরলতম এ আত্মত্যাগে বিজয়ী হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। জনজোয়ারে ভেসে গেছে ক্ষমতার দম্ভ। ‘অবিকল্প’ হিসেবে মিথ হয়ে ওঠা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের সিংহাসন।
জগদ্দল পাথরের মতো দেশবাসীর বুকে চেপে বসা স্বৈরশাসনের অবসানের পর দেশবাসী উল্লাসে মেতেছে। কিন্তু রয়ে গেছে এক বিষণ্ণ অনুভূতি। কেন এমন হলো? কেন এই অগাস্ট মাসে যে দলটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই দলটি গণরোষের শিকার হলো? কেন দলের নেতাদের পিটিয়ে-পুড়িয়ে মারা হচ্ছে? কেন দলের প্রধান নেত্রী যিনি টানা পনের বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাকে ভীরুর মতো প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে হলো? কেন দেশের বুকে এক রক্তস্নাত ইতিহাস রচিত হলো?
এর পেছনে ছিল যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার উদগ্র বাসনা। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি সবরকম প্রতিবাদ-আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করেছেন। ভিন্নমতকে গলাটিপে বন্ধ করেছেন। চরম কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করেছেন। সবাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা-অপমান করেছেন। নিজ-পরিবারকে উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। কেবল চালাকি আর কৌশল দিয়ে রাজনীতির মাঠে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হতে চেয়েছেন। লুটেরা-অর্থপাচারকারীদের সহায় হয়েছেন। দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে দাঁড়ানো শিশুদের বিরুদ্ধেও তিনি পুলিশ আর ছাত্রলীগের গুণ্ডাদের লেলিয়ে দিয়েছেন। তিনি সবসময় ক্ষমতার অন্দরমহলটাকে অন্ধকার রেখে দেশ শাসনের চেষ্টা করেছেন।
রক্ত-শ্রাবণ অনেক লাশ, রক্ত, ক্ষতি ও ক্ষতের চিহ্ন রেখে গেছে। তবু এখনো মানুষ অনেক কিছুই জানে না। গত পনের দিনে ঠিক কতজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, ওই তথ্য এখনো অজানা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু কিছু ভিডিও সামনে আসছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে কী নির্মমভাবে আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে! কেন এমন নির্মমতা দেখানো হলো? সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলে কি রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে হয়?
ঘটনা ঘটে যাওয়ার অনেক পরে মানুষ কিছু কিছু জানতে পারে। কিছুটা আভাস-ইঙ্গিত দেখে, কিছুটা অনুমানে বুঝে নেয়। এটাই হয়তো নিয়ম! যেমন দেশের মানুষ শুনতে পেত হাসিনা সরকারের শাসনামলে ‘আয়নাঘর’ নামে একটা গোপন টর্চার সেল আছে, কিন্তু জানত না সেখানে গ্রেপ্তার বা গুম করা ব্যক্তিদের কেমন কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো। বছরের পর বছর আলোবাতাসহীন এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হতো অনেককে! এই ‘আয়নাঘর’ আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ানতানামো কারাগারের কথা মনে করিয়ে দেয় যা বন্দিদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এখন এই ‘আয়নাঘর’ থেকে অনেকেই মুক্ত হয়ে আসছেন। তাদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে এই ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ আটকে রেখে ভয়াবহ নির্যাতনের সব আখ্যান। অনেকের হাড়-হাড্ডি-কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে।
গত পনের দিন ধরে দেশের কোথায়, কী হয়েছে দেশবাসী পুরোটা জানে না। ৫ অগাস্ট বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত দেশে কী হচ্ছে তা-ও অস্পষ্ট। ৫ অগাস্ট থেকে কার্যত দেশে কোনো সরকার নেই। থানা-পুলিশ নেই। দেশের অধিকাংশ থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন থানাগুলোর সৎকার করা হয়েছে। থানাগুলোর সামনে দাঁড়ালে বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। হামলা-ভাঙচুর ও আগুনে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া থানা ভবন; যেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, নেই প্রাণের কোনো চিহ্ন। বাতাসে পোড়া গন্ধ, সড়কে কালো ছাইয়ের আস্তরণ। বিভিন্ন স্থানে পড়ে আছে পুলিশের ক্যাপ, জামা, জুতো। রয়েছে পুড়ে যাওয়া যানবাহনের কাঠামো। উৎসুক মানুষের ভিড়। এখনো অনেক থানা থেকে বের হচ্ছে পুলিশের পোড়া লাশ।
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকেই থানাগুলো আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সারাদেশে ৪৫০টির বেশি থানায় হামলা হয়েছে। ভাঙচুর, লুটপাট-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পিটিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে শতাধিক পুলিশকে।
ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রাণ নিয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। কিন্তু নিজ দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছেন। সরকার পতনের পর আন্দোলনকারীরা রাজপথে বিজয়োল্লাসে মেতেছেন। এই সুযোগে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নানা অপশক্তি। এই অপশক্তির দেওয়া প্রতিহিংসার আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়ি। তাদের দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় সম্পদও বাদ যায়নি। হামলা হচ্ছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপসনালয়ে। ভাঙচুর, লুটপাট, ডাকাতিও হচ্ছে। ঠেকানোর কেউ নেই। অভিযোগ করার কোনো জায়গা নেই! শান্তি-সম্প্রীতি রক্ষার বাণী আক্রমণকারী পাষণ্ডদের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারছে না। সবখানে চলছে আতঙ্ক, ভয়। কে কোথায় আক্রান্ত হয়, কার বাড়িঘর হামলা বা লুটপাটের শিকার হয় কেউ জানে না। গত ১৫ দিনে দেশে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তা দেশবাসী এর আগে কখনো দেখেনি। গত তিনদিনে যে পরিমাণ বল্গাহীন সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-লুটপাট হয়েছে, তেমন ঘটনাও এর আগে কেউ প্রত্যক্ষ করেনি। সারাক্ষণ একটা কী-হয় কী-হয় অবস্থা। মানুষ ঘুমাতে পারছে না। একটু স্বস্তি পাচ্ছে না।
স্বৈরাচার পতনের উৎসবের পর অতিক্রান্ত হয়েছে তিন দিন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আপাতত ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছে। পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে। রাত জেগে সরকারের রূপরেখাও দিচ্ছে।
যখন দেখি সারাদিন ধরে ছেলেমেয়েগুলো ট্রাফিকের কাজ করছে, সংসদ ভবন ঝাড়ু দিচ্ছে, তখন মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়! ইচ্ছে করে, আর্তনাদ করে কাঁদি! এই ছেলেমেয়েগুলোকে কেন আজ ঝাড়াঝাড়ি, ময়লা পরিষ্কারের কাজ করতে হচ্ছে? এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে ওরা এই কাজ করছে! মাত্র কদিন আগেই ‘যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার’ বাসনা থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ওদের বন্ধুদের গুলি করে হত্যা করেছে। ওরা ঘুমাতে পারে না। চোখ বন্ধ করলেই দেখে বিচিত্র ফুলের মতো ওদের বন্ধুগুলো রক্তজবা হয়ে সামনে তাকিয়ে হাসছে!
এই ছেলেমেয়েগুলো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার সময় রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স চলার আলাদা পথ তৈরি করেছে! কারণ যেদিন ওদের প্রতিবাদী মিছিলে গুলি করা হয়, সেদিন রক্তাক্ত দেহকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সের খুব প্রয়োজন ছিল! কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করেও তা পায়নি! চারদিকে নির্মম বুলেটের শব্দ আর মাথার উপর কাকের উড়াউড়ির শব্দ শুনতে শুনতে একসময় ওদের অনেকে রাজপথেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওই ঘুম কারও ভেঙ্গেছে, কেউ ঘুমের দেশেই থেকে গেছে! এখন যা করছে, এসব ওদের কাজ নয়। ওদের তো পড়ার টেবিলে থাকার কথা। তাহলে ওরা আজ কেন রাজপথে? কেন ওদের খুনে রাঙানো রাজপথ?
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা দেখছি, এক দল বিদায় নিতে না-নিতেই শিক্ষার্থীদের রাজপথে দাঁড় করিয়ে রেখে তাদের সহযোদ্ধার রক্তভেজা পথের ওপর দাঁড়িয়ে আরেকটি দল ও তাদের সঙ্গীরা নিজেদের হায়েনা-দাঁত দেখাতে শুরু করেছে। চারদিকে পৈশাচিক নৃত্য শুরু হয়ে গেছে।
এই সব উল্লাসরতদের চরিত্রও আমাদের অজানা নেই। এদেরকেও থামাতে হবে। আমাদের সন্তানদের আত্মত্যাগ, রক্ত, চোখের জল বৃথা যেতে পারে না। এ জন্য ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। কেউ যেন ফ্যাসিস্ট হতে না পারে, ফ্যাসিস্ট হয়ে ক্ষমতায় থাকতে না পারে, তেমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। এক ফ্যাসিস্টের বদলে আরেক ফ্যাসিস্ট চাই না। শিক্ষার্থীরা এখনো বুক চিতিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সঙ্গে থাকতে হবে। এই দেশের শিক্ষার্থীদের বুকে আর যেন কেউ কোনোদিন গুলি চালানোর সাহস না পায়, তা সবাই মিলে নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা পড়বে। খেলবে। আনন্দ করবে। তাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু নিশ্চিত করতে হবে। ওদের আর যেন কখনো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে না হয়।
এবারের মতো রক্ত-শ্রাবণ দেশে যেন আর কখনো না আসে সেই শপথ হোক দেশের সবার।