করি করি করেও কত কাজ করা হয় না!
তারমানে এই নয় আপনি অলস। আলসেমি আর গড়িমসি বা কালক্ষেপণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আর এর থেকে বের হয়ে আসার পন্থাও আছে।
এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানি জেনি ইয়েপ বলেন, “সাধারণভাবে বলতে গেলে অলসতার সঙ্গে গড়িমসি করার কোনো সম্পর্ক নেই।”
লস অ্যাজ্ঞেলেস ভিত্তিক ‘লিটল থিঙ্কার্স সেন্টার’য়ের এই কার্যনির্বাহী পরিচালক সিএনএন’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, “অলসতা হচ্ছে এরকম- এই বিষয়ে আমার চিন্তাভাবনা করারও কোনো ইচ্ছে নেই। আর কালক্ষেপণের উদাহারণ হল- বিষয়টা আমাকে ভোগাচ্ছে, যে কারণে কাজটা করা আমার জন্য কঠিন মনে হচ্ছে।”
তাই অলস ও কালক্ষেপণের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে।
“গড়িমসি করা আর সেখান থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র উপায় হচ্ছে নিজের আচরণ পরিবর্তন”, ‘হাও টু বিট প্রোক্রাস্টিনেইশন ইন দি ডিজিটাল এইজ’ বইতে লেখক মনোবিজ্ঞানি লিন্ডা সাপাডিন এভাবেই পরামর্শ দিয়েছেন।
বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে সিএনএন’য়ের প্রতিবেদনে জানানো হয়- হতে পারেন আপনি ‘পারফেক্টশনিস্ট’, স্বপ্নবাজ, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বা দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলার মতো মানুষ। আর এগুলো সবই কালক্ষেপণের স্টাইল।
যদিও এই বিষয়ে কোনো রকম গবেষণা করা হয়নি।
এক্ষেত্রে জেনি ইয়েপ বলেন, “মানসিক কারণে কিংবা চারিত্রিকভাবে একজন কালক্ষেপণকারী হতে পারেন।”
‘ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া’স কেক স্কুল অফ মেডিসিন’য়ের এই সহকারী অধ্যাপক উদাহরণ দিতে গিয়ে জানান- কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে যাওয়া, ব্যক্তিগত স্বপ্ন পূরণ না হওয়া অথবা কোনো কাজ ঠিক মতো না হওয়া- এই ধরনের বাস্তব পরিস্থিতির কারণে গড়িমসি-ভাব জন্মায়।
‘জেএএমএ’ সাময়িকীতে প্রকাশিত সুইডেনের সাড়ে তিন হাজার কলেজ ছাত্রদের ওপর করা এক সমিক্ষায় দেখা গেছে, কালক্ষেপণের ক্ষেত্রে মানসিক প্রভাবও রয়েছে। এর মধ্যে আছে- বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মানসিক চাপ, বাজে ঘুম, একাকিত্ব, অর্থনৈতিক সমস্যা, নড়াচড়া না করা।
কালক্ষেপণের কারণ জানা থাকলে নিজের ব্যাপারে সাবধান হওয়া যায়। তবে এই অভ্যাস এড়াতে কৌশল অবলম্বন করার দরকার পড়বে।
শিকাগো’র মনোবিজ্ঞানি ভারা সারিপালি এই বিষয়ে একই প্রতিবেদনে বলেন, “কারণের ওপর ভিত্তি করে কালক্ষেপণের অভ্যাস পরিবর্তনের কৌশল অবলম্বন করতে হবে।”
এজন্য নিজে কোন ধরনের কালক্ষেপণকারী সেটা জানা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একের অধিক ধরন কারও মধ্যে থাকতে পারে।
পারফেক্টশনিস্ট এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত: ইয়েপ জানান, কালক্ষেপণকারীরা সাধারণত ‘পারফেক্টশনিস্ট’ হয়।
তিনি বলেন, “কারণ ‘পারফেক্টশনিস্ট’দের সব কাজ নিখুঁত হওয়া দরকার পড়ে। এর জন্য ব্যাপক উদ্যোমের প্রয়োজন পড়ে। আর পরিকল্পনা মতো কাজ না হলে তারা উৎসাহ হারায়।”
দুশ্চিন্তাকারীরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, নিজে কোনো কাজ করার আগে অন্যদের পরামর্শের ওপর নির্ভর করে। পাশাপাশি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দ্বিধায় ভোগে।
যুক্তরাজ্যের ‘ইউনিভার্সিটি অফ কেম্ব্রিজ’য়ের গবেষক ইটামার শাট্জ এই ক্ষেত্রে বলেন, “এই দুই ধরনের মানুষই কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় ব্যর্থতা কিংবা সমালোচনার ভয়ে।”
