এমন শিশুর মা-বাবা যদি মানসিকভাবে সব সময় চাপে থাকেন তাহলে তার প্রভাব সরাসরি সন্তানের উপরেও পড়তে পারে। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে ‘জার্নাল অব অটিজম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের মা-বাবার মানসিক চাপ বেশি হলে তা শিশুর ইন্টারভেনশন প্ল্যান ও থেরাপিকে বাধাগ্রস্ত করে৷
এছাড়া মানসিক চাপের কারণে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর বাবা-মায়েদের বৈবাহিক জীবন ও অন্যান্য মানুষদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
মানসিক চাপে কী ধরনের পরিবর্তন হতে পারে?
১. শারীরিক পরিবর্তন- হৃদস্পন্দন দ্রুত হওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হওয়া, পেশিতে টান অনুভব হওয়া, ঘাম হওয়া, মাথা ব্যথা ইত্যাদি।
২. চিন্তায় পরিবর্তন- নেতিবাচক চিন্তা (যেমন- আমি বাবা/মা হিসেবে ব্যর্থ), অমনোযোগী, অতিরিক্ত চিন্তা, সিদ্ধান্তহীনতা ইত্যাদি।
৩. আচরণের পরিবর্তন- ঘুমের পরিবর্তন, খাদ্যাভাসের পরিবর্তন, অস্থিরতা, সমস্যা থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া ইত্যাদি।
৪. অনুভূতির পরিবর্তন- রাগ, ভয়, দুঃশ্চিন্তা, বিষন্নতা ইত্যাদি।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর বাবা-মায়ের মানসিক চাপের কারণ-
১. বাস্তবতা মেনে নিতে না পারা- অনেক বাবা-মা মেনে নিতে পারেন না তাদের সন্তানের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। যার ফলে তারা দ্বিধা, দ্বন্দ, রাগ, বিষন্নতা ইত্যাদি পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যান। যেহেতু তারা বাস্তবতা মেনে নিতে পারছেন না তাই তাদের সন্তানকে নিয়ে তারা কোন ধরনের থেরাপির ভেতর যেতে চান না।
২. অনেক বাবা- মা সন্তানকে সময় দিতে গিয়ে নিজের কোন যত্ন নেন না। সাইকোলজিস্ট ডাক্তার ওয়েন্ডি ব্লুমেন্থালের মতে, অনেক মায়েরা তাদের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুকে সময় দেওয়া নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত থাকে যে ঠিকভাবে ঘুমান না, সব সময় উদ্বিগ্ন থাকেন, সব সময় সন্তানকে নিয়ে বিভিন্ন ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট ও থেরাপিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেন যেন তার সন্তানের সমস্যাগুলো ঠিক করা যায়।
৩. একাকিত্ব ও অবসাদগ্রস্ততা- সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকায় অনেক বাবা-মায়েরা কাছের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। অনেকে সন্তানকে আত্মীয়দের বাসায় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে হীনমন্যতায় ভুগেন। ফলে শিশুর পাশাপাশি শিশুর বাবা-মা একাকীত্বে ভোগা শুরু করেন ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
৪. ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি জরিপ অনুযায়ী বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বাবা-মায়েদের আর্থিক চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যা স্বাভাবিকভাবে বিকাশ হওয়া শিশুদের বাবা-মায়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি।
৫. ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর বিভিন্ন ধরনের আচরণগত সমস্যা (যেমন আক্রমনাত্মক স্বভাব) তাদের বাবা-মায়ের বিষন্নতার অন্যতম কারণ।
৬. অনেক বাবা-মা শুরুতে সন্তানের চাহিদার বিষয়গুলো গুরুত্ব দিলেও দ্রুত কোন পরিবর্তন না আসায় পরবর্তীতে হতাশ হয়ে যান। ফলে তারা তাদের সন্তানের চাহিদাগুলো অবহেলা করতে শুরু করেন।
৭. আবার অনেক বাবা-মায়েরা তাদের যে সন্তানটির বিকাশ স্বাভাবিক তাকে তুলনামূলক বেশি বা পুরো সময় দেওয়ার মাধ্যমে তাদের যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুটি আছে তাকে ভুলে থাকতে চান। কিন্তু, যদিও বাবা-মা নিজেদের মনোযোগ অন্য সন্তানটিকে বেশি দিয়ে থাকেন তবুও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুটিকে মনোযোগ কম দেওয়ায় অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন।
মানসিক চাপ কমাতে নিজের যত্ন-
মানসিক চাপ কমাতে অবশ্যই আপনাকে নিজের প্রতি যত্ন বাড়াতে হবে৷ কীভাবে বুঝবেন আপনি আপনার নিজের যত্ন নিচ্ছেন না? নিজেকে নিচের লেখা প্রশ্নগুলো করুন-
১. প্রতিদিন আপনি নিজের জন্য কী কী কাজ করছেন?
২. শেষ কখন আপনি আপনার বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন?
৩. শেষ কখন আপনি আপনার স্বামী/ স্ত্রীর সঙ্গে একান্ত সময় কাটিয়েছেন?
৪. আপনি কি পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে পারেন?
এ সবগুলো প্রশ্নের উত্তর যদি নেতিবাচক হয় তাহলে বুঝতে হবে আপনি আপনার নিজের যত্ন নিচ্ছেন না।
কীভাবে নিজের যত্ন নিতে পারেন?
১. প্রয়োজনে পরিবারের অন্য সদস্যদের সহায়তা চান। পরিবারের সবাই বিভিন্ন দায়িত্বগুলো নির্দিষ্টভাবে ভাগ করে নিতে পারেন। এতে একজনের উপরে চাপ কম পড়বে। অনেকেই অন্যদের কাছে সহায়তা চাইতে বিব্রতবোধ করে থাকেন। কিন্তু নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সরাসরি এই বিষয় নিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে সহায়তা চাইতে হবে।
২. প্রয়োজনে ‘না’ বলুন। অন্যকে খুশি করতে সব বিষয়ে হ্যাঁ বলবেন না। যদি কোন কাজ আপনি করতে না চান সেক্ষেত্রে সরাসরি না করুন।
৩. একাকিত্ব দূর করতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। তাদের বাসায় দাওয়াত দিন। নিজেরাও তাদের বাসায় যান।। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিন।
৪. সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরি করুন। অন্যান্য বাবা-মা যাদের সন্তানেরও বিশেষ চাহিদা রয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। কীভাবে অন্যরা সন্তানের পাশাপাশি নিজেদের যত্ন করছে তা জানার চেষ্টা করুন। নিজের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করুন।
৫. সন্তানের শারীরিক সুস্থতা ও অন্যান্য বিষয়গুলো অনুকূল হলে সন্তানকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে পারেন।
৬. ব্যস্ততার মাঝে সময় বের করে সেইসব কাজ করার চেষ্টা করুন যা আপনাকে আনন্দ দেয়। যেমন- বই পড়া, ছবি আঁকা, বাগান করা ইত্যাদি।
৭. সন্তান ও নিজের যত্নের পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্কের যত্ন নিন। দুজন দুজনকে প্রশংসা করুন। পরিবারে তার গুরুত্ব তাকে জানান। তাকে কতটা ভালোবাসেন তাও জানাতে পারেন। মাঝে মাঝে একে অপরকে উপহার দিতে পারেন। সন্তান যখন স্কুলে বা থেরাপি সেশনে থাকবে সেই সময় নিজেদের সময় দিন।
৮. মানসিক অবসাদগ্রস্ততা কমাতে নিজের চাহিদায় মনোযোগ দিন। এজন্য সঠিক সময়ে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পরিমাণমতো পানি খাওয়া, পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম, শিশুকে ছাড়া কিছুটা সময় একা কাটানো ইত্যাদি জরুরি।
৯. আর্থিকভাবে সচ্ছল হলে প্রয়োজনে গৃহকর্মী বা ন্যানি রাখুন। অন্য কেউ নির্দিষ্ট সময় সন্তানের দায়িত্ব নিলে শিশুর বাবা-মা নিজের যত্নের জন্য কিছুটা সময় পাবে।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বাবা-মায়েরা যখন নিজের যত্ন নেবেন তখন তারা মানসিক ও শারীরিক চাপে তুলনামূলক কম থাকবেন৷ তাই নিজে ভালো থাকতে ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে (স্বামী/স্ত্রী, সন্তান) ভালো রাখতে নিজের শারীরিক ও মানসিক যত্ন নিন।
লেখক পরিচিতি: অ্যাসিসট্যান্ট এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট, ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এ লেখকের আরও লেখা
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |