যে পুরুষ আন্তরিক বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ার জন্য যুদ্ধ করে সে আসলে একাকিত্বে ভুগছে।
Published : 04 Dec 2023, 04:04 PM
স্কুলে পাশে বসা ছেলেটি বা মাঠে খেলার সঙ্গী যে আজীবন বন্ধু থাকবে এমন কোনো কথা নেই।
বরং এগুলো হল জীবনের অভিজ্ঞতা। এদিকে গবেষণা বলছে গভীর ও অর্থপূর্ণ বন্ধুত্ব বড়বেলায় তৈরি করা সত্যি কঠিন।
‘সার্ভে সেন্টার অন আমেরিকান লাইফ’য়ের ২০২১ সালে করা জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে সিএনএন ডটকম জানায়, জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকেরও কম পুরুষ জানিয়েছে তারা বন্ধুত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট। আর ১০ জন নারীর মধ্যে চার জনের তুলনায় পুরুষদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন জানিয়েছে যে, তিনি বিগত সপ্তাহে মানসিক সহায়তা পেয়েছেন বন্ধুর কাছ থেকে।
“পুরুষদের বন্ধুর সংখ্যা কমা শুরু হয় মধ্য বয়স থেকে। আর বয়স বৃদ্ধির সাথে এর পরিমাণ সম্পূর্ণ রূপে বাড়তে থাকে”- সিএনএন ডটকম’য়ের প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সি’তে ‘বয়েজস সাইকোলজি ডেভেলপমেন্ট’ নিয়ে পাঠদান করা শিক্ষক ওয়াই-চুং চু।
তারপরও যারা থেকে যায় তাদের মধ্যে নারীদের তুলনায় মানসিক আন্তরিকতা খুবই কম থাকে।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও ‘অ্যাপ্লাইড সাইকোলজি’র শিক্ষক ড. নাইয়োবি ওয়ে এক্ষেত্রে বলেন, “মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা ছেলেরা শুরু করে না, বরং হয়ে যায়।”
মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্যের সাথে মানসিকভাবে আন্তরিক, কাছাকাছি থেকে যোগাযোগ রক্ষা করা।
চু বলেন, “শিশুকাল থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক আমাদের প্রয়োজন।”
নিউ জার্সির রিজউড নিবাসী মনোবিজ্ঞানি ডা. ফ্র্যাঙ্ক সিলিও জানান, গবেষণায় দেখা গেছে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষায় আন্তরিক বন্ধুর প্রয়োজন রয়েছে। আর যেসব পুরুষ এই সম্পর্কের জন্য যুদ্ধ করেন তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর সমস্যা ভুগছেন- সেটা হল ‘একাকিত্ব’।
তবে গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মানসিক কষ্ট প্রকাশের মাধ্যমে পুরুষদের মানসিক অবস্থার উন্নতি হতেও দেখা গেছে, তাদের বোঝার ক্ষমতার উন্নতি ঘটেছে এবং একাকী বোধ করার বিষয়টাও কমেছে- জানান তিনি।
যে কারণে পুরুষদের কাছের বন্ধু তৈরিতে বাধা আসে
১৯৯৫ সালে সিলিও যখন ‘পুরুষের বন্ধুত্ব’ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তখন অনেক অংশগ্রহণকারী ভেবেছিল এই জরিপ হয়ত ‘সমকামিতা’ নিয়ে। এই ধরনের গতবাঁধা চিন্তাধারা প্রাকৃতিকভাবেই ঠিক না। তবে তিনি জানান, এর ফলে একটা বিষয় উঠে আসে যে- এই কারণেই পুরুষরা পুরুষদের সাথে গভীর বন্ধুত্ব গড়া থেকে পিছু হটে।
“প্রায় ৩০ বছর পর এই অনুমানের ভিন্নতা এসেছে। বরং সামাজিক চাপের কারণে পুরুষদের আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে”- বলেন সিলিও।
ড. ওয়ে ব্যাখ্যা করেন, “আমরা সকলেই দুটো দিক নিয়ে জন্মাই। একটা হল কঠিন দিক- যেখানে আমরা আত্মনির্ভরশীল ও আত্মনিয়ন্ত্রিত। অন্যটা হল নরম দিক- যেখানে আমরা ভঙ্গুর ও পরনির্ভরশীল।”
কঠিন দিকটা সহজাতভাবে পুংলিঙ্গের জন্য আর নরম দিকটা স্ত্রীলিঙ্গের জন্য হিসেবে ধরা হয়।
ছেলের বড় হওয়ার সময় থেকেই ধারণা দেওয়া হয় ‘পুরুষ হতে হবে’। মানে কোমল দিকটা রাখতে হবে কম- আর এই ধরনের মানসিকতা স্নায়ুবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ও মানসিক উন্নতির ক্ষেত্রে ক্ষতিকর।
চু বলেন, “আমরা বিষয়টা মেয়েলি হিসেবে চিহ্নিত করি। দুর্বলতা বা পরনির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের প্রয়োজন মনে করলে পুরুষকে মেয়েলি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।”