“এই ধরনের চারিত্রিকতা বাস্তব সম্মত নয়।” শাট্জ আরও বলেন, “সাধারণ মানটাকেই যথেষ্ট মনে করার মতো বিষয়ে পরিবর্তন করতে হবে। পাশাপাশি কিছু ভুল হওয়া স্বাভাবিক সেটাও নিজেকে মানাতে হবে।”
সব কিছু এড়িয়ে কোনো কিছু চিন্তা না করে নিজের কাজ উদ্ধারের জন্য নিদিষ্ট সময় বেঁধে নিতে হবে। আর সেই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা করতে হবে। শেষ না হলেও হতাশ হওয়া যাবে না।
স্বপ্নবাজ: সারিপালি বলেন, “কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে খুঁটিনাটি বিষয়ে যুক্তিযুক্ত কোনো কিছু ধার ধারে না স্বপ্নবাজরা।”
তিনি আরও বলেন, “তারা ‘আইডিয়া’ পেতে পছন্দ করে। এটাই তাদের আনন্দ। তবে সেটা বাস্তবে রূপ দেওয়া তাদের কাছে কষ্টকর।”
তারা অনেক সময় ভাগ্য বিশ্বাস করে। ফলে কঠিন কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদর্শন অপ্রয়োজনীয় মনে হয়।
“আর ‘পারফেক্টশনিস্ট’দের মতো স্বপ্নবাজরাও সবসময় ভালো জিনিসটা আশা করে”, বলেন ইয়েপ।
তিনি এক্ষেত্রে পরামর্শ দেন, স্বপ্ন দেখা ও পূরণ করা – এই দুই বিষয়ে পার্থক্য বোঝার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে।
আর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিজেকে করতে হবে ছয়টি প্রশ্ন- কী, কখন, কোথায়, কে, কেনো এবং কীভাবে।
‘খুব শিগগিরই’ বা ‘একদিন হবেই’ এই ধরনের মনোভাব পরিবর্তন করে নির্দিষ্ট সময় নির্বাচন করতে হবে। পাশাপাশি সময় ধরে পরিকল্পনা মাফিক কতটা কাজ হলো সেটা লিখতে হবে।
দুশ্চিন্তাকারী: এই ধরনের কালক্ষেপণকারীরা জীবনে অন্যরা কী আশা বা আকাঙ্ক্ষা করছে সেটাই প্রাধান্য দেয়, নিজেরটা নয়। ফলে কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়।
“আপনার মানসিকতা এরকম হলে, ইতিবাচক উপায়ে অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের পন্থা খুঁজতে হবে”, বলে শাট্জ।
প্রতিক্রিয়া প্রকাশের চাইতে কাজে নেমে পড়তে হবে। বিরূদ্ধাচারণ নয়, চেষ্টা করতে হবে দলগতভাবে কাজ করার।
ইয়েপ বলেন, “কেউ যদি আপনার সহযোগী না হয় তবে সে বিষয়ে বিরোধীতা না করে কোন বিষয়টা কাজ করছে না সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।”
নিয়োগকারীদের সঙ্গে এই ধরনের মানুষরা সাধারণত কথা বলার প্রয়োজন মনে করে না। তারা বিশ্বাস করে না আলাপচারিতার মাধ্যমে কোনো লাভ হবে অথবা ইতিবাচক সমাধান আসবে, যেটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়।
পরিবর্তন সহজ নয়
উদ্বিগ্ন হওয়া বা অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা সামলানো যেমন সহজ নয় তেমনি কালক্ষেপণ কাটানও কঠিন হতে পারে, বিশেষ করে সেটা যদি গভীর থেকে উপলব্ধি হয়।
নিউ ইয়র্ক’য়ের মনোবিজ্ঞানি সিন গ্রোভার এক্ষেত্রে বলেন, “কালক্ষেপণকারীদের মধ্যে কারও কারও আত্মউপলব্ধি এতটাই ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে যে, কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে তারা প্রথম অবস্থাতেই যোগ্যহীন মনে করে।”
“এই অবস্থায় পেশাদার মনোবিজ্ঞানির পরামর্শ নিলে উপকার হতে পারে”, বলেন শাট্জ।
ইয়েপ বলেন, “কাজটাকে মানসপটে আঁকতে হবে। যদি আঁকা যায় তবে কাজ সম্পাদন সম্ভব হবে। ধারণা পেলে কাজ সম্পাদন সম্ভব হয়।”
তিনি আরও বলেন, “দিন শেষে বিশ্বাসটাই আসল। যদি বিশ্বাস করেন এটা সম্ভব তবে পারবেন। যদি অবিশ্বাস কাজ করে তবে পারবেন না। তাই যেটা বিশ্বাস করবেন সেটাই সত্যি হবে।”
আরও পড়ুন