ধরন বুঝে বিশ্রাম না নিলে ক্লান্তি কাটবে না।
Published : 14 Oct 2024, 03:20 PM
বিশ্রাম নিতে চাইলে প্রথমেই মাথায় আসে ঘুমের কথা। তবে ক্লান্তি ঝরাতে সব সময় ঘুম একমাত্র সমাধান নয়।
কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্রামের সাতটি ধরন রয়েছে। আর কখন কোনটা প্রয়োজন সেটা না বুঝে শুধু ঘুমালে ক্লান্তিবোধ দূর হয় না।
এই বিষয়ে মার্কিন চিকিৎসক ও ‘সেক্রেড রেস্ট’ বইয়ের লেখক সন্ড্রা ডাল্টন-স্মিথ বলেন, “ঘুম হচ্ছে বিশ্রামের একটি ধরন। তবে ঘুম দিয়েও অনেক সময় ক্লান্তিবোধ কাটানো যায় না।”
ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি ব্যাখ্যা করেন, “ক্লান্তি কাটাতে তাই অন্যান্য বিশ্রামের ধরন সম্পর্কে জানতে হবে। আর প্রয়োজন বুঝে সেভাবে নিতে হবে বিশ্রাম।”
ডা. ডাল্টন বিশ্বাস করেন বিশ্রামের সাতটি ধরন রয়েছে। আর প্রতিটি সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন।
শারীরিক বিশ্রাম
শরীর ও পেশির বিশ্রামকে শারীরিক বিশ্রাম হিসেবে আখ্যায়ীত করছেন ডা. ডাল্টন।
যাদের প্রয়োজন: “দেহের বিভিন্ন অঙ্গ দিয়ে যারা প্রতিদিন কাজ করেন তাদের এই শারীরিক বিশ্রামের প্রয়োজন। আর বলতে গেলে এটা আমাদের সবারই প্রয়োজন”- বলেন এই চিকিৎসক।
তবে যারা অতিমাত্রায় শারীরিক পরিশ্রম করেন, যেমন- শ্রমিক বা দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয় বেশিরভাগ সময় তাদের ক্ষেত্রে শারীরিক বিশ্রাম বেশি প্রয়োজন হয়।
এমনকি অফিসে বসে কাজ করার ক্ষেত্রেও শারীরিক বিশ্রামের প্রয়োজন হয়।
যখন প্রয়োজন: যখন দেহে ব্যথা হবে তখন শারীরিক বিশ্রামের দরকার হবে। যেমন- ঘাড় ব্যথা বা আঁটসাঁটভাব, পেশির জড়তা, পিঠ ব্যথা, পায়ে অস্বস্তি অথবা সাধারণ জড়তা। আসল বিষয় হল শরীর কী বলছে সেটা বুঝতে হবে।
শারীরিক বিশ্রামের পন্থা: ডা. ডাল্টন বলেন, “নানান পদ্ধতি রয়েছে। বসে কাজ করার ক্লান্তি ঝারাতে একটু হাঁটাহাঁটি করা উপকারী। এতে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। করতে পারেন ‘স্ট্রেচিং’ বা হাত-পা টানটান করা।”
মানসিক বিশ্রাম
মন পরিষ্কার, মনোযোগ ধরে রাখা ইত্যাদির জন্য মানসিক বিশ্রামের প্রয়োজন হয়।
যাদের প্রয়োজন: অতি চিন্তা করা এবং অতি বিচার বিবেচনা করার ক্ষেত্রে মানসিক ক্লান্তি কাজ করে। তাদের ক্ষেত্রে বেশি জরুরি।
যখন প্রয়োজন: দিন শেষেও যদি মস্তিষ্ক উত্তেজিত থাকে, অথবা ভুলে যাওয়ার পরিমাণ বাড়ে কিংবা মনোযোগ দিতে সমস্যা হয় তখন বুঝতে হবে মানসিক বিশ্রামের প্রয়োজন- ব্যাখ্যা করেন ডা. ডাল্টন।
আরেকটি লক্ষণ হল- প্রচন্ড ক্লান্তি বোধের পরও ঘুম না আসা।
মানসিক বিশ্রামের পন্থা: মন পূর্ণতা পায় এমন কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে। ধ্যান করার অভ্যাস রপ্ত করা এ ক্ষেত্রে উপকারী। আবার শারীরিক কসরতও হতে পারে আরেকটি পদ্ধতি। যেমন- জগিং বা দ্রুত হাঁটার সময় পদক্ষেপের দিকে নজর দেওয়া, শ্বাস প্রস্বাসে মনোযোগ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে মন পরিষ্কার করা যায়।
‘ব্রেইন ডাম্প’ বা মস্তিষ্কের জঞ্জাল ফেলে দেওয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করা আরেকটি উপায়। এক্ষেত্রে যাবতীয় ভাবনা ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটি কাগজে লিখে ফেলতে হবে। ফোন বা কম্পিউটারে টাইপ করলে হবে না। লেখার ফলে যেট হয় তা হল- ভাবনাগুলো কাগজে চলে যায় তখন বোধ হয় যে, মনটা হালকা হয়ে গেছে।
আত্মিক বিশ্রাম
নিজের জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে- এরকম একটা বোধ জেগে ওঠার পর এই ধরনের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়।
ডা. ডাল্টন বলেন, “মনে হতে পারে উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য তো কাজ করতে হবে তবে সেখানে ক্লান্তি তো আসবেই। তবে বিষয়টা হল এই ধরনের বোধ তখন জেগে ওঠে যখন অন্যের জন্য ভালো কিছু করা হয় বা ইচ্ছে জাগে।”
যাদের প্রয়োজন: যে কাজ করছেন সেটা বা বেঁচে থাকাটা যদি উদ্দেশ্যহীন মনে হয়, তাহলে আত্মিক বিশ্রামের প্রয়োজন পড়বে।
যখন প্রয়োজন: জীবনের কী মানে- এই ধরনের চিন্তাভাবনা খেলা শুরু করলে অবশ্যই আত্মিক বিশ্রামের প্রয়োজন পড়বে। সমাজের জন্য ভালো কিছু করার অনুভূতি জেগে ওঠা ভালো। তবে এই অনুভূতি যদি নিজেকে ভারী করে তোলে, মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়, তবে আত্মিক বিশ্রামের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
পন্থা: “ধর্ম ও বিশ্বাসের ভিন্নতার ওপর নির্ভর করবে আত্মিক বিশ্রামের পন্থা”- বলেন ডা. ডাল্টন।
তবে ধর্মীয় বিশ্বাসবোধ ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক বা অনুদান নির্ভর কাজের যুক্ত হয়েও আত্মিক বিশ্রাম নেওয়া যায়। এরফলে অন্যের প্রশংসা ও গুরুত্ব পাওয়া সহানুভূতির জাগরণ ইত্যাদি আত্মিক প্রশান্তিতে কাজ করে।
অনুভূতির বিশ্রাম
বাক স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তা যেখানে বাধা পায় তখনই অনুভূতির বিশ্রামের দরকার পড়ে।
যাদের প্রয়োজন: ডা. ডাল্টন বলেন, “স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, শিক্ষক, সম্মুখভাগে কাজ করা মানুষ, গ্রাহক সেবা- এই ধরনের কাজ- যেগুলোতে নিজের অনুভূতি দমিয়ে রেখে পেশাদারিত্ব পালন করতে হয় তাদের অনুভূতির বিশ্রামের প্রয়োজন পড়ে।”
এই ধরনের কাজে প্রতিদিন যেমন প্রচুর অনুভূতির ব্যবহার হয় তেমনি অন্যের অনুভূতিও আত্মস্ত করতে হয়। যে কারণে নিজের অনুভূতি আর প্রকাশ করা হয় না।
যখন প্রয়োজন: বিষণ্ন, উদ্বিগ্ন ও দম বন্ধ অনুভূতি জেগে উঠলে এই বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এমনকি যদি মনে হয়, অন্যরা সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে তখন অনুভূতির বিশ্রামকে গুরুত্ব দিতে হবে।
একইভাবে অন্যকে খুশি করা এমনকি যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও অন্যের সুবিধা দেখার বিষয়টা কাজ করলে বুঝতে হবে অনুভূতির বিশ্রামের অভাব হচ্ছে।
পন্থা: “বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু, থেরাপিস্ট বা যাদের সঙ্গে কথা বলা নিরাপদ বোধ হয় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। প্রধান লক্ষ্য হবে- নিজের অনুভূতি সৎভাবে প্রকাশ করতে পারা, আর অন্যের মাধ্যমে সমালোচিত না হওয়া”- ব্যাখ্যা করেন ডা. ডাল্টন।
যদি মানুষের মাধ্যমে জ্বালাতনের শিকার হন, তবে একাই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। অন্যতম উপায় হল, জীবনী লেখা। যেখানে নিজের মনে অনুভূতি লিখে রাখা হবে কিন্তু কেউ সেটা বিচার করতে আসবে না।
সামাজিক বিশ্রাম
এই বিশ্রামের অর্থ হল, নিজেকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারা। যেখানে নিজের শক্তি অন্যের শক্তির সঙ্গে মিলে যায়। যার সঙ্গেই থাকা হক, তার সামনে নিজের ভেতর বাহির প্রকাশে দ্বিধা না থাকা।
যাদের প্রয়োজন: কোনো সম্পর্কে যদি আপনি ‘দাতা’ হিসেবে থাকেন তবে সামাজিক বিশ্রামের প্রয়োজন পড়বে।
এরকম মানুষদের মাঝে আছেন- পরিবারের মায়েরা, সেবাকর্মী, প্রশিক্ষক, যারা প্রচুর মানুষ সামলান এবং নিজে সবসময় দাতা হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
যখন প্রয়োজন: “সবসময় কারও না কারও প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে পিছিয়ে আনতে না পারলে, অথবা খুব কাছের সম্পর্ক আপনাকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে- এরকম হলে বুঝতে হবে সামাজিক বিশ্রামের অভাব হচ্ছে”- বলেন ডা. ডাল্টন।
এইসব সম্পর্ক ভালোবাসায় পূর্ণ হলেও, খেয়াল করতে হবে সেটা যেন একপক্ষীয় না হয়।
পন্থা: নানান রকম উপায় রয়েছে। একটি হতে পারে- কোনো আদান প্রদান ছাড়া শুধু সম্পর্কটা উপভোগ করা। রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে হতে পারে, শুধু কথা বলার মাধ্যমে একে অন্যের অভিজ্ঞতা অর্জন করা, যেরকমটি হয়েছিল সম্পর্কের শুরুতে। হতে পারে চোখে চোখ বা হাতে হাত রেখে নীরবে বসে থাক।
যদি বন্ধুদের থেকে সামাজিক বিশ্রামের প্রয়োজন হয়, তবে অন্যের সঙ্গ নিয়ে আনন্দলাভ করার পরিবর্তে যা করতে ভালো লাগে বা মনে যা আসে সেটা করার চেষ্টা চালাতে হবে।
সংবেদনশীল বিশ্রাম
পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি প্রভাব কতটা ক্লান্ত করছে আর সেটা থেকে আরাপ পাওয়াই হল সংবেদনশীল বিশ্রাম। হতে পারে সেটা বাসায় থাকা আলোকচ্ছটা, আশপাশের আওয়াজ অথবা ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়টা অর্থাৎ ‘স্ক্রিন টাইম’।
যাদের প্রয়োজন: অতিরিক্ত আলো বা শব্দের মধ্যে থাকলে সংবেদনশীলতার বিশ্রাম নিতে হতে পারে। এরমধ্যে ফোন, কম্পিউটার বা ল্যাপটপের ব্যবহারও পড়বে।
যখন প্রয়োজন: ডা. ডাল্টন বলেন, “এর কোনো সহজ ব্যাখ্যা নেই। তবে সাধারণভাবে বলা যায়- সংবেদনশীলতার অভাব দেখা দিলে, এই বিশ্রাম নিতে হবে। তাই নিজেকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি অস্থির লাগলে বুঝতে হবে সংবেদনশীলতার বিশ্রামের অভাব হচ্ছে।”
পন্থা: সাধারণ পন্থা হল কোলাহল থেকে নিজেকে মুক্ত করা। সেটা হতে পারে ‘নয়েস ক্যান্সেলিং হেডফোন’ ব্যবহার করা। কাজের মাঝে বিরতি নেওয়া, আলোর মাত্রা কমানো, ফোনের শব্দ কমানো ইত্যাদি এই ধরনের কাজের মাধ্যমে সংবেদনশীল বিশ্রাম নেওয়া যায়।
সৃজনশীল বিশ্রাম
সৌন্দর্য অনুধাবন আর সেই সৌন্দর্য নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারাই হল সৃজনশীল বিশ্রাম।
যাদের প্রয়োজন: যারা সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত বা প্রতিদিনের কাজে সৃজনশীলতা ফলাতে হয়, যেমন- গ্রাফিক্স ডিজাইনার, তাদের সৃজনশীল অনুভূতির বিশ্রামের প্রয়োজন হয়।
যখন প্রয়োজন: যদি মনে হয় মাথায় কোনো চিন্তা আসছে না বা কোনো নকশা তৈরি করতে গিয়ে মনে হল কাজটা ঠিকমতো হল না বা কাজের স্পৃহা হারায় তখন বুঝতে হবে এই বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে।
পন্থা: ডা. ডাল্টন বলেন, “কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতির মাঝে থেকে সৃজনশীল বিশ্রাম নেওয়া যায়। হতে পারে সেটা সমুদ্র, পাহাড় বা যে কোনো প্রাকৃতিক জায়গা।”
বাস্তবিক কোনো জায়গায় যাওয়া ছাড়াও সংগীত শোনা, চিত্রকলা নাটক বা নৃত্যকলা উপভোগ করেও এই বিশ্রাম নেওয়া যায়।
ডা. ডাল্টন বলেন, “যেখানে শিশুসুলভ আনন্দ নিয়ে তাকিয়ে থাকা যাবে সেখানেই মিলবে সৃজনশীলতার জড়তা থেকে মুক্তি।”
আরও পড়ুন