লেখক ও অভিনয়শিল্পীরা বলছেন, এটা তাদের জীবিকার ব্যাপার; তবে স্ট্রিমিং কোম্পানিগুলো বলছে, দাবিগুলো অযৌক্তিক।
Published : 15 Jul 2023, 07:39 PM
স্ট্রিমিং স্টুডিও কোম্পানি, স্ক্রিনরাইটার ও অভিনেতাদের মধ্যে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় এখন সিনেমা স্ক্রিপটের বাইরে গোটা হলিউড।
কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো সেখানকার লেখক ও অভিনয় শিল্পীরা স্টুডিওগুলোর সঙ্গে নিজেদের দাবি-দাওয়া সমেত চুক্তির জন্য একযোগে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছেন।
শিল্পীরা বলছেন, নিজেদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্য দাবি-দাওয়া তুলে ধরে তারা এই ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন, যা ‘টিনসেলটাউন’ বা হলিউডে তৈরি করেছে অচলাবস্থা।
যদিও স্ট্রিমিং স্টুডিওগুলোর নির্বাহীরা বলছেন, লেখক ও অভিনয় শিল্পীদের দাবিগুলো অযৌক্তিক।
ছয় দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মত হলিউডে কেমন এমন ধর্মঘট, লেখক ও অভিনয় শিল্পীদের দাবি-দাওয়াই বা কী, সেসবের বিস্তারিত তুলে ধরেছে বিবিসি।
আলোচনায় কারা
হলিউডে যে কারণে ধর্মঘট, সেই আলোচনায় যুক্ত মূলত তিনটি পক্ষ, যার একটি ‘স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড অ্যান্ড দি আমেরিকান ফেডারেশন অব টেলিভিশন অ্যান্ড রেডিও আর্টিস্টস’ (এসএজি-এএফটিআরএ)।
এই সংগঠনটি ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি সদস্যের কথা তুল ধরছে। অভিনেতা, স্টান্ট কো-অর্ডিনেটর, ভয়েসওভার শিল্পী এবং পর্দার বাইরের কলাকুশলীরা রয়েছেন এতে।
আরেকটি সংঘ হল ‘রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা’ (ডব্লিউজিএ), যেটি চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইন লেখকদের প্রতিনিধিত্ব করে।
তৃতীয় পক্ষ হল ‘দ্য অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার অ্যান্ড টেলিভিশন প্রডিউসারস’ (এএমপিটিপি)। প্রধান স্ট্রিমিং স্টুডিও কোম্পানি যেমন- ওয়াল্ট ডিজনি, প্যারামাউন্ট এবং আমেরিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ফক্স, এনবিসি, নেটফ্লিক্স ও অ্যামাজনের মতো স্ট্রিমিং জায়ান্টগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে এটি।
এই তিন পক্ষের মধ্যে দাবি-দাওয়া পূরণের আলোচনা বিভিন্ন কারণে ভেস্তে যায়। এর কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
লাভের হিসাব
স্ট্রিমিং প্লাটফর্মগুলোর রমরমায় বিনোদন জগতে নাটকীয় পরিবর্তনে হলিউড যখন হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক সেসময়ই ধর্মঘটে গেছেন ফিল্ম ও টেলিভিশন লেখক এবং অভিনয় শিল্পীরা।
এই স্ট্রিমিং প্লাটফর্মের আবির্ভাব টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রকে গ্রহণে বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিয়েছে। যদিও কাজের বিনিময়ে অভিনেতারা কীভাবে পারিশ্রমিক পাবেন, তারও নিয়ম বদলেছে।
সাধারণত অভিনেতা ও লেখকদের কাজের জন্য তাদের অগ্রিম অর্থ প্রদান করা হয়। তবে অনেকেই তাদের আয় ধরে রাখেন টিভি শো ও চলচ্চিত্রগুলোর বিবিধ আয় থেকে। ফলে যখন কোনো বিজ্ঞাপনী নেটওয়ার্কে শো পরিচালিত হয়, সেখানকার বিবিধ আয়ের একটি অংশের চেক পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে পান প্রবীণ অভিনেতারা। যেমন- এসএজির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁ ড্রেসচার এই অর্থ পান।
কিন্তু স্ট্রিমিং কোম্পানি এই রীতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে। লেখক ও অভিনেতাদের উভয়ই বলছেন, তাদের বিবিধ আয় এখন কমে গেছে, যা তাদের জীবিকা ধ্বংস করছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে হলিউডে অভিনয় করছেন মাইকেল প্যাট্রিক। বিবিসিকে তিনি বলেন, টেলিভিশনের পাঁচটি পর্বের বিবিধ আয় থেকে তিনি ৩০০ ডলারের মতো উপার্জন করেছেন।
হলিউডে ধর্মঘটে আটকে যাচ্ছে অনেক সিনেমা
এজেন্ট ও ম্যানেজার লেন বলেন, অভিনয়ের ক্লাসে অর্থ পরিশোধের পর তিনি বছরে মাত্র ২০ হাজার ডলার ঘরে নিয়ে যেতে পারেন।
গত কয়েক বছরে নিজের সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এতে সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনাও তাকে বিলম্বিত করতে হয়েছে।
এসএজি-এএফটিআরএ বলছে, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন থেকে লাভের আরও ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের জন্য ধর্মঘট করছেন এর সদস্যরা। কিন্তু এএমপিটিপি বলছে, এসএজির সমঝোতাকারীরা অন্তত ৩৫ বছর পর্যন্ত সর্বোচ্চ শতাংশ লাভের অংশ দাবি করছেন।
স্টুডিওগুলোর প্রধানরা বলছেন, এএমপিটিপি একটি চুক্তির কথা বলছে, যেখানে লেখক ও অভিনয় শিল্পীদের ঐতিহাসিক পারিশ্রমিক ও বিবিধ সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এসএজি-এএফটিআরএ দুঃখজনকভাবে এমন একটি পথ বেছে নিয়েছে, যাতে এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল অগণিত লোকের আর্থিক দুরাবস্থা তৈরি হবে।
স্বাস্থ্যসেবার জন্য ধর্মঘট
অভিনয় শিল্পী ও লেখক সংঘের দ্বৈত সদস্য মায়া গিলবার্ট-ডানবার এখন এসএজি-এএফটিআরএ’র সভাপতি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
তিনি বলেন, এসএজি ইউনিয়নের অধিকাংশ সদস্যই ন্যূনতম মজুরির বেশি পান না। আমাদের অধিকাংশ সদস্যই পর্দার পেছনের শিল্পী। এসব লোকজন খুব কমই প্রতিদিন দেড়শ ডলার আয় করতে পারেন।
অনেক অভিনেতার জন্য স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা পাওয়ার একমাত্র উপায় এসএজি-এএফটিআরএ’র সদস্য হওয়া।
কিন্তু ডানবারের অনুমান, এই স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা পাওয়ার জন্য ১ লাখ ৬০ হাজার সদস্যের মাত্র ১৫ শতাংশ শর্তানুযায়ী বছরে ২৬ হাজার ডলার উপার্জন করতে পারেন। এছাড়া বয়স ৬৫ বছরের পরে বয়স্ক অভিনেতাদের বীমা পরিকল্পনাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এএমপিটিপি বলছে, তারা পেনশন ও স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য আার্থিক সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে।
এআই’র ভবিষ্যৎ
উভয় পক্ষের দর কষাকষির টেবিলে আলোচনার আরেকটি বিষয় হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার। লেখকদের আগের কাজগুলো থেকে ধারণা নিয়ে নতুন স্ক্রিপ্ট তৈরি করছে এআই। ফলে এটি প্রতিরোধ করতে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা চান রাইটার্স গিল্ডের লেখকরা।
সেইসঙ্গে এআই এর খসড়া স্ক্রিপট লেখকদের পুনর্লিখন করতে বলা হবে না, সেই নিশ্চয়তাও চাইছেন তারা।
কারও কারও ধারণা, এই এআই কয়েক দশকের মধ্যে হলিউডকে প্রথম বড় ধর্মঘটের দিকে নিয়ে যাবে।
এমপিটিপি বলেছে, তারা এআই ব্যবহারের প্রস্তাব করেছে এসএজিকে। তবে এআই’র ব্যবহার, ডিজিটাল প্রতিলিপি তৈরি ও পারফর্মেন্সের ক্ষেত্রে ব্যক্তি পারর্মারদের সম্মতির শর্ত রয়েছে।
কিন্তু ধর্মঘট ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে এসএজির প্রধান সমন্বয়ক ডানকান ক্র্যাবট্রি-আয়ারল্যান্ড ব্যাখ্যা করেছেন, কেন তাদের ইউনিয়ন এই ধারণাকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
“তাদের প্রস্তাব, আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড পারফর্মারদের স্ক্যান বা প্রতিলিপি তৈরি করবে এআই। পারফর্মাররা একদিনের বেতন পাবেন। কোম্পানিগুলো সেই স্ক্যানিংয়ের মালিক হবে এবং চিরকাল সেটি ব্যবহার করতে পারবে। যে কোনো প্রকল্পে তারা সেটি পারফর্মারদের সম্মতি ও ক্ষতিপূরণ ছাড়াই ওই স্ক্যান কপি ব্যবহার করতে পারবে।
“তাই আপনি যদি মনে করেন এআই’র ব্যবহার একটি উদ্ভাবনী যুগান্তকারী প্রস্তাব, আমি বলব- আপনি আবার ভাবুন।”
শেষ কোথায়
হলিউডে লেখক-অভিনয় শিল্পী ধর্মঘটের চিত্রে দেখা যাচ্ছে, উভয় পক্ষই নিজেদের দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।
কোনো পক্ষই সমঝোতায় আসতে চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে আলোচনার টেবিলে আসতে উভয়পক্ষের আরও সময় লাগতে পারে।
সবশেষ ১৯৬০ সালে লেখক ও অভিনয় শিল্পীদের উভয়েই বিক্ষোভের সারিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেসময় ১০ সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ চলেছিল তৎকালীন অভিনেতা রোনাল্ড রিগ্যানের (পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট) নেতৃত্বে।
যৌথ ধর্মঘট শুরুর আগে গত মে মাস থেকেই ধর্মঘটে রয়েছে রাইটার্স গিল্ড। ফলে তাদের আন্দোলন গড়িয়েছে তৃতীয় মাসে।
ধর্মঘট চলাকালীন ফিল্ম প্রিমিয়ার, উত্সব, সম্মেলন বা রেড কার্পেটে হলিউড তারকাদের দেখার আশা করা যাচ্ছে না। সংগঠনের নিয়মনীতি অনুযায়ী লেখক ও অভিনয় শিল্পীরা ধর্মঘট চলাকালীন এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
ডানবার বলেন, ‘ধর্মঘট শেষ নয়, দুর্ভাগ্যবশত, এটি কেবল শুরু’। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই একটি যথোপযুক্ত চুক্তিতে পৌঁছাবে এমনটাই প্রত্যাশা।
“আমরা ধর্মঘটে যাচ্ছি, শিল্পীরা কাজ করতে পারবে না। কিন্তু এই কাজ চালু রাখতে আপনাকে একটি চুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর আমি আশা করি সেটিই ঘটবে।”