সিলিও বলেন, “এভাবে লিঙ্গ-ভিত্তিক চারিত্রিক বিশ্লেষণে পরিষ্কার প্রভাব পড়ে পুরুষের ওপর। ফলে আবেগ প্র্রকাশে বাধাগ্রস্ত হয়ে শক্তি প্রকাশের দিকে নজর দেয়। আর যে যত বেশি এই দিকে নজর দেয় তার কাছের বন্ধুও হয় কম।”
“কঠিন হতে গিয়ে যখন পরনির্ভরশীলতা থেকে দূরে থাকে তখন বন্ধু্ত্বের সম্পর্ক থেকেও দূরে সরতে থাকে পুরুষ। ফলে তার মধ্যে দেখা দেয় একাকিত্ব, রাগ ও সহিংসতা”- বলেন ডা. ওয়ে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “আমরা এমন এক সংস্কৃতিতে বাস করছি যা প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা যদি সন্তানদের প্রকৃতির বিরূদ্ধে গিয়ে লালন পালন করি তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এদের মধ্যে কেউ কেউ কষ্ট করে বেড়ে উঠবে।”
রোমান্টিক সঙ্গী এক্ষেত্রে যে কারণে যথেষ্ট না
ডা. ওয়ে বলেন, “হেট্রোসেক্সুয়াল’ বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হওয়া পুরুষদের জীবনে সেসব নারী ও রোমান্টিক সঙ্গী থাকেন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে নিজের দুর্বলতা অন্বেষণে স্বচ্ছন্দ বোধ করে ছেলেরা।”
সিলিও মন্তব্য করেন, “মনে হতে পারে এটা ভালো একটা সমাধান। তবে পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে বিষয়টা সেভাবে কাজ করে না।”
সব কিছু রোমান্টিক সঙ্গীর ওপর ঢেলে দিলে সম্পর্কে টান টান ভাব আসতে পারে। হতে পারে সেটা সঙ্গীর কাছ থেকে মানসিক সহায়তা পাওয়া বা বন্ধুত্বের চাষ করে বন্ধের দিনে সময় কাটানো।
“সমর্থন পাওয়া ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মানুষের কাছে যাওয়া উচিত”- বলেন চু।
আরও বলেন, “পুরুষদের জানতে হবে হবে এটা শুধু মেয়েলি বিষয় না, তারাও অন্যের মানসিক সহচার্য নিতে পারে।”
“একজন পুরুষ সঙ্গী মনে করেন অন্যের সাথে কথা বলা হয়ত বিশ্বাসঘাতকতা” বলেন ডা. ওয়ে, “তবে তার নারী সঙ্গীই বলছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী পেতে অন্যের সাথে কথা বল।”- গবেষণায় এরকমই দেখা গেছে।
যেভাবে বন্ধুত্ব গড়া যায়
যদি কোনো পুরুষ মনে করেন কারও সাথে কাছের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলবেন তবে ছোট থেকে শুরু করা শ্রেয়।
চু বলেন, “প্রথমেই নিজের দুর্বলতাগুলো প্রকাশ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। খুবই গুরুত্বপূর্ণ শুরু হতে পারে ঠিকমতো শোনা এবং সঠিক প্রশ্ন করা।”
সব মানুষই এই ধরনের পরিস্থিতে যাকে নিরাপদ মনে করে তাকে বিশ্বাস করতে পছন্দ করে, তারপর কারও প্রতি সত্যিকারভাবে আগ্রহ জাগে।
এই ক্ষেত্রে প্রধান চাবিকাঠি হল- সাধারণ আড্ডা দিতে দিতে অর্থপূর্ণ কোনো প্রশ্ন করা। সেটা হতে পারে কর্মক্ষেত্র বিষয়ক আলাপ বা সম্পর্ক ভাঙার পর কেমন লেগেছিল সেই বিষয়ে প্রশ্ন করা- পরামর্শ দেন ডা. ওয়ে।
সিলিও বলেন, “প্রতিটা সম্পর্কের আলাদা নিয়ম নীতিতে চলে। আর সেটাকে সেভাবেই কাজ করতে দিতে হয়।”
এই ক্ষেত্রে চু বলেন, “হয়ত কোনো প্রশ্ন করার পর সেই বন্ধু উত্তর দিতে দ্বিধা বোধ করছে- এই পরিস্থিতে নিজের দুর্বলতার বিষয়টা প্রকাশ করে বলা যেতে পারে, আপনি বিষয়টা কীভাবে দেখছেন বা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন।”
অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের নিয়মকানুন ও দুর্বলতা কেটে যায় মুখোমুখি আলোচনায়। এক্ষেত্রে কাজের মিল আছে এমন কোনো বিষয় অংশ নেওয়া যেতে পারে। যেমন- একসাথে ব্যায়ামাগারে যাওয়া, বা কোনো সামাজিক কাজে জড়ানো। এসব থেকেও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
সময় দেওয়া, চেষ্টা ও মনোযোগ হল মূল চাবিকাঠি। কঠিন সময়ে সঙ্গ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুত্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
আরও পড়ুন