“ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামের চলতি গণহত্যা একা ইসরায়েল কর্তৃক পরিচালিত না। এটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, বাকি ইইউ ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো দ্বারা সংঘটিত একটি পশ্চিমা গণহত্যা।”
Published : 09 Oct 2024, 05:41 PM
এই ৭ অক্টোবর ছিল গাজায় শুরু করা ইসরায়েলি গণহত্যার বর্ষপূর্তি। যে হত্যাযজ্ঞ এখনও চলমান। কবে ও কিভাবে এই গণহত্যার শেষ হবে কেউ জানে না। শুধু তাই নয়, এই গণহত্যা এখন বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। লেবাননে চলছে ইসরায়েলি হামলা এবং ইরান হুমকির মুখে। স্বদেশে ইসরায়েলিরাও নিরাপদ নয়। এর অভিঘাত পড়বে বিশ্বজুড়ে।
এ পর্যন্ত ৪২ হাজার ফিলিস্তিনবাসী মৃত্যুবরণ করেছে ইসরায়েলি হামলায়। আহত হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। নিহতদের দুই তৃতীয়াংশ শিশু, নারী ও বৃদ্ধ। ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানের নিচে চাপা পড়ে আছে আরও অজানা অনেক মানুষ। এ ছাড়াও হামলার কারণে খাদ্যাভাবে, আহত হয়ে ও চিকিৎসার অভাবে অনেকের মৃত্য ঘটবে। এসব হিসাবে ধরলে প্রকৃত নিহতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ২ লক্ষ— জুলাই মাসে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল ল্যান্সেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের মতে নিহত ১,৮৬,০০০।
এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী দুজন হলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতনিয়াহু ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। খটকা লাগতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের ও তার প্রেসিডেন্টের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এই গণহত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের দায় কেবল ক্রাইম অব ওমিশন অর্থাৎ চুপ থাকার বা কিছু না করার— ক্রাইম অব কমিশন অর্থাৎ সক্রিয় অংশগ্রহণের দায় নয়। কিন্তু মোটেও তা নয়। জো বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র এই গণহত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।
গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র তার সহযোগী ইসরায়েলের সাহায্যে ব্যয় করেছে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলোয় মোট যে সামরিক সাহায্য দেয় তার অর্ধেকের বেশি দেয় এক ইসরায়েলকে। এটি কোনো স্বাভাবিক রাষ্ট্র নয়, ব্রিটেন-আমেরিকা কর্তৃক ফিলিস্তিনবাসীদেরকে উচ্ছেদ করে তাদের জন্মভূমিতে জোরপূর্বক বসানো একটি কৃত্রিম বর্ণবাদী রাষ্ট্র। এ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যকে কব্জায় রাখার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের নামে একটি পশ্চিমা সামরিক স্থাপনা যার প্রধান সংরক্ষক যুক্তরাষ্ট্র। সে কারণে স্বাভাবিকভাবে ও সঠিকভাবেই গাজায় এই হামলা বা তথাকথিত যুদ্ধ ইউএস-ইসরায়েল গণহত্যা নামে পরিচিতি লাভ করেছে— অবশ্যই মূলধারার গণমাধ্যমগুলোয় নয়, এই গণহত্যায় যাদের ভূমিকা ন্যাক্কারজনকভাবে দাসত্বসুলভ।
‘ইয়েস্টারডেস ম্যান: দা কেস অ্যাগেইনস্ট জো বাইডেন’ বইয়ের লেখক ব্রাঙ্কো মার্সেটিক (‘ওয়ান ইয়ার অন, গাজা ইজ ডেমোক্র্যাটস ফার-রাইট ওয়ার’, জ্যাকোবিন, ৭ অক্টোবর ২০২৪) লিখেছেন, “আমরা যদি এ শতাব্দীতে যুদ্ধবাজ লাম্পট্যের কথা ভাবি, হয়তো ইউক্রেনে রাশিয়ার ঘৃণ্য যুদ্ধের কথা বলব যেখানে দুই বছরে শিশু, যুবক ও বৃদ্ধসহ ১১ হাজার সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। এখন ভাবি মার্কিন-ইসরায়েলি যুদ্ধের কথা যা এই সংখ্যক শিশুই হত্যা করেছে এর অর্ধেক সময়ে। এটি একটি ইউএস যুদ্ধ, কেননা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা ছাড়া, প্রেসিডেন্ট ও তার পরামর্শকদের অনেকগুলো মার্কিন আইন লঙ্ঘন ছাড়া ও ইসরায়েলি অপরাধ ঢাকতে তাদের সাহায্য ছাড়া, ইসরায়েল এসবের কিছুই করতে পারত না— যা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা সবসময় বলছে।”
আগে নেতানিয়াহুর প্রসঙ্গে আসি। অপরাধের তদন্ত থেকে নিজেকে বাঁচাতে সে এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ক্ষমতা ত্যাগ করার পর পরই তার ইসরায়েলি জেলে ঢুকার সম্ভাবনা বিরাট। অতএব যতদিন সে যুদ্ধ পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখতে পারবে ততদিনই সে ব্যক্তিগতভাবে নিরাপদ। হামাসের একটি হঠকারিতামূলক আক্রমণকে কাজে লাগিয়ে সে নিজের পিঠ বাঁচাচ্ছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে পিঠ বাঁচানোর তার এই নির্মম কৌশলের কথা বলছে স্বয়ং ইসরায়েলিরাই।
৭ অক্টোবর নিরীহ ইসরায়েলি মানুষের উপর হামাসের আক্রমণটি ভুল, অন্যায় ও অমানবিক ছিল, সন্দেহ নেই। আক্রমণকে ফিলিস্তিনপন্থি খ্যাতিমান সাংবাদিক মেহেদি হাসানও যুদ্ধাপরাধ বলতে কুণ্ঠিত হননি। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতও হামাসের ৩ জন নেতাকে সেজন্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। একইসঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকেও ওই আদালত যুদ্ধাপরাধী বলে সাব্যস্ত করেছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলাকে তারা গণহত্যা বলেছে এবং ওই ৫ জনের বিরুদ্ধে আটকাদেশ দেয়ার জন্য আবেদন করেছে যদিও তা সময়সাপেক্ষ।
এই গণহত্যার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে সারা বিশ্বের আপামর জনসাধারণ। তবু এই গণহত্যা গত ১ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে কেমন করে? এর উত্তর নিহিত আছে এই তথ্যের মধ্যে যে, বৃহত্তরভাবে এ গণহত্যার সমর্থক, পৃষ্ঠপোষক ও ক্ষমতায়নকারী হলো পশ্চিমা পুঁজিবাদী দখলদার শক্তি। এ কথার সমর্থনে এ তথ্যটুকুই যথেষ্ট যে, ফিলিস্তিনের মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে যেসব গুলি ও বোমা দিয়ে তার সবই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি, এর সব আর্থিক সাহায্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের।
আরও গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্যটুকু যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এক মিনিটের একটি ফোনকলই এ যুদ্ধ এক মুহূর্তে বন্ধ করে দিতে পারত, এখনই পারে। যেমনটা ১৯৮২ সালে রোনাল্ড রিগ্যানের একটি ফোন পশ্চিম বৈরুতে হামলা বন্ধ করতে বাধ্য করেছিল ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচিম বেগিনকে। কিন্তু গণহত্যাকারী ইসরায়েলি সৈন্যবাহিনীকে সমর্থনের ব্যাপারে ট্রাম্প আর বাইডেনে আদতে কোনো পার্থক্যই নেই। পার্থক্য থাকবে না কমলা হ্যারিসেও। এবার প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক অনুষ্ঠানে তাই ট্রাম্প ও কমলার মাঝে দেখা গেল এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা— কে কার চেয়ে বেশি ইসরায়েলপন্থী সেই দৌড় নিয়ে। ইসারায়েলি লবিগ্রুপ আইপ্যাক সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদেরকেই কিনে পকেটে ভরে রেখে দিয়েছে— ইহুদি বংশোদ্ভূত বার্নি স্যান্ডার্স ও এমন দুয়েকজনকে ছাড়া।
বার্নি স্যান্ডার্স শুরুর দিকে ইসরায়েলের নিজেকে রক্ষার অধিকারের প্রতি সমর্থন দিলেও পরবর্তীতে তীব্র ভাষায় ইসরায়েলি গণহত্যার নিন্দা করেন এবং এখনও করছেন। তিনি দাবি করছেন যুক্তরাষ্ট্র যেন ইসরায়েলকে আর এক পয়সাও সহায়তা না করে। আমেরিকা ও ব্রিটেন এ গণহত্যায় ইসরায়েলের মূল শক্তিদাতা। আর সে কারণে এ গণহত্যাকে কেবল ইহুদি অপকর্ম মনে করলে ভুল হবে। এ হচ্ছে পশ্চিমা পুঁজিবাদের নেতা মার্কিন-ব্রিটিশ শক্তির অংশগ্রহণে সংঘটিত গণহত্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নেতৃত্বে এরাই ইহুদি নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল, এই শক্তি ছিলো নৃশংস হলোকস্টের নীরব সংঘটক।
ইহুদিদের ইতিহাস হলো খ্রিস্টান পুঁজিবাদী শক্তির হাতে নির্যাতিত হওয়ার, পালিয়ে বাঁচার ও দেশান্তরিত হওয়ার। অন্যদিকে তাদের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ আশ্রয় ছিল মুসলিমশাসিত রাজ্যগুলো। আজ পশ্চিমা খ্রিস্টান পুঁজিবাদী শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের পাপের পাহাড়কে খাটো করে দেখানোর একটি উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে আরেকটি হলোকস্ট সংঘটনের যার শিকার মুসলামানরা ও আশ্চর্যজনকভাবে যার সংঘটক সেদিনের ভিক্টিম ইহুদিরা।
গাজায় মার্কিন-ইসরায়েলি গণহত্যার বর্ষপূতিতে বরং পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে। পশ্চিমা মিষ্টি কথার আড়ালে চলছে ইসরায়েলকে তাদের সবরকম সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য। তাই ইসরায়েলের একার পক্ষেও এ গণহত্যা বন্ধ করা কঠিন যেহেতু এর সুতা অন্যত্র। নিউ ইয়র্কে কলাম্বিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক আরব রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের অধ্যাপক জোসেফ মাসাদ (হোয়াই ইসরায়েলস জোনোসাইড ইন গাজা ইজ এ ওয়েস্টার্ন ওয়ার অন দা প্যালেস্টিনিয়ান পিওপল, মিডল ইস্ট আই, ৩০ অগাস্ট ২০২৪) লিখেছেন, “ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামের চলতি গণহত্যা একা ইসরায়েল কর্তৃক পরিচালিত না। এটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, বাকি ইইউ ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো দ্বারা সংঘটিত একটি পশ্চিমা গণহত্যা।”
এভাবে শুরু করে তিনি শেষ করেছেন এ কথাগুলো দিয়ে: “গাজা গণহত্যার বিরোধিতা ও ফিলিস্তিনিদের রক্ষার বিষয়টি অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের ও পশ্চিম ইউরোপীয় রাজনীতির আভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। এর মানে হলো পশ্চিমে ফিলিস্তিনপন্থী শক্তিগুলোও বুঝতে পারছে যে, ফিলিস্তিনের জনগণকে নিঃশেষ করার প্রকল্প কেবল ইসরায়েলের একার নয়, একটি পশ্চিমা অপরাধ।”
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধের ক্ষেত্রে এটাই আসল ও বড় বাধা। এর আয়োজন শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে ব্রিটেন কর্তৃক বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ও আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তাই কেবল বর্ষপূর্তি নয়, এ গণহত্যার দশকপূর্তি হলেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে না— বা ততবর্ষ পূর্তি যতবর্ষ পর্যন্ত ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, বাকি ইইউ ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো’র এই বৈষম্যময় বর্ণবাদী দখলদারি আধিপত্যমূলক রাজনীতি দুনিয়ায় অপ্রতিরোধ্যরূপে বহাল থাকে। ডোনাল্ড-কমলাও কিছুই করবেন না যদি না পশ্চিমা বিশ্বে গণমানুষের আন্দোলন তাদেরকে বাধ্য করে এ গণহত্যা বন্ধে। যদি না তা লুণ্ঠনবাজ পরাশক্তিগুলোকে বাধ্য করে ফিলিস্তিনি মুসলমান ও ইসরায়েলি ইহুদিসহ সব ধর্মবর্ণের মানুষকে পাশাপাশি একটি স্বাধীন ভূখণ্ডে গণতান্ত্রিক শাসনাধীনে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাসের অধিকার মেনে নিতে।