ইদানিং, আমাদের পরীক্ষা, প্রতিযোগিতাগুলোকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। ফলাফল, আসন সংখ্যা, শিক্ষার্থীদের চাহিদা— সব মিলিয়ে ‘যুদ্ধ’ না বলে উপায়ও নেই।
Published : 16 Oct 2024, 07:28 PM
আমাদের হ-য-ব-র-ল শিক্ষাব্যবস্থায় আরেকটি হতাশাজনক উদাহরণ তৈরি হলো এবারের এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে। জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল চব্বিশের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ওপর। দফায় দফায় পরীক্ষা পেছানো, স্থগিতের পর শেষমেষ বাতিলের সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবক মহলে শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। অবশেষে গত ১৫ অক্টোবর ঘটনাবহুল এ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো।
এ বছর পাস করেছে ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে, যা উত্তীর্ণের মোট সংখ্যার ১৪ শতাংশ। গত বছর এ পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ; তাদের মধ্যে ৯২ হাজার ৫৯৫ জন জিপিএ ৫ পেয়েছিল। ২০২৪ সালের পরীক্ষায় পাসের হার কমেছে দশমিক ৮৬ শতাংশ পয়েন্ট। তবে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ হাজার ৩১৬ জন। আর এর মধ্য দিয়েই অবসান হলো এইচএসসি-২৪ অধ্যায়ের।
ফলাফলের পর শিক্ষার্থীদের সামনে এখন দুশ্চিন্তার নতুন পাহাড়। নতুন চ্যালেঞ্জ। অনেকগুলো বিষয়ের পরীক্ষা না নিয়ে এসএসসি-এর ফলাফলের সঙ্গে ম্যাপিং করে প্রকাশিত এ ফলাফল শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি ততটা। ফলে এবার তাদের সামনে বড় আরেকটি পরীক্ষা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চমাধ্যমিকের পরপরই শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার নিয়ে, ভবিষ্যতের গতিপথ নির্মাণ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। তোড়জোড় চলে মেডিকেল, বুয়েটসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতি নিয়ে। ইদানীং উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে।
মূল কথা হচ্ছে, এসব শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন থেকে পড়াশোনার বাইরে। সামনে তাদের ভর্তি পরীক্ষা নামের যুদ্ধ। এদিকে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখনও পূর্ণাঙ্গ স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারেনি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সেশনে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসই এখনও শুরু হয়নি। এসব শিক্ষার্থীরা দিন পার করছে অপেক্ষায়, অনিশ্চয়তায়, অবসাদে, দুর্ভাবনায়। উচ্চশিক্ষা জীবনের শুরুতেই এটা তাদের জন্য বড় রকমের একটা হোঁচট। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিয়ে তরুণ মনে বোনা স্বপ্নের আভা ক্রমশ ফিঁকে হতে চলেছে তাদের।
দু-এক মাস পরই শুরু হবে ‘ভর্তি যুদ্ধ’। ইদানিং, আমাদের পরীক্ষা, প্রতিযোগিতাগুলোকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। ফলাফল, আসন সংখ্যা, শিক্ষার্থীদের চাহিদা— সব মিলিয়ে ‘যুদ্ধ’ না বলে উপায় নেই। এবারের পরিস্থিতি কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। ছাত্র অভ্যুত্থানে এখনো এলোমেলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শৃঙ্খলা ফেরেনি অনেক ক্ষেত্রে। শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষের আগুন এখনো নেভেনি। দলীয় লেজুড়বৃত্তির ফলে শিক্ষকদের বড় একটি অংশ নিজেদের প্রশ্নের মুখোমুখি করে রেখেছেন। নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক আবহে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ডামাডোল বাজছেই। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অন্তর্দ্বন্দ্ব। ইতোমধ্যে, প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। পাঠে, গবেষণায় এখনও ফেরেনি তাদের মন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেও চলছে নানামুখী অস্থিরতা।
এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কবে ভাবতে শুরু করবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো— এ প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। একই চিত্র মেডিকেল এবং বুয়েটের ক্ষেত্রেও। যে প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে স্বপ্নরাঙা চোখে তাকিয়ে আছে এদেশের লাখো শিক্ষার্থী, যে শিক্ষায়তনগুলোতে শিক্ষার্থীরা খুঁজছে নিজেদের ভবিষ্যত— ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন দোদুল্যমানতা, বহুমুখী সংকট হতাশার জন্ম দিচ্ছে শিক্ষার্থীমনে। দুর্ভাবনায় কাতর এসব শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এখন বিদেশমুখী। ফলে দেশ হারাচ্ছে সম্ভাবনাময় একটি প্রজন্মকে।
অন্যদিকে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নানা রকমের অব্যবস্থাপনা রয়েছে দীর্ঘদিন থেকেই। মেডিকেল, বুয়েট, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি, গুচ্ছ, সমন্বিত, ইত্যাদি বহুবিধ ভর্তি পরীক্ষাধারা চলমান আছে। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছেই। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এবং বেদনার ব্যাপার হচ্ছে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর ঠিক কবে এসব শিক্ষার্থীদের স্নাতক পর্যায়ের ক্লাস শুরু হবে তা কেউ বলতে পারে না।
২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবারের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে কৃষি ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গুচ্ছ পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় ভর্তি পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয় ৩৫টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে। কিন্তু ভর্তি নিয়ে সংকটগুলো কাটেনি। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন ধাপে দীর্ঘসময় ধরে ভর্তি কার্যক্রম চলমান রাখতে হয়। ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে আসন পূরণ করতে দীর্ঘসূত্রিতায় পড়তে হয় তাদের। এটা খুবই সংগত যে, ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক অবস্থানগত কারণে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সমান নয়। এছাড়া জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ফলে সংকট আরও ঘনীভুত হয়েছে। আবার গুচ্ছ পরীক্ষাকে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিকও মনে করছেন।
এদিকে বিগত কয়েক বছরের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় বেশ দেরিতে; চলে দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে নির্ধারিত সময়ে ক্লাস শুরু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার ওপরে আছে মাইগ্রেশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ পরিবর্তনের বিষয়ও। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় যেমন পড়ে আসন সংকটে, তেমনি শিক্ষার্থীদেরও পোহাতে হয় নানামুখী ঝামেলা। সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে নিরীক্ষা-গবেষণা প্রয়োজন। এ পদ্ধতির সুবিধা যেমন আছে তেমনি অসুবিধাও কম নয়। ফি বৃদ্ধি, সময়ক্ষেপণ, পছন্দের বিষয় নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সমালোচনা যেমন আছে তেমনি ভর্তি পরিক্ষার জন্য ছুটাছুটির ঝামেলা না থাকাসহ কিছু সুবিধাও আছে।
দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার গন্তব্য নির্ধারণে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা খুব জরুরি। এবারের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও বেশি জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের ছেলেমেয়েদের একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন আগেভাগেই। ভর্তি পরীক্ষা, ক্লাস শুরুসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে একটি ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করা দরকার। কেননা এসব অব্যবস্থাপনার ফলে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে যে হতাশার জন্ম নেয় তার প্রভাব হয় দীর্ঘমেয়াদি এবং এই প্রভাব পড়ে জীবনের নানাক্ষেত্রে। ফলে জীবনের যে সময়টাতে তারা রঙীন স্বপ্নে উজ্জীবিত হওয়ার কথা, সে সময়টা কাটে নেতিবাচক গল্পে, আশাহীনতায়।
বর্তমান সময়ে বারবার শিক্ষা সংস্কার নিয়ে কথা উঠছে। ওই প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে। নতুন, পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে, শিক্ষার্থীদের সার্বিক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে নীতিনির্ধারকদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, উচ্চমাধ্যমিকের পর এ সময়টা শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নয়, এ সময়টা তার মনন-চিন্তায় গভীরভাবে রেখাপাত করে।
যেহেতু এবারের ভর্তিচ্ছুরা একটি ঘটনাবহুল সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে, সেহেতু তাদের ‘লার্নি লস’ পুষিয়ে দেয়ার জন্য একটি বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত সুবিধার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, হলে সিট বৃদ্ধি, সিট বরাদ্দ প্রক্রিয়াকে রাজনীতি মুক্ত রাখা, একটি নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেমে পুরো ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা— এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে সংশ্লিষ্টদের। যত দ্রুত সম্ভব এ ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রকাশে ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব নিতে হবে। তবেই হয়তো শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মনে কিছু আশা জাগতে পারে।