আমাদের প্রতিটি দিন শুরু হয় কাজের ব্যস্ততায়, আবার চোখের পলকে দিনটি শেষ হয়ে যায়৷ এ ব্যস্ততার কারণে মা-বাবার মনে ভয় তৈরি হয় এই ভেবে যে, আমি বোধহয় আমার সন্তানটিকে যথেষ্ট পরিমাণ সময় দিতে পারছি না!
Published : 15 Nov 2021, 01:41 PM
মা-বাবার মনে শঙ্কা তৈরি হয়, সময় না দেওয়ার কারণে হয়তোবা আমার শিশুর বিকাশ বয়সের তুলনায় পিছিয়ে থাকবে! এ কারণেই অনেক মা-বাবা, বিশেষ করে মায়েরা নিজেদের চাকরি-ব্যবসা বা নিজের জন্য একটু আলাদা সময় বের করতে গিয়ে অপরাধবোধে ভোগেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে যখন অন্য বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার, একসঙ্গে বিভিন্ন বয়স উপযোগী কাজ করার ছবি বা ভিডিও দেন, এই অপরাধবোধ তখন আরও বেড়ে যায়।
আজ এ লেখায় যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে-
১. কোয়ালিটি টাইম কী
২. কেন গুরুত্বপূর্ণ
৩. কে কে শিশুকে কোয়ালিটি টাইম দিতে পারবেন
৪. কীভাবে শিশুকে কোয়ালিটি টাইম দিতে পারবেন এবং
৫. গৃহিণী মা নাকি চাকরিজীবি মা, কে শিশুকে কোয়ালিটি টাইম বেশি দেন?
কোয়ালিটি টাইম কী?
‘কোয়ালিটি’ শব্দের সহজ বাংলা গুণগত। ‘কোয়ালিটি টাইম’ হলো শিশুকে গুণগত সময় দেওয়া, শিশু যে কাজগুলো করতে বা খেলতে পছন্দ করে তার সঙ্গে সেই কাজগুলো করা বা খেলা এবং শিশুর পছন্দের কাজগুলো করার সময় শিশুকে পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়া।
আমাদের সমাজের মা-বাবারা ‘কোয়ালিটি টাইম’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন খুব বেশি দিন হয়নি। শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হলেও বেশিরভাগ বাবা-মায়েরা এ শব্দটির মূলকথা বুঝতে পারেননি। তাইতো অনেকের কাছে ‘কোয়ালিটি টাইম’ মানে শিশুকে খেলনা দিয়ে পাশে বসিয়ে রেখে নিজে টিভি বা মোবাইল দেখা। অনেক বাবা-মায়ের কাছে ‘কোয়ালিটি টাইম’ মানে শিশু যা-ই করুক না কেন শিশুর কাজটি না দেখে, শিশুর প্রতিটি কাজের ছবি তুলে রাখা, ভিডিও করে রাখা এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করা।
কোয়ালিটি টাইমের গুরুত্ব
‘জার্নাল অব ম্যারেজ অ্যান্ড ফ্যামিলি’ ২০১৫ সালে একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। এ রিসার্চ অনুযায়ী শিশুর বিকাশে কোয়ান্টিটি অব টাইম (সময়ের পরিমাণ) নয় উল্টো কোয়ালিটি অব টাইম (সময়ের গুণগত ব্যবহার) বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে শিশুর বিকাশ বলতে মূলত শিশুর আচরণ, মানসিক সুস্থতা এবং শিশুর স্কুলের রেজাল্টকে বোঝানো হয়েছে। এ রিসার্চ অনুযায়ী শিশুর সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটাতে শিশুকে অনেক লম্বা সময় দিতে হবে এমন নয়। প্রতিদিন যদি শিশুকে অল্প কিছু মিনিট কোন ধরনের বাধা ছাড়া পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়া হয় তাহলে ওই সময়টাই হবে শিশুর জন্য ‘কোয়ালিটি টাইম’।
কোন কাজগুলো কোয়ালিটি টাইম নয়?
১. যখন শিশু ও বাবা-মা একই জায়গায় অবস্থান করছে, কিন্তু তারা ভিন্ন ধরনের কাজ করছে, যেমন- শিশু বল খেলছে এবং মা সবজি কাটছেন।
২. যখন শিশু একটি কাজ করছে এবং পাশে বসে বাবা অথবা মা মাঝেমধ্যে শিশুকে মনোযোগ দিচ্ছেন আবার মনযোগ দিচ্ছেনও না। যেমন, শিশুটি বাবার পাশে বসে ছবি আঁকছে। বাবা মোবাইলে গেম খেলছেন, মাঝে মাঝে ছেলেকে প্রশ্ন করে জানতে চাইছেন শিশু কী আঁকছে।
কে কে শিশুকে কোয়ালিটি টাইম দিতে পারবেন?
বাবা, মা, ভাই, বোন, যে কোন আত্মীয়, ন্যানি, শিশুর সমবয়সী যে কেউ ও অন্যান্যরা শিশুকে কোয়ালিটি টাইম দিতে পারবেন।
শিশুর সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম উপভোগ করতে আপনাকে অনেক প্ল্যান করতে হবে বা অনেক খরচ করতে হবে এমন নয়। কোয়ালিটি টাইমের মূল উদ্দেশ্য একসঙ্গে কাটানো সময় উপভোগ করা। যেমন- শিশুর সঙ্গে পিকাবু খেলা, শিশুর সঙ্গে ছবি আঁকানো, শিশুকে ব্রেডে মাখন কীভাবে লাগাতে হয় তা শেখানো, শিশুর সঙ্গে কোন পাজল সলভ করা ইত্যাদি৷
কোয়ালিটি টাইম নিয়ে পরিবারের প্রতি পরামর্শ
১. শিশুর সঙ্গে বিভিন্ন সময় খেলা করুন। হতে পারে তা শিশুকে গোসল করানোর সময় বা শিশুকে স্কুলে নামিয়ে দেওয়ার সময়৷ খেলা যে শুধু খেলনা দিয়ে খেলা যায় এমন নয়।
২. প্রতিদিন আপনার সন্তানকে জানান আপনি তাকে ভালোবাসেন এবং সে আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তার সব কাজে আপনি কেমন অনুভব করেন তাও সন্তানকে বলুন। যদি আপনি সন্তানের থেকে দূরে কোথাও থাকেন ভিন্ন শহর বা দেশের বাইরে সেক্ষেত্রে সন্তানের সঙ্গে ফোনে অডিও বা ভিডিও কলে নিয়মিত কথা বলুন। ফোনের মাধ্যমে তাকে ভালোবাসা ও স্নেহ জানান।
৩. শিশুকে হাসির কিছু বলে বা করে একসঙ্গে হাসাহাসি করুন।
৪. শিশুর যে আচরণ আপনি তার কাছে আশা করেন, শিশু তা করলে তার প্রশংসা করুন। প্রশংসার মাধ্যমে শিশুকে উৎসাহ দিন।
৫. শিশুকে জিজ্ঞেস করুন সে কোন ধরনের খেলা বা কাজে আগ্রহী। শিশুর মতামত নিয়ে শিশুর সঙ্গে সময় কাটান। শিশুর পছন্দের খেলা বা কাজ করুন।
৬. যদি আপনার রুটিনের সঙ্গে শিশুর সময় না মেলে সেক্ষেত্রে শিশুর জন্য ছোট চিরকুট রেখে যেতে পারেন। শিশু নিজে পড়তে না পারলে বাসায় শিশুর যে কেয়ারগিভার থাকবে সে শিশুকে তা পড়ে শোনাবে।
৭. ঘরের কাজে শিশুর সহযোগিতা নিন। একসঙ্গে কাজ করলে নিজেরা কমিউনিকেট করার মতো বেশ কিছুটা সময় পাবেন।যেমন- একসঙ্গে গাছে পানি দেওয়া, রান্না করা ইত্যাদি।
৮. প্রতিদিন খাবারের সময় একসঙ্গে বসে খাবার খান।
৯. শিশুর সঙ্গে সময় কাটানোর সময় যাবতীয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস সরিয়ে রাখুন। মোবাইল দিয়ে ম্যাসেজ করা, কথা বলা, অকারণে ফোনে স্ক্রোল করা, গেম খেলা, টিভি দেখা ইত্যাদি করা থেকে বিরত থাকুন।
গৃহিণী মা নাকি চাকরিজীবি মা, কে শিশুকে কোয়ালিটি টাইম বেশি দেন?
যে কোন মা সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম দিতে পারেন। চাকরিজীবী মা বাসায় এসে যদি ঘরের বা অফিসের কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে যান, শিশুর সঙ্গে সময় না কাটান তাহলে শিশু কোয়ালিটি টাইম পাবে না। একইভাবে গৃহিণী মা যদি ঘরে থাকা অবস্থায় সারাদিন ঘরের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন এবং সন্তানের জন্য আলাদা করে সময় বের না করেন তাহলে গৃহিণী মায়ের সন্তানও কোয়ালিটি টাইম পাবে না।
মায়ের কর্মজীবনের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইমের কোন সম্পর্ক নেই। তাই কর্মজীবী মায়েরা হীনমন্যতায় ভুগবেন না। বাবা ও মা আপনারা যতই ব্যস্ত থাকুন, সময় বের করে সন্তানের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটান। আবারও বলছি কোয়ালিটি টাইম মানে শিশুকে সারাদিন সময় দেওয়া নয়।
লেখক পরিচিতি: অ্যাসিসট্যান্ট এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট, ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এ লেখকের আরও লেখা
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected]। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |