নির্দিষ্ট বয়স হলেই যে ঋতুস্রাব একেবারে বন্ধ হওয়ার লক্ষণ দেখা দেবে, সেটা ঠিক না।
রজোবন্ধ হল নারীর জীবনের সেই পর্যায় যখন ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে। বহুবছর ধরে ঋতুস্রাবের ব্যথা, মানসিক অস্বস্তি, ‘মুড সুইং’ সহ্য করার পর রজবন্ধের ভাবনা নারীর কাছে সুখবর মনে হতে পারে। তবে রজবন্ধেরও আছে ভিন্ন অভিজ্ঞতা।
নারীর জীবনের শেষ ঋতুস্রাবের প্রায় ১২ মাস পর রজোবন্ধ হয়। এসময় প্রজননের জন্য কার্যকর দুটি হরমোন ‘ইস্ট্রোজেন’ ও ‘প্রোজেস্টেরন’ জৈবিকভাবেই কমে যায়। এই দুই হরমোনই তৈরি হয় ডিম্বাশয়ে। রজোবন্ধের আগের বছরগুলোকে বলা হয় ‘পেরিমেনোপজ’ বা ‘মেনোপজাল ট্রানজিশন’।
এই সময়টায় শরীরের হরমোনগত যে পরিবর্তনগুলো হয়। ফলাফল হিসেবে দেখা দেয় ‘হট ফ্লাশ’, মানসিক অস্বস্তি, অনিদ্রা ইত্যাদিসহ আরও নানান সমস্যা।
ঋতুস্রাবের মতোই রজোবন্ধও এমন একটি বিষয় যা নিয়ে আলোচনা হয় খুবই কম। ফলে নারীর মাঝে নানান দ্বিধাও সৃষ্টি হয়। আর গঠনমূলক আলোচনার সুযোগ না হলেও রজোবন্ধ নিয়ে প্রচলিত নানান কুসংস্কার ঠিকই শোনা হয়, যা আতঙ্কা আরও বাড়িয়ে দেয়।
ধারণা: রজোবন্ধ হয় পঞ্চাশের কোঠায়
যুক্তরাষ্ট্রের রজোবন্ধ-বিষয়ক আধুনিক চিকিৎসাকেন্দ্র ‘জেনেভ’য়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিন অ্যাঞ্জেলো রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “রজোবন্ধের স্বাভাবিক বয়স হলো ৪৫ থেকে ৫৫। এরসঙ্গে প্রথম ঋতুস্রাব, গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব, জন্মনিয়ন্ত্রণ কোনো কিছুরই সম্পর্ক নেই।”
আবার ৩০ বছর বয়স থেকেই রজোবন্ধের উপসর্গ দেখা দেওয়া সম্ভব। প্রতি দশকে সেই উপসর্গের পরিবর্তন চোখে পড়তে পারে। ধূমপানের অভ্যাস, জরায়ু অপসারণ ইত্যাদির কারণে অল্প বয়সেই রজোবন্ধ হতে পারে।
ডিম্বাশয় অপসারণ করলে সঙ্গে সঙ্গেই রজোবন্ধ হয়ে যায়। বংশগত ইতিহাসও এখানে প্রভাব ফেলবে।
ধারণা: রজোবন্ধের উপসর্গ সারাজীবন ভোগায়
জেএএমএ ইন্টারনাল মেডিসিন’য়ের দেওয়া তথ্য মতে, শরীরে ‘ইস্ট্রোজেন’ হরমোন কমে যাওয়া কারণেই রজোবন্ধ হয়। এই সময়ে কেবল শরীর বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। পরে শরীর ওই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তবে এই মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াটা বেশ লম্বা প্রক্রিয়া। গড়ে প্রায় সাত বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
অ্যাঞ্জেলো বলছেন, “বড় ধরনের সমস্যাগুলো প্রথম কয়েক বছর ভোগায়, ধীরে ধীরে কমে যায়। তবে সবার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তাই ঠিক কত দিন ভোগান্তি সইতে হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে সারাজীবন সইতে হবে না এটা নিশ্চিত।”
ধারণা: কয়েকটা মাসিক না হলে মেনোপজ হতে যাচ্ছে
এই ধারণাটা ঠিক না।
ডা. লিসা স্যাভেজ বলেন, “পুরো একটি বছর যদি ঋতুস্রাব না হয়, তবে বুঝে নেওয়া যেতে পারে মেনোপজের দিকে যাচ্ছে শরীর।
শারীরিক পরিশ্রম ভোগান্তির মাত্রা কমাতে উপকারী ভূমিকা রাখবে। আবার ‘পেরিমেনোপজ’ পর্যায়ে ঋতুস্রাব অনিয়মিত হয়। সেটাও রজোবন্ধেরই একটি লক্ষণ।
