এআইকে ‘সৃজনশীল পেশার অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করে এর প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছে এসএজি-এএফটিআরএ।
Published : 16 Jul 2023, 10:16 PM
চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবার ধর্মঘটে গেছেন হলিউডের অভিনয় শিল্পীরা, যাতে স্থবির হয়ে পড়েছে মার্কিন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ব্যবসা।
যেসব কারণে তাদের এই ধর্মঘট, তার একটি হল বিনোদন জগতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এর ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে শিল্পীদের উদ্বেগ।
বিবিসি জানিয়েছে, হলিউডে এআই ব্যবহারের কারণে পেশাগতভাবে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে সুরক্ষায় স্ট্রিমিং স্টুডিও কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে ‘স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড এবং দি আমেরিকান ফেডারেশন অব টেলিভিশন অ্যান্ড রেডিও আর্টিস্টস’ (এসএজি-এএফটিআরএ)।
এআইকে ‘সৃজনশীল পেশার অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করে এর ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছে অভিনয় শিল্পীদের সংগঠনটি।
এআই এর ব্যবহার নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রযোজকরা যেসব প্রস্তাব করেছেন, সেসবের সমালোচনা করেছেন এসএজি-এএফটিআরএ’র প্রধান সমন্বয়ক ডানকান ক্র্যাবট্রি-আয়ারল্যান্ড।
তিনি বলেন, কোনো শিল্পী পারিশ্রমিকের বিনিময়ে একদিন কাজ করলেও তার চেহারা স্ক্যান করে রাখার অধিকার দাবি করেছে স্টুডিওগুলো। এরপর সেই স্ক্যান প্রতিলিপির মালিকানা থাকবে তাদের হাতে এবং অনন্তকাল তারা সেগুলো ব্যবহার করতে পারবে। শিল্পীর সম্মতি ছাড়াই বা তাকে কোনো অর্থ না দিয়েই সেই প্রতিলিপি ব্যবহার করতে পারবে স্টুডিওগুলো।
বিবিসি লিখেছে, এটা যেন চার্লি ব্রুকারের টেলিভিশন সিরিজ ‘ব্ল্যাক মিরর’ এর একটি পর্বের গল্পের মত। আর সে কারণেই অভিনয় শিল্পীদের ভয়।
ব্ল্যাক মিররের ষষ্ঠ পর্ব ‘জোয়ান ইজ অফুল’-এ দেখা যায়, হলিউড তারকা সালমা হায়েক হঠাৎ আবিস্কার করেন, তার এআই প্রতিলিপি রয়েছে একটি প্রযোজনা সংস্থার হাতে, যারা তার অজান্তেই ওেই স্ক্যান প্রতিরূপ ব্যবহার করতে পারে।
শিল্পীদের এই ‘পারফর্মেন্স ক্লোনিং’ নিয়ে কেবল ‘এসএজি-এএফটিআরএ’ সদস্যরাই উদ্বিগ্ন নন।
‘ইউকে অ্যাক্টিং ইউনিয়ন ইক্যুইটি’র লিয়াম বাড বলেন, “অটোমেটেড অডিওবুকস, ভয়েসওভারের কাজ, করপোরেট ভিডিওর জন্য ব্যক্তির ডিজিটাল প্রতিরূপ ও সিনেমায় কোনো ব্যক্তির ডিজিটাল অবয়ব তৈরির কাজে এই প্রযুক্তির ব্যবহার হতে দেখছি আমরা।”
তিনি বলেন, ইক্যুইটি সদস্যদের মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আর দ্রুত পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে সংগঠনের সদস্যদের অধিকারের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করছে ইউকে অ্যাক্টিং ইউনিয়ন ইক্যুইটি।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক জাস্টিন বেইটম্যান এ বছরের শুরুতে বিবিসি টেক লাইভকে বলেছিলেন, বিনোদন শিল্পে এআই এর আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না।
“প্রযুক্তির উচিত সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু তারা যেখানে এআই ব্যবহার করছে, সেখানে সমাধান করার মত কোনো সমস্যাই নেই। আমাদের লেখকের অভাব নেই, অভিনেতার অভাব নেই, চলচ্চিত্র নির্মাতার অভাব নেই… তাই এআই ব্যবহারেরও আমাদের প্রয়োজন নেই।”
তার মতে, বিনোদন জগতে এআই কেবল সেই প্রযোজনা কোম্পানিগুলোর সমস্যার সমাধান করতে পারে, যারা মনে করছে, এ ব্যবসা থেকে যথেষ্ট লাভ তাদের হচ্ছে না।
“আপনার যদি সবাইকে টাকা দিতে না হয়, তাহলে আপনার খরচ অনেক কমে আসবে। তাতে আপনি ওয়াল স্ট্রিটকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন, আরও বেশি লাভের প্রতিবেদন হাতে পাবেন।”
জাস্টিন বেইটম্যান বলেন, যদি এআই এর ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, তবে ওই প্রযুক্তি বিনোদন শিল্প ব্যবসার পুরো কাঠামোকে গ্রাস করবে।
অন্যদিকে চ্যাটজিপিটি বা বার্ড সৃজনশীল সিনেমার স্ক্রিপ্ট বা কোনো চিন্তাকে ব্লকবাস্টার চিত্রনাট্যে রূপান্তরিত করতে পারছে কিনা, তা দেখতে এখন কেবল অপেক্ষা করার পালা।
কারও কারও মতে, এআই এর মানবিকতা নেই, তাতে এআই দিয়ে দারুণ সব সিনেমার স্ক্রিপ লেখানো সম্ভব। কিন্তু তাতে এআই যে লেখকদের জায়গা দখল করে তাদের বেকার বানাবে, সেই উদ্বেগও মিথ্যে নয়।
টিভি, চলচ্চিত্র, থিয়েটার ও বইয়ের লেখকদের সংগঠন রাইটার গিল্ডস অব ব্রিটেনেরও (ডব্লিউজিজিবি) কিছু উদ্বেগও রয়েছে এআই নিয়ে।
এআই ডেভেলপাররা লেখকদের অনুমতি ছাড়াই তাদের কাজ ব্যবহার করছে এবং কপিরাইট লঙ্ঘন করছে।
কনটেন্ট তৈরিতে কোথায় কোথায় এআই ব্যবহার করা হল, সেটা স্পষ্ট করা হয় না।
অনেক বেশি এআই’র ব্যবহার লেখকদের চাকরির সুযোগ কমাবে।
লেখকদের মজুরি কমবে।
যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ও জাতিসত্ত্বায় সৃজনশীল শিল্পের অবদানকে কমিয়ে দেবে।
ডব্লিউজিজিবি লেখকদের প্রতি কিছু সুপারিশও করেছে। সংগঠনটি বলছে, এআই ডেভেলপাররা কেবল লেখকদের কাজ ব্যবহার করবে, যদি তারা সেই অনুমতি পায়। কোন ডেটাগুলো এআই টুলের জন্য ব্যবহার হচ্ছে সে ব্যাপারে স্বচ্ছ থাকবেন ডেভেলপাররা।
ডব্লিউজিজিবি ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি লেসলি গ্যাননের মতে, যে কোনো নতুন প্রযুক্তির সুবিধার নেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকিগুলোকেও যাচাই করতে হবে। প্রযুক্তির অগ্রগতি যাতে নিজেদের সুরক্ষাকে দূরে ঠেলে না দেয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বিনোদন শিল্পে লেখক ও সৃজনশীল কর্মশক্তি জীবিকার জন্য তাদের কাজের ওপরই নির্ভর করে।
“কর্মীদের অধিকার রক্ষা এবং দর্শক-শ্রোতাদের ভুলভাল ও অপতথ্য থেকে সুরক্ষায় আইন সুস্পষ্ট প্রয়োজন।”
গত এক বছরে এআই এর দ্রুত বিকাশের ফলে মালিকানার ধারণাটি জটিল হয়ে উঠেছে। ‘ড্র এনিওয়ান’, ‘দাল-ই’ এমনকি ‘স্ন্যাপশট’ এর মত এআই জেনারেটেড পোর্ট্রেট অ্যাপে কারও অবয়ব ইনপুট দেওয়ার পর নতুন প্রস্তুত সেই ছবিগুলো পাবলিক ডোমেইনে রয়েছে এবং যে কেউ সেটি ব্যবহার করতে পারেন। নতুন ছবিগুলো কপিরাইট আইনে সুরক্ষিত নয়।
ডিজিটাল ক্লোনিং প্রযুক্তির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ডা. মাথিণ্ডে প্যাভিস বিবিসিকে বলেন, যুক্তরাজ্যে কপিরাইট আইন পরিবর্তন করা দরকার।
“আমার কাছে আশ্চর্য লাগে যে আপনার গাড়ি, ল্যাপটপ, ফোন, বা বইয়ের চেয়ে আপনার মুখ ও কণ্ঠস্বর কম সুরক্ষিত… আজকের দিনের আইনের এই হল হাল।”
আরও পড়ুন-