ধর্মঘটে আটকে যাচ্ছে 'অ্যাভাটার', 'ডেডপুল', 'গ্ল্যাডিয়েটরে'র সিক্যুয়েলসহ 'স্ট্রেঞ্জার থিংস', 'ফ্যামিলি গাই', 'দ্য সিম্পসনে'র মতো টিভি সিরিজ।
Published : 15 Jul 2023, 02:49 PM
৬৩ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রনাট্যকার এবং অভিনয়শিল্পীদের দ্বৈত ধর্মঘট প্রথমবারের মতো দেখছে হলিউড। এই কর্মবিরতির ফলে মুক্তির মিছিলে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের সিনেমা এবং টেলিভিশন সিরিজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এই কর্মবিরতির জেরে হলিউডের অধিকাংশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রোডাকশন হাউজে ধীরে ধীরে সব কাজ বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে ‘অ্যাভাটার’, ‘ডেডপুল’, ‘গ্ল্যাডিয়েটর’র সিক্যুয়েলসহ বড় বাজেটের সিনেমায় কিংবা ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’, ‘ফ্যামিলি গাই’ এবং ‘দ্য সিম্পসন'র মত টেলিভিশন সিরিজের উপরে। ফলে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি শঙ্কা করা হচ্ছে।
স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড-আমেরিকান ফেডারেশন অব টেলিভিশন অ্যান্ড রেডিও আর্টিস্ট বা ‘এসএজি-এএফটিআরএ’ নামে পরিচিত অভিনয় শিল্পীদের এই ইউনিয়ন শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, বেতন কমানো ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে তাদের কর্মক্ষেত্রে যে হুমকি তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত মীমাংসা হয়নি।
বিবিসি বলছে, ধর্মঘটের প্রভাব কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের যে দেশগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাতারা আছেন, যারা ইংরেজি ভাষায় সিনেমা এবং টেলিভিশন শো করে থাকেন, তারাও বিপাকে পড়বেন।
অর্থাৎ লন্ডন, পুরো যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ডসহ যেখানে যেখানে হলিউডি সিনেমার স্টুডিও আছে, সেখানে এই ধর্মঘটের আঁচ গিয়ে পৌঁছবে।
ধর্মঘটের কারণ
চলমান ধর্মঘটের ডাক প্রথমে দিয়েছিলেন হলিউডের চিত্রনাট্যকাররা। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন লেখকদের সংঘ দ্য রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকার (ডব্লিউজি) অভিযোগ, বেতন কমানো ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের কারণে কর্মক্ষেত্রে তাদের জন্য হুমকি তৈরি হয়েছে।
এর মধ্যে ডব্লিউজি, অভিনয়শিল্পীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও হলিউড স্টুডিওগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসলেও সমাধান আসেনি।
এরপর বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ বন্ধ করে চিত্রনাট্যকারদের সঙ্গে ধর্মঘটে যোগ দেন।
ধর্মঘট শুরুর পরে ‘এসএজি-এএফটিআরএ’ ইউনিয়ন ‘ডব্লিউজি’র দাবিদাওয়ার সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে বলেছে, তারা চাইছে অভিনয় শিল্পীদের বদলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এবং কম্পিউটারের মাধ্যমে তৈরি করা মুখ ও কণ্ঠ ব্যবহার করা হবে না।
এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ও বিদেশে অনেক প্রোডাকশন স্থগিত রাখতে বাধ্য হচ্ছে তারা।
এছাড়া অভিনয় শিল্পীরা তাদের মুক্তি প্রতিক্ষীত সিনেমাগুলোর রেড-কার্পেট প্রিমিয়ার এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সিনেমার প্রচার-প্রচারণও বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে।
হলিউডে প্রভাব
বর্তমানে ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘গোস্টবাস্টারস ফোর’, ‘মুফাসা: দ্য লায়ন কিং’ এবং ‘অ্যাভাটার থ্রি এবং ফোর’, ‘প্যাডিংটন ইন পেরু’ কাজ শুরু পিছিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে ‘প্যাডিংটন ইন পেরু’র কাজ শুরুর কথা ছিল চলতি মাসের শেষ দিকে।
এই ধর্মঘট এসব সিনেমার প্রযোজকদের জন্য ‘অলস সময়’ নিয়ে আসছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
যুক্তরাজ্যের ‘ডেডপুল থ্রি’ সিনেমায় কাজ করছেন হলিউডি অভিনেতা রায়ান রেনল্ডস, হিউ জ্যাকম্যান। বিপুল বাজেটের এই সিনেমাটির মুক্তির তারিখ ঠিক করা হয়েছিল আগামী বছরের মে মাসে। এখন অভিনেতারা ধর্মঘটে যোগ দেওয়ায় মুক্তি পিছিয়ে যেতে পারে।
এই জটিলতায় পড়তে চলেছে ‘বিটলজুস’র সিক্যুয়েল এবং ‘মিউজিক্যাল উইকেড’ সিনেমা দুটিও। অভিনেতা মাইকেল কিটন, উইনোনা রাইডার ও জেনা ওর্তেগার ‘বিটলজুস ২’ সিনেমায় কাজ করার কথা রয়েছে, শুটিংয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে। তবে আদৌ সেই কাজ সময়মত শুরু করা যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান এর প্রযোজনা সংস্থা।
গত কয়েকমাস ধরে যুক্তরাজ্যে ‘মিউজিক্যাল উইকেড’ সিনেমার শুটিং চলছে। আগামী বছরের নভেম্বরে এই সিনেমার প্রথম কিস্তি মুক্তির তারিখ রায়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, সমস্যা হবে হলিউড সিনেমা ‘গ্ল্যাডিয়েটর ২’ ক্ষেত্রেও। মরোক্কো এবং মালটায় এই সিনেমার শুটিংয়ের কাজ চলছিল পুরোদমে। প্রযোজনা সংস্থা প্যারামাউন্ট পিকচার্স জানিয়েছে, শুটিং টিমে প্রচুর বিদেশি কর্মী থাকলেও সিনেমাটি যুক্তরাষ্ট্রের, তাই কর্মবিরতির প্রভাব এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ তাদের নেই।
এই ধর্মঘট প্রচারণামূলক সংস্থাকেও বিপাকে ফেলেছে বলে জেনেছে বিবিসি।
হলিউডের দুই প্রচার সংস্থা ‘প্রেস জাঙ্কেট’ এবং ‘রেড-কার্পেট প্রিমিয়ার’ আগামীতে মুক্তির মিছিলে থাকা তিন সিনেমা ‘হন্টেড ম্যাশনন (২৮ জুলাই),’টিনেজ মিউটেন্ট নিনজা টার্টলস (২ অগাস্ট), ‘আ হন্টিং ইন ভেনিস’র (১৫ সেপ্টেম্বর) প্রচার কাজ চালাচ্ছিল।
বর্তমান স্থবির পরিস্থিতিতে তারাও তাদের কাজ বন্ধ রেখেছে। কারন ধর্মঘটের সুরাহা না হলে নির্ধারিত তারিখে মুক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
‘ফিল্মএলএ’র পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী টেলিভিশনের ‘রিয়েলিটি শো’, ‘ফিচার ফিল্ম’ এবং টেলিভিশনের ‘সিরিজ’র এর চিত্রগ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিচ্ছে না বা পাচ্ছে না।
গত বছরের এই সময়ের তুলানায় এই শো গুলোর শুটিংয়ের তারিখ নেওয়ার তারিখ শতকরা ৬৪ শতাংশ কমে গেছে।
এখন এই ধর্মঘটের দীর্ঘায়িত হলে দর্শকদের জন্য টেলিভিশনের নামমাত্র কিছু অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন ধরনের খেলার ‘লাইভ’ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
এদিকে আগামী তিন সিনেমা ‘বার্বি’, ‘ওপেনহাইমার’ এবং টম ক্রুজের ‘মিশন ইম্পসিবল- ডেড রেকনিং পার্ট ১’ এই বিপত্তির বাইরে আছে। কারণ ‘মিশন ইম্পসিবল- ডেড রেকনিং পার্ট ১’ ইতোমধ্যে মুক্তি পেয়েছে। এছাড়া আগামী ২১ জুলাই মুক্তি পেতে যাওয়া বাকি দুই সিনেমার মুক্তি সংক্রান্ত সব কাজ ইতোমধ্যে সেরে নিয়েছে প্রযোজনা সংস্থা।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে অভিনয়শিল্পীদের ধর্মঘটের খবর প্রকাশ্যে আসার পর লন্ডনে ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমার প্রচার চলাকালীন সভা থেকে বের হয়ে আসেন কিলিয়ান মার্ফি, এমিলি ব্লান্ট, রামি মালিক, ম্যাট ডেমনের মতো তারকারা।
ওই সিনেমার রেড কার্পেটে ব্রিটিশ অভিনেতা ও পরিচালক কেনেথ ব্রানার ভাষ্য, হলিউডে এই সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। এজন্য যা যা করণীয় সেটা করার আহ্বান রেখেছেন তিনি।
টিভি শোগুলোর কী হবে?
