প্রশাসন, রাজনীতি ও অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি আসছে। এক কথায় যাকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার বা রাষ্ট্র মেরামত। সংস্কারের এই আকাঙ্ক্ষাটা দেশের আপামর জনগণেরই।
Published : 11 Sep 2024, 07:13 PM
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই চলছে রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনা। প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরপরই দুজন উপদেষ্টা রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর সংস্কারের লক্ষ্যের কথা তুলে ধরেন। সংস্কারের এই আলোচনা নতুন মাত্রা পায় গত ২৯ অগাস্ট রাজধানীতে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের পর। ওই সংবাদ সম্মেলনে সংবিধান পুনর্লিখনের তাগিদ দেওয়া হয়।
২৯ অগাস্টেই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ‘সংস্কার প্রস্তাব’ চাওয়ার কথা জানায় সরকার। এর দুদিনের মাথায় সিজিএস আয়োজিত আরেক সংলাপে অনেকটা কাছাকাছি বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটিতে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা মাহফুজ আলম অবশ্য একথাও বলেন, “অনেকেই আছেন, যারা ১৯৭১ সালের আকাঙ্ক্ষাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছেন। সেটা করা যাবে না। ১৯৭১-কে পাশ কাটিয়ে এগোতে চাইলে তা আত্মঘাতী হবে।”
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কারের যেসব প্রস্তাব দিচ্ছে, সংবিধান সংশোধন ছাড়া সেগুলোর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কি সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এক মাস পেরোলেও এখনো প্রশাসনিক শৃঙ্খলা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মনে এখনো ভয় কাজ করায় তারা পূর্ণোদ্যমে তৎপর হচ্ছে না। ওই সুযোগে জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে ‘মব জাস্টিস’ তথা বিচারবহির্ভূত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে এমনকি আদালত অঙ্গনেও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আক্রান্ত হচ্ছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও প্রধানদের লাঞ্ছিত করে পদত্যাগপত্রে সই করানোর প্রতিযোগিতা চলছে। মাজার ভাঙচুর করা হচ্ছে। অবিলম্বে এসব বন্ধ করতে না পারলে গোটা সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়াটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য জরুরি কর্তব্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সরকারের নীতিগত দিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, রাজনীতি ও অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি আসছে। এক কথায় যাকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার বা রাষ্ট্র মেরামত। সংস্কারের এই আকাঙ্ক্ষাটা দেশের আপামর জনগণেরই। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোও নানারকম প্রস্তাব হাজির করছে।
বর্তমানে ক্রিয়াশীল দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিএনপি। বছরখানেক আগেই দলটির পক্ষ থেকে একগুচ্ছ সংস্কার-প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন; প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সমন্বয়; পরপর দুইবারের বেশি কেউ যেন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তার ব্যবস্থা করা; বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবীসহ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’র বিধান চালু এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন।
সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম ও ধর্মভিত্তিক ছয়টি দলের নেতারাও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি না থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। সমমনা ওই ছয়টি ধর্মভিত্তিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে ভোটের হারের ভিত্তিতে আসন বণ্টন তথা সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে। একই প্রস্তাব জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী আন্দোলনেরও।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো কোনো সদস্যও এরই মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পাশাপাশি সংসদের অর্ধেক আসনে আনুপাতিক নির্বাচন এবং দেশকে ন্যূনতম পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে সংবিধান সংশোধন ছাড়া সংস্কারের এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বিধান না থাকলেও বেসিক স্ট্রাকচারাল ডকট্রিন বা মৌলিক কাঠামো মতবাদ এবং ডকট্রিন অব নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তার নীতি অনুযায়ী এই সরকার বৈধতার দাবিদার। আর ওই আলোকেই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের নিয়োগ দিয়েছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি। বর্তমান সরকার কোনো বিপ্লবী সরকার নয়; যদিও রাষ্ট্রপতিকে বিদায় দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারটি বিপ্লবী সরকারে রূপান্তরের তাগদা আন্দোলনের তত্ত্বগুরুদের কেউ কেউ দিয়ে যাচ্ছেন। তবে ওই রকম রূপান্তরের আগে বর্তমান সরকার ইচ্ছে করলেই কোনো ডিক্রি বা আদেশ জারি করে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না। তাহলে কি এখন সরকারের কিছুই করণীয় নেই? অবশ্যই আছে।
অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কারমূলক কাজ অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমেও সেরে ফেলতে পারে। নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছে। রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনদের মতের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করার লক্ষ্যে বর্তমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ সংশোধন করা এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করাটা মোটেই কঠিন কাজ নয়। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করার পক্ষে থাকায় এ-সংক্রান্ত আইনও সংশোধন করা দরকার। সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠে সব রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির লক্ষ্যে আইন সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠন করাও সময়ের দাবি। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারি করা হলেও কেউ দ্বিমত করবে বলে মনে হয় না। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫ (গ) ধারা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ডসংবলিত বিচারপতি নিয়োগ অধ্যাদেশও জারি করা দরকার। এভাবে অধ্যাদেশগুলো জারি করার পাশাপাশি সংবিধানের যেসব বিধান সংশোধন বা সংযোজন-বিয়োজনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে সেসব বিষয়ে একটি সমঝোতা বা সম্মতিপত্রে দলগুলোর সই করা অপরিহার্য।
রাষ্ট্র ও সমাজের টেকসই সংস্কার করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোরও আদর্শিক-সাংগঠনিক সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারের উদ্যোগ পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আগেই নিতে হবে। সংবিধানে যেসব সংশোধনী আনার ব্যাপারে সমঝোতা হবে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দলগুলোর গঠনতন্ত্র ও ঘোষণা-কর্মসূচিও সংশোধন করা দরকার। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই দলগুলো নিজ নিজ গঠনতন্ত্র ও ঘোষণা-কর্মসূচি সংশোধন করতে পারলে রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকারের প্রতি তাদের আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটবে। কারণ একক নেতৃত্বনির্ভর দল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে সংস্কারের অঙ্গীকার কতটা প্রতিপালিত হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। দেশের রাজনীতির অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই এমন সন্দেহ দেখা দেয়। নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনকালে তিনজোটের রূপরেখা এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রণীত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর কী হাল হয়েছিল তা অনেকেরই জানা।
রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার ওপরই বেশি জোর দিচ্ছে বলে মনে হয়। প্রশাসনের কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণ আর রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রায়ন ছাড়া অন্য সব সংস্কার-প্রস্তাব টোটকার শামিল। রাষ্ট্র কাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় এটি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু স্থানীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট আইনগুলো সংশোধন করে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের সব সরকারি দপ্তরকে এর আওতাধীন করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম ধাপের কাজ এই সরকারই সেরে ফেলতে পারে। এসব আইনে স্থানীয় সরকারের কাজে আইনপ্রণেতা তথা সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করার বিধান রাখতে হবে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটারদের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা রাখাটাও জরুরি।
আরও পড়ুন