দেশভাগের বছরে জন্ম নেওয়া রাখী নিয়মিত বাংলা সিনেমা দেখেন, তাঁতের শাড়ি পরতে পছন্দ করেন, খাদ্যচর্চাতেও ধরে রেখেছেন বাঙালিয়ানা।
Published : 16 Apr 2025, 04:38 PM
সিনেমায় অভিনয়ে হাতিখড়ি নিয়ে, বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার জন্য এক সময়ে পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে, থিতু হন সেখানেই। কিন্তু সাহিত্য চর্চা, খাওয়া দাওয়া, পোশাকে পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানা ধরে রেখেছেন। তিনি অভিনেত্রী রাখী।
দেশভাগের বছরে জন্ম নেওয়া রাখী ১৯৬৭ সালে ২০ বছর বয়সে অভিনয় শুরু করেছিলেন। কিন্তু সিনেমার জগত থেকে অনেকটাই সরে যান আশির দশকের মাঝামাঝিতে। মাঝে ফিরেছিলেন প্রয়াত নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা ‘শুভ মহরৎ’ এবং গৌতম হালদারের ‘নির্বাণ’ দিয়ে।
সিনেমায় অভিনয় শুরুর পর বাঙালি পরিবারের মেয়ে রাখী মজুমদার কোনো পদবি ব্যবহার করতেন না। কিন্তু ১৯৭৩ সালে সাহিত্যিক, গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা গুলজারকে বিয়ের পর নামের সঙ্গে রাখী ‘গুলজার’ পদবী জুড়ে দেন।
বিয়ের এক বছর পর এই দম্পতির একমাত্র সন্তান মেঘনা গুলজার পৃথিবীতে আসতে না আসতেই আলাদা হয়ে যান তারা। ঝেড়ে ফেলেন গুলজার পদবিও।
মাঝে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিলেন এই অভিনেত্রী। মুম্বাই বা কলকাতার সিনেমা সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানগুলোয় তার দেখা পাওয়া যায় না। মুম্বাইয়ে নিজের গড়া ফার্ম হাউসে একাই থাকেন তিনি।
২২ বছর পর এবার রাখীকে পাওয়া যাচ্ছে একটি বাংলা সিনেমায়। কলকাতার পরিচালক জুটি নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখার্জি তাদের ‘আমার বস’ সিনেমায় রাখীকে ফিরিয়ে আনছেন। সিনেমাটি মুক্তি পাবে মে মাসে ৯ তারিখে।
শিবপ্রসাদ কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন রাখীর বাঙালিয়ানার কথা।
রাখীর পছন্দের সিনেমা নন্দিতা-শিবপ্রসাদ পরিচালিত ‘হামি’; এ খবর জানার পর ‘আমার বসের’ চিত্রনাট্য শোনাতে ‘সাহস’ করে তার দ্বারস্থ হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন শিবপ্রসাদ।
প্রথম অভিজ্ঞতা কেমন ছিল সেটি বোঝাতে শিবপ্রসাদ বলেন, “ফোন করে বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইতেই তিনি (রাখী) চমকে দিলেন! ‘ঠিকানা চাও? বলছি শোনো, আমড়াতলার মোড়ে/তিনমুখো তিন রাস্তা গেছে, তারই একটি ধরে’ গড়গড় করে সুকুমার রায়ের ‘ঠিকানা’ কবিতা আউড়ে গেলেন!”
শিবপ্রসাদের কথায়, “বলিউডে বসে রাখিদি আমাদের সবার থেকে বেশি বাঙালি। তার পোশাকে, কথা বলার ভঙ্গিতে, খাওয়া দাওয়ায়, ভাবনায়, পুজো-অর্চনায়, শুধুই বাঙালিয়ানা।“
রাখী শিবপ্রসাদদের কি খেতে দিয়েছিলেন জানতে চাইলে বলেন, “প্রথম যে দিন দেখা করলাম, সে দিন আমাদের থালায় ফিশফ্রাই সাজিয়ে দিয়েছিলেন। উনি জানেন, আমরা মাছেভাতে বাঙালি। যতই অভিনয় পেশা হোক, শরীর সচেতন হই, ফিশফ্রাই এড়াতে পারব না! এই যে বাঙালির ‘পাল্স’ বুঝতে পারা, এটাই তো আজকের দিনে দুর্লভ। তিনি নিজেও মাছ ভাত ছাড়া খান না।“
‘আমার বস’ সিনেমার শুটিংয়ে রাখীর কড়া নির্দেশ ছিল তার খাবারের তালিকায় কেবল বাঙালি খাবারই রাখতে হবে।
শিবপ্রসাদ বলেন, “সেই মত রান্না হত। নন্দিতাদি তাকে নিজের হাতে পরিবেশন করেছেন। খেতে খেতে মুখেচোখে তৃপ্তির এক অদ্ভুত আলো খেলা করেছে তার। রাখীদির খুশিমুখ দেখে আমরা স্বস্তিতে।“
এছাড়া শুটিংয়ের সময় সহশিল্পীদের সবাইকে নিয়ে ফুচকা খেতেনও বলে জানিয়েছেন শিবপ্রসাদ।
“একদিন তিনি একের পর এক ফুচকা খেয়েই যাচ্ছেন। শেষে ফুচকাওয়ালাকে ইশারা করে তাকে থামাতে হয়েছিল।“
৭৮ বছর বয়সে এসেও রাখী বাঙালি মেয়েদের মত শাড়ি নিয়ে প্রচণ্ড ‘খুঁতখুঁতে’ স্বভাবের সেটি জানা গেল শিবপ্রসাদের কথায়।
তিনি আগে থেকেই বলে দিয়েছিলেন, সিনেমায় নিজের শাড়ি ছাড়া তিনি পরবেন না।
“‘আমার বসের’ জন্য পোশাক পরিকল্পক অভিষেক রায়কে মুম্বাইয়ে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার আগে নিজেই একপ্রস্ত শাড়ি বেছে রেখেছেন। অভিষেককে নিজের আলমারি খুলে দিয়ে বলেছিলেন, “দ্যাখো, এর থেকে কোনগুলো তোমাদের পছন্দ হয়।” অভিষেকের পছন্দের পর সেই শাড়ি আমাদেরও দেখতে হয়েছে। তবে দিদি খুশি।
“এই খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণেই, হিন্দি সিনেমায় অভিনয়ের সময়ও নিজের পোশাক নিজেই বাছতেন। অন্যের পোশাক বা শাড়ি ভুলেও কোনও দিন পরেননি।“
এছাড়া শুটিংয়ের সময় সরস্বতী পুজা হয়েছিল, সে সময় রাখী সবাইকে নিজের হাতে পূজার ভোগের খিচুড়ি, লাবড়া, ভাজা, চাটনি খাইয়েছেন বলেও জানিয়েছেন শিবপ্রসাদ।
এই পরিচালকের কথায়, “বাংলায় থেকেও আমরা তার মত করে বাঙালিয়ানাকে নিজেদের রক্তে মিশিয়ে নিতে পারিনি।“
দীর্ঘ বিরতির পর কলকাতার পরিচালক জুটি নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখার্জির নতুন সিনেমার মাধ্যমে বাংলার পর্দায় ফিরছেন রাখী।
শেষবেলায় তাদের ‘বাংলায় ফেরা’, ভাষার স্বাচ্ছন্দ্য নাকি দর্শকের চাওয়া?