আর বিষয়টা ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতার ওপর কম-বেশি হতে পারে।
ধারণা: রজোবন্ধ একটা রোগ
রজোবন্ধকে রোগ হিসেবে দেখা মানুষ নেহাত কম নয়।
অ্যাঞ্জেলো বলেন, “রজোবন্ধের উপসর্গগুলো একজন নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে দিতে পারে একথা ঠিক। তবে তা কখনই রোগ নয়। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জৈবিক একটা ঘটনা।”
রজোবন্ধের উপসর্গগুলো সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই
অ্যাঞ্জেলো বলেন, “সমাজব্যবস্থা নারীকে নানাভাবে শিখিয়েছে দাঁত কামড়ে কষ্ট সহ্য করে নেওয়া। তবে রজোবন্ধের উপসর্গ বা কষ্টগুলো যে সহ্য করেই যেতে হবে তা নয়। বর্তমানে ঘরোয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক অনেক সমাধানই আছে যা নিরাপদ এবং কার্যকর।”
এজন্য নিয়মিত গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে, তাকে সকল কথা খুলে বলতে হবে। তবেই সমস্যাগুলো সমাধান মিলবে।
ধারণা: রজোবন্ধে শুধুই ‘হট ফ্লাশ’ হয়
ডা. স্যাভেজ বলেন, “রজোবন্ধ শরীরের তাপমাত্রাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। ‘হট ফ্লাশ’ তার মধ্যে একটি। আবার এই পর্যায়টা শেষ হলে আপনার ঠাণ্ডা লাগতে পারে, ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার পর। আবার ‘হট ফ্লাশ’ না হয়েই আপনার ঠাণ্ডা লাগতে পারে। অর্থাৎ শুধূ ‘হট ফ্লাশ’ বা গরম লাগাই রজোবন্ধের একমাত্র পরিণতি নয়।
ধারণা: ঋতুস্রাব বন্ধ তো ব্যথাও বন্ধ
এটি সুখের সংবাদ নয়, তবে তা সবারই জানা জরুরি। ‘পেরিমেনোপজ’ পর্যায়ে ‘পেলভিক ক্র্যাম্পস’ হতে পারে ঋতুস্রাব ছাড়াই।
ডা. স্যাভেজ বলেন, “জরায়ু অত্যন্ত শক্তিশালী পেশি দিয়ে গঠিত। ডিম্বাশয়ের কার্যক্রম যখন কমে যাবে, তখনও ওই পেশিগুলো সংকুচিত হতে পারে, ফলে ব্যথা দেখা দেবে। ব্যাপারটা কালেভদ্রে হলে ভয়ের কিছু নেই, তবে নিয়মিত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।”
ধারণা: রজোবন্ধের আগে গর্ভবতী হওয়া যায় না
ডা. স্যাভেজ জানাচ্ছেন, “এই সময়ে প্রজননক্ষমতা অনেক কমে যায়। তার মানে এই নয় যে গর্ভধারণ অসম্ভব। ‘পেরিমেনোপজ’ পর্যায়েও ডিম্বাণু নিষিক্ত হতে পারে। তাই জীবনের এই সময়েও অপরিকল্পিত গর্ভধারণ ঘটে যাওয়া সম্ভাবনা রয়ে যায়। এই অবস্থা এড়াতে চাইলে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হাতে রাখতে হবে, মেনে চলতে হবে।”
ধারণা: পঁয়ত্রিশের পর পিল খাওয়া যায় না
ডা. স্যাভেজ বলেন, “এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ধূমপান না করলে কিংবা কোনো ওষুধ খাওয়ার কারণে নিষেধাজ্ঞা না থাকলে ‘পেরিমেনোপজ’ পর্যায়েও রজোবন্ধের উপসর্গজনীত অস্বস্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পিল গ্রহণ করতে পারেন।”
৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত তা চালিয়ে যাওয়া যায়। এই পিলগুলো ‘ইস্ট্রোজেন’ আর ‘প্রোজেস্টেরন’ থাকে, ফলে শরীরের হরমোনের মাত্রা স্থিতিশীল থাকবে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিজে ডাক্তার হওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন