বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ এর সুর ‘বিকৃত করার’ অভিযোগে গত কয়েকদিন ধরেই সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছেন ভারতীয় সুরকার এ আর রহমান। এবার এই বিতর্ককে আরো উসকে দিলেন নজরুলের নাতনি, প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী কল্যাণী কাজীর কন্যা অনিন্দিতা কাজী।
রাজাকৃষ্ণ মেনন পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক হিন্দি সিনেমা ‘পিপ্পা’র জন্য নজরুলের ওই গানটির নতুন কম্পোজিশন করেন অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান। কিন্তু শ্রোতাদের অনেকের অভিযোগ, এ আর রহমানের হাতে পড়ে গানটি থেকে বিদ্রোহই হারিয়ে গেছে। অনেকেই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন সোশাল মিডিয়ায়।
কবি পরিবারের সদস্যরাও বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেননি। শনিবার ফেইসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্টে মূল গানের স্বত্ব হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনিন্দিতা।
নিউ জার্সি প্রবাসী অনিন্দিতা লিখেছেন, “দাদুর 'কারার ঐ লৌহকপাট' গানটির সুর বিকৃতি ঘটিয়েছেন বিশিষ্ট গীতিকার সুরকার শিল্পী এ আর রহমান। গোটা বিশ্ব জুড়ে বিতর্কের ঝড়, তোলপাড়। আমার মা কল্যাণী কাজী, যার বেঁচে থাকাই ছিল নজরুলকে নিয়ে, নজরুলকে ঘিরে, নজরুলকে তিনি ধারণ করেছিলেন... তিনি ২০২১ সালে গানটি অবিকৃত রেখে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানতে পারি। কিন্তু এর পরিণতি এমন হবে, তিনি মৃত্যুর পরেও ভাবতে পারেননি বোধ হয়।’’
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, প্রচুর টাকার বিনিময়ে নাকি গানটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফেইসবুক পোস্টে তারও উত্তর দিয়েছেন অনিন্দিতা।
তিনি বলেছেন, “সে ক্ষেত্রে ২০২১ সালে কী এগ্রিমেন্ট হয়েছিল, সেটা জানা খুব প্রয়োজন, তা হলে সব বিতর্কের অবসান হবে। এবং যারা এগ্রিমেন্ট-এর বিপক্ষে গিয়ে এই কাজটি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।’’
অনিন্দিতা লিখেছেন, চুক্তির কাগজ তার ভাই কাজী অনির্বাণের কাছে রয়েছে বলে তিনি সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছেন। পরিবারের অন্যতম সদস্য হিসেবে চুক্তিপত্র দেখে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করতে চান তিনি। আর তাই সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন।
এদিকে শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের কাছে এ আর রহমানের কঠোর সমালোচনা করছেন কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি খিলখিল কাজী। সুরকারের উদ্যোগকে ‘গর্হিত অপরাধ’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
সম্প্রতি নজরুলের নাতি অনির্বাণ কাজী গানটি বিকৃত করার অভিযোগ এনেছেন; গানের ‘ক্রেডিট লাইন’ থেকে তার পরিবারের নাম মুছে ফেলারও দাবি জানিয়েছেন।
অনির্বাণের ভাষ্য, “আমরা বুঝতে পারিনি যে রহমানের মত একজন শিল্পী এতটা অসংবেদনশীল হতে পারে; গানটিকে হত্যা করতে পারে। প্রতিবাদ হিসেবে, আমি চলচ্চিত্রের ক্রেডিট লাইনে 'বিশেষ ধন্যবাদ'-এ আমাদের পরিবারের নাম চাই না।
“রহমানকে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই জানতে চাই, তাকে কে অধিকার দিল গানটি বিকৃত করার। স্বত্ব দেওয়ার সময় তো সুর বদলের কথা বলা হয়নি। কী রকম একটা করে দিয়েছে গানটাকে! একটা গ্রামীণ সংগীতের মত, ভাটিয়ালির মত করে দিয়েছে। অনেক সস্তা করে দিয়েছে।”
এদিকে রহমানের এই সৃষ্টি দেখে আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে হতাশা উগড়ে দিয়েছেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী ও হৈমন্তী শুক্লাও।
নজরে আসার পর গানটির কিছু অংশ শুনে ভালো লাগেনি বলে জানিয়েছেন অজয় চক্রবর্তী।
তার কথায়, “তার মত অত্যন্ত সুপরিচিত সুরকারের কাছে আমরা এটা আশা করি না। এর জন্য সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন। লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানানো উচিত। এই ধরনের গান বাঙালিদের মনে একটা অন্য অর্থ বহন করে। সেখানে নাড়া দিলে তো ভাল লাগবে না। তার আরও গবেষণা করে কাজটায় হাত দেওয়া উচিত ছিল।’’
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে বর্ষীয়ান সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লাকেও।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেছেন, “বাংলার সংগীত নিয়ে যে তার কোনও ধারণা নেই, সেটাই বুঝতে পারলাম। বাঙালি সংস্কৃতিকে এরা ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে। যে কাজ ভালো তার প্রশংসা করতেই হয়। একইভাবে কোনো খারাপ কাজের সমালোচনাও করা উচিত। রহমান কীভাবে এই সাহস অর্জন করলেন, তা ভেবে অবাক হয়ে গিয়েছি।’’
১৯২১ সালে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি লিখেছিলেন নজরুল, যা পরের বছরের ২০ জুন ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকায়।
ওই পত্রিকার সম্পাদক ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশ যখন কারারুদ্ধ হন, তখন তার স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে বাংলার মানুষকে নিয়ে কবিতা হিসেবে সেটি লিখেছিলেন জাতীয় কবি। ১৯৪৯ সালের জুন মাসে গিরীন চক্রবর্তীর কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল।