সরকার চেয়েছে বিএনপিকে আবারও একটি সন্ত্রাসী দল, আগুন সন্ত্রাসের দল হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত করাতে। নিজেদের অজান্তেই সরকারের ইচ্ছে পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বিএনপি। ২৮ অক্টোবর কৌশলের খেলায় সরকার জিতেছে।
Published : 31 Oct 2023, 04:54 PM
২৮ অক্টোবরের পর দেশের রাজনীতি আবার সংঘাতময় হয়ে ওঠার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে শেষ হয়নি। একজন পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। বিএনপির একজন কর্মীও মারা গেছেন। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা হয়েছে। পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়েছে, পুলিশ হাসপাতালে আক্রমণ হয়েছে। বেশ কিছু যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনার দায় কার তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। বিএনপি বলছে, সরকার পরিকল্পিতভাবে পুলিশ দিয়ে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড করে দিয়েছে। অন্যদিকে, এমন তথ্য-প্রমাণও আছে যে, সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছে বিএনপি সমর্থকদের দিয়েই। বিএনপি আগবাড়িয়ে আক্রমণ করেছে এবং তারপর পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শক্তি প্রয়োগ করেছে। এখন পুলিশ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শক্তি প্রয়োগ করেছে, নাকি বিএনপি কর্মীরাই বাড়াবাড়ি করেছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বাহাস করা যাবে, তাতে এটা প্রমাণ করা যাবে না যে সহিংসতা হয়নি।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে এখন দোষারোপের সংস্কৃতির একটি বড় জায়গা দখল করে আছে। কেউ নিজের দায় স্বীকার করতে চায় না। সব সময়ই চলে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ' নীতির প্রয়োগ। ২৮ অক্টোবর বিএনপি লক্ষাধিক লোকের যে জমায়েতের টার্গেট নিয়ে নেমেছিল, সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত বড় জমায়েতের শৃঙ্খলা রক্ষার নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা কি বিএনপির ছিল? যেহেতু দেশের রাজনীতি বিদ্বেষময়, প্রতিহিংসাপরায়ণ, সেহেতু যেকোনো অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনার ব্যাপারে সতর্ক থাকা নেতৃত্বের দায়িত্ববোধের মধ্যেই পড়ে। অথচ বিএনপি নেতৃত্ব এদিকে ছিলেন পুরোপুরি উদাসীন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে নেতারা যখন উত্তেজক বক্তৃতা দিতে মশগুল তখন মঞ্চ থেকে দূরে বিক্ষুব্ধ কর্মীরা কোনো অঘটনের সূত্রপাত করছেন, তা দেখার তো কেউ ছিলেন না। সরকার পতনের আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্য তৃণমূল থেকে জড়ো হওয়া নেতা-কর্মীরা ধৈর্য হারিয়ে ভাঙচুরে মত্ত হলে তাদের নিবৃত্ত করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে পুলিশি অ্যাকশন ছিল অপরিহার্য। পুলিশ হত্যার খবর শুনে পুলিশ যে আক্রমণাত্মক হবে, সেটা কি অস্বাভাবিক ঘটনা? এখন সরকার ও সরকারি দলকে যতই দায়ী করা হোক না কেন, বিএনপিও কোনোভাবেই দায়মুক্ত নয়।
একটি বড় রাজনৈতিক আন্দোলন সংঘটিত করতে হলে যে ধরনের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা থাকার প্রয়োজন তা বিএনপির ছিল না। সরকার পতনের আন্দোলনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ জরুরি কিন্তু নেতৃত্বের চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। স্বতঃস্ফূর্ত নেতৃত্ব কখনো কোনো সফল আন্দোলনের কারিগর হতে পারেন না। বিএনপির নেতৃত্বে যে কখনোই কোনো সফল গণ-আন্দোলন হয়নি, তার বড় কারণ এই দলটি সত্যিকার অর্থে একটি রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারেনি।
সরকার চেয়েছে বিএনপিকে আবারও একটি সন্ত্রাসী দল, আগুন সন্ত্রাসের দল হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত করাতে। নিজেদের অজান্তেই সরকারের ইচ্ছে পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বিএনপি। এখন সরকারকে যতই দায়ী করা হোক, তাতে বিএনপির ভুল কৌশল পরিশুদ্ধ হবে না। ২৮ অক্টোবর কৌশলের খেলায় সরকার জিতেছে।
বিএনপির লেজেগোবরে অবস্থার আর একটি প্রমাণ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তিকে বক্তৃতার সুযোগ করে দেওয়ার ঘটনা। আমেরিকার মতো ক্ষমতাধর দেশের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উপদেষ্টা বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে না বলেকয়ে গিয়ে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হবেন এবং সেটা একটি বিশেষ উত্তেজক পরিস্থিতিতে– এটা যারা বিশ্বাস করেন, তারা যে রাজনৈতিকভাবে কতটা কাঁচা, তা বোঝার জন্য বড় পণ্ডিত হওয়ার দরকার হয় না। আমেরিকা বা পশ্চিমা শক্তির ওপর নির্ভরশীল দেউলিয়া রাজনীতি বিএনপিকে হাস্যকর অবস্থায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে।
তারপরও বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন থেকে মুখ না ঘুরিয়ে বরং সহিংসতার রাজনীতির পথেই হাঁটছে। মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার তিনদিনের অবরোধ কর্মসূচি সরকারের ওপর কতটুকু চাপ সৃষ্টি করবে তা বলা না গেলেও এটা বলা যায় যে এই অবরোধ ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারলেও বিএনপির বিচ্ছিন্নতা এই অবরোধের রাজনীতিতে আরও বাড়াবে। মঙ্গলবার দুপুরে এই লেখা যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত যে খবর পাওয়া গেছে, তা আসলে মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্কই বাড়িয়ে তুলবে।
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে পুলিশের গুলিতে ২ বিএনপি কর্মী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কুলিয়ারচর থানার ওসি মো. গোলাম মোস্তফা জানান, বিএনপির সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশকে মারতে এলে তখন আত্মরক্ষায় গুলি ছুঁড়লে দুজন নিহত হওয়ার খবর শুনেছি।
অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ৩ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচরুখী বাজার এলাকায় সংঘর্ষের এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, ৭২ ঘণ্টার অবরোধের সমর্থনে সকাল সাড়ে আটটার দিকে কয়েক শ নেতা-কর্মী নিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মিছিল করেন কেন্দ্রীয় বিএনপির আন্তর্জাতিক–বিষয়ক সহসম্পাদক নজরুল ইসলাম। এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরা বাঁশের লাঠি হাতে গাছের গুঁড়ি, আরসিসি খুঁটি ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। পুলিশ তাঁদের বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্য করে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। অবরোধকারী নেতা-কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন।
সংঘর্ষের একপর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা একজোট হয়ে পুলিশকে ধাওয়া দেন। তিনজন পুলিশ সদস্যকে তাঁরা ধরে ফেলেন। পরে তাঁদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে জখম করেন তাঁরা। এ সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে যোগ দেন। থানা থেকে আরও পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে এলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সড়ক ছেড়ে চলে যান। সংঘর্ষের সময় ঢাকা-নরসিংদী সড়কে চলাচলকারী অন্তত তিনটি বাস ভাঙচুর করেন অবরোধকারী ব্যক্তিরা। প্রায় দেড় ঘণ্টা সংঘর্ষের পর পুলিশের চেষ্টায় সড়কে যান চলাচল শুরু হয়।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আমির খসরু বলেছেন, বর্তমানে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে। এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে আটক করা হয়েছে।
দিন শেষে আরও কি খবর পাওয়া যাবে, জানি না। পরের দুই দিন তো আছেই। পুলিশের ওপর আক্রমণের ঘটনায় পুলিশ আরও মারমুখী হয়ে উঠতে পারে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ যৌথভাবে মাঠে নামলে বিএনপি দাঁড়াতে পারলে ভালো, না হলে দলটির জন্য সুখবরের চেয়ে খারাপ খবর তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই ধারায় আন্দোলন করে বিএনপি কি নির্বাচন ঠেকাতে কিংবা সরকারের পতন ঘটাতে পারবে? হরতাল-অবরোধের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। ফলে খুব বেশি সময় সংঘাতের রাজনীতি এগিয়ে নিতে পারবে না বিএনপি। যারা সরকারের কাজেকর্মে বিরক্ত তারাও সবাই এই হিংসাত্মক রাজনীতি সমর্থন করবে বলে মনে হয় না। মানুষ চায় শান্তি-স্বস্তি। রক্তপাত, সংঘাত-সহিংসতা কারও কাম্য নয়।
এদিকে নির্ধারিত সময় ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের হাতে অন্য কোনো অপশন নেই। মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে সিইসির সঙ্গে দেখা করতে যান ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। ওই বৈঠক শেষে সিইসি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের অনুকূল-প্রতিকূল পরিবেশ নিয়ে কিছু কথা উঠেছে, এমন মন্তব্য করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, তাঁরা সব সময় চান নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ হোক। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ হলে নির্বাচন হবে না, এমন মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং যেন জনগণের মধ্যে না থাকে।
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের হাতে কোনো অপশন নেই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী কমিশনকে নির্বাচন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে অনেক অপশন থাকে। তারা এককভাবে বা জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, আবার না-ও করতে পারে। কিন্তু কমিশনের হাতে এ ধরনের কোনো অপশন নেই। কমিশন নির্বাচনের জন্য দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
ওদিকে, ঢাকায় ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংগঠিত ঘটনাবলির পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের জন্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে সেদিন সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে তারা। গত সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এই আহ্বান জানান মুখপাত্র ম্যাথু মিলার।
ব্রিফিংয়ে একজন তাঁর প্রশ্নে বলেন, বাংলাদেশে বিরোধীদের মহাসমাবেশে হামলা ও সহিংসতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তাহান্তের বিবৃতি লক্ষ্য করেছেন তিনি। মূলত পুলিশ পরিকল্পিতভাবে এই সহিংসতা চালিয়েছে। সমাবেশ শুরুর আগে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর বিএনপির মহাসচিবসহ শত শত বিরোধী নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বিরোধী নেতাদের পরিবারের সদস্যদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে শত মামলা করা হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী।
জবাবে মিলার বলেন, “২৮ অক্টোবর ঢাকায় যে রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে, আমরা তার নিন্দা জানাই। পুলিশের এক কর্মকর্তা ও একজন রাজনৈতিক কর্মীর নিহত হওয়া, হাসপাতাল ও বাসে আগুন দেওয়া অগ্রহণযোগ্য। একইভাবে সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়।”
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস কনফারেন্সে বাংলাদেশ নিয়ে একপেশে প্রশ্ন করা হলেও জবাব দেওয়ার সময় কিন্তু ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টি লক্ষণীয়। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর কোনো অঙ্গীকার কারও কাছে করেনি। যা কিছুই বাংলাদেশ হোক, তা হতে হবে নিজেদের শক্তি দিয়েই।