‘এসএজি-এএফটিআরএ’র সদস্য অভিনয়শিল্পীদের ধর্মঘটের কারণে টেলিভিশন সিরিজগুলোর পার পেয়ে যাওয়ার কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। বহু চিত্রনাট্য চিত্রায়নের জন্য হাত দেওয়া যাবে না।
এক্ষেত্রে ‘গেম অফ থ্রোনস’ টিভি স্পিন-অফের দুটি সিরিজ প্রচারে দেরি হতে পারে। সেইসঙ্গে টম স্টারিজ অভিনীত ‘দ্য স্যান্ডম্যান’র দ্বিতীয় সিরিজ এবং অস্কারজয়ী গ্যারি ওল্ডম্যানের ‘স্লো হর্সসের সিরিজ’ও পর্দায় আসবে দেরিতে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল যেমন ‘এনবিসি’, ‘এনসিআইএস’, ‘সিবিসি’তে গ্রীষ্মের সিরিজ ও সিরিয়ালগুলোর মধ্যে ‘নাইট কোর্ট রিবুট’, ‘শিকোগো মেড’, ‘ফায়ার এন্ড পিডি’, ‘এনসিআইএস’, ‘ইয়ং শেলডেন’, ‘ফ্যামিলি গাই, এবং ‘দ্য সিম্পসনসের দ্বিতীয় সিরিজ চলছিল’।
এছাড়া ‘দ্য মাস্কড সিঙ্গার’, ‘দ্য অ্যামেজিং রেস’, ‘সারভাইভার’ এবং ‘কিচেন নাইটমেয়ারসের’ মত সিরিয়ালগুলো শিডিউল বিপর্যয়ে পড়বে।
অস্কারজয়ী এডি রেডমেইন অভিনীত স্পাই থ্রিলার ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকল’ এবং স্টিফেন গ্রাহামের বক্সিং ড্রামা ‘আ থাউজেন্ড ব্লোস’সহ আরও কয়েকটি কয়েকটি টিভি সিরিজের কাজ চলছিল যুক্তরাজ্যে। এই সিরিয়ালগুলোর কাজও থেমে গেছে।
এছাড়া এই ধর্মঘটে ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’, ‘দ্য লাস্ট অব আস’ এবং ‘ইয়েলো জ্যাকেট’র মত বড় বাজেটের শোগুলির কাজও শুরু হয়েছিল এই সিজনে, যা পরবর্তীতে পর্দায় আনতে দ্বিগুণ খরচ গুণতে হবে বলে শঙ্কা করছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
সিনেমা এবং টেলিভিশন সিরিজ ছাড়াও ধর্মঘটের অংশ হিসেবে ‘এমি অ্যাওয়ার্ডস’, ‘টরন্টো’, ‘টেলুরাইড’ এবং ‘ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’সহ আসন্ন অনুষ্ঠানগুলোও হয়ত তারকারা বর্জন করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
তবে ধর্মঘট ডাক দেওয়া এসএজি-এফটিআর এর সহযোগী সংস্থা ইউনিয়ন ইক্যুইটি বলছে, যুক্তরাজ্যে অভিনেতাদের জন্য হলিউডের এই ধর্মঘট প্রযোজন্য নয়।
এরপর কী হবে?
ধর্মঘট নিরসনের উপায় খুঁজতে আগামীতে অভিনয় শিল্পীদের সমিতি স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ডের (এসএজি) সঙ্গে অভিনয়শিল্পীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও হলিউড স্টুডিওগুলোর মধ্যে বৈঠক হবে। ওই ধর্মঘট থেকে সংকটের সমাধান খোঁজার চেষ্টা হবে সব পক্ষ থেকে।
লেখক ও অভিনেতারা প্রথম দ্বৈত ধর্মঘটে গিয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। সে সময় লেখকরা কাজ বন্ধ রেখেছিলেন ২১ সপ্তাহ আর অভিনেতারা ৬ সপ্তাহের মত তাদের কাজে বিরতি নিয়েছিলেন।
এরপর কেবল অভিনয়শিল্পীরা ধর্মঘটে গিয়েছিল ১৯৮০ সালে। সেবার ১০ সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় ওই কর্মবিরতি। ওই ধর্মঘটে ৩৭০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল।
এছাড়াও ২০০৭ ও ২০০৮ সালে একশ দিন ধর্মঘট পালন করেছিল ডব্লিউজিএ। সেসময় প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে যায় এবং বেকার লেখক, অভিনেতা ও প্রযোজকরা খরচ কমিয়ে দেয়। তাতে ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতিতে আনুমানিক ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি ক্ষতি হয়।
তবে এবারের সমস্যা দীর্ঘায়িত হতে পারে। কারণ প্রভাবশালী অভিনেতারা ‘এসএজি-এএফটিআরএ’কে দাবি আদায়ে কঠোর হতে চাপে রেখেছেন।
এদিকে প্রযোজকরা বলেছেন, ‘এসএজি-এএফটিআরএ'র ধর্মঘট চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে তারা হতাশ।
ধর্মঘটের প্রতিক্রিয়ায় ‘অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার অ্যান্ড টেলিভিশন প্রোডিউসারস’ বলেছে, "আমরা যে ফলাফল আশা করেছিলাম তা পাওয়া যায়নি। কারণ স্টুডিওগুলি আমাদের টিভি শো এবং চলচ্চিত্রকে প্রাণবন্ত করে তোলে এমন অভিনয়শিল্পীদের ছাড়া কাজ করতে পারে না। কিন্তু ইউনিয়ন দুঃখজনকভাবে এমন একটি পথ বেছে নিয়েছে, যা এই মাধ্যমের উপরে নির্ভরশীল হাজারো মানুষের আর্থিক ক্ষতি ডেকে আনছে।”