এ বছর দুটি সিনেমা হারিয়ে যাওয়া ‘হাউজফুল’ শব্দটি ফিরিয়ে আনলেও বাকিগুলো কেবল ব্যবসার পথ হাতড়েছে।
Published : 31 Dec 2022, 08:12 AM
আগে থেকেই ধুঁকছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, মহামারী তা করে তুলেছিল নাজুক; বছরের শুরুতে মহামারীর খাঁড়া কাটিয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গন সচল হলেও চলছিল ঢিমেতালে। মাঝামাঝিতে এসে পরাণ নাড়া দেয় চলচ্চিত্র অঙ্গনকে, তারপর হাওয়া বইয়ে দেয় দর্শকের জোয়ার; তবে এরপর আবার ফিরে এসেছে ভাটা।
মহামারীর কারণে দীর্ঘ সময় সিনেমা হল বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে প্রেক্ষাগৃহের দুয়ার খুলেছিল ‘ছিটমহল’ দিয়ে। হাবিবুর রহমান হাবিব পরিচালিত, প্রিয়া জান্নাতুল ও মৌসুমী হামিদ অভিনীত সিনেমাটি আলোচনায় আসতে পারেনি, দর্শকও টানতে পারেনি।
১৩টি হিট সিনেমা উপহার দেওয়া বাপ্পি চৌধুরী ও দর্শকপ্রিয় অপু বিশ্বাস নিয়ে আসেন বছরের দ্বিতীয় সিনেমা। পহেলা বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে মুক্তি পাওয়া দেবাশীষ বিশ্বাস পরিচালিত ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’ সিনেমাটি নিয়ে দর্শকের আগ্রহ দেখা যায়। টানা হলে চলার সেঞ্চুরি করা ছাড়াও এই সিনেমা দিয়ে কয়েকটি বন্ধ হল খোলার খবর পাওয়া যায়; যা প্রযোজক-পরিচালকদের আশা দেখায়।
ঝিমিয়ে পড়া শীতকে বিদায় দিয়ে বসন্তের আভাস নিয়ে আসে মার্চ মাস। মুক্তি পায় মুখোশ, গুণীন ও শিমু নামে তিনটি সিনেমা। জনপ্রিয় দুই অভিনেতা-অভিনেত্রী মোশাররফ করিম ও পরীমনি সিনেমা হলে দর্শক ফেরালেও নির্মাণে দুর্বলতার কারণে খুব বেশি আশার আলো জ্বালাতে পারেনি মুখোশ। পরীমনি-শরিফুল রাজের প্রথম সিনেমা গুণিন নিয়ে আলোচনা হলেও মহামারীতে ঘরে বসে যাওয়া দর্শককে হলে টানতে পারেনি খুব একটা।
এপ্রিল ছিল ঈদের মাস। মহামারীর ধাক্কায় পেছাতে পেছাতে ১০টা ছবি জমে যায় প্রযোজকদের হাতে। সবগুলোই ঈদে মুক্তির প্রত্যাশা নিয়ে জমিয়ে রাখা হয়। শেষে রোজার ঈদে মুক্তি পায় ব্যবসা সফল নায়ক শাকিব খানের দুটিসহ মোট চারটি সিনেমা।
গলুই ও বিদ্রোহী সিনেমা দিয়ে দীর্ঘদিন পর শাকিব খানের হাত ধরে হল মালিকদের ঠোঁটে হাসির প্রত্যাশা ছিল সবাই। তবে কোনোটিই আশানুরূপ দর্শক টানতে পারেনি। বরং ধার দেখায় সিয়াম আহমেদ ও পূজা চেরির ‘শান’।
দুই ঈদের মাঝে মে মাসে মুক্তি পায় তারকাবহুল চলচ্চিত্র পাপ-পুণ্য। এক সিনেমায় চঞ্চল চৌধুরী, সিয়াম আহমেদ, আফসানা মিমি, মামুনুর রশীদের মতো তাকাদের উপস্থিতিও হলে দর্শক টানতে পারেনি। তবে দেশের বাইরে ১১২ হলে মুক্তি পেলেও ব্যবসার খবর খুব বেশি পাওয়া যায়নি।
জুন মাসে অমানুষ, তালাশ, বিক্ষোভসহ কয়েকটি সিনেমা মুক্তি পেলেও প্রাদ-প্রদীপের আলোয় আসতে পারেনি একটিও। আনুষ্ঠানিকতা আর তারকাদের হলে হলে দৌড়াদৌড়ির মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে সিনেমাগুলো।
কোরবানির ঈদে মুক্তি পায় তিন সিনেমা। অনন্ত জলিল-বর্ষার দিন: দ্য ডে, শরীফুল রাজ-বিদ্যা সিনহা মিমের পরাণ আর জিয়াউল রোশান ও পূজা চেরির সাইকো। সাইকোকে পাশে রেখে হল দখলের খেলায় মেতে ওঠে দিন: দ্য ডে ও পরাণ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয় রায়হান রাফি পরিচালিত সিনেমা পরাণের জয়জয়কার।
দীর্ঘদিন পর দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ে। টিকেট নিয়ে কাড়াকাড়ির হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য ফিরে আসে। দেশ ও দেশের বাইরেও সবার প্রাণ জুড়ায় পরাণ। হল মালিকদের কপালের ভাঁজ মসৃণ হয়ে ঠোঁটের কোণে দেখা দেয় হাসির রেখা। টানা পাঁচ মাস সিনেপ্লেক্সে দাপট দেখিয়ে দেশীয় সিনেমায় রেকর্ড গড়ে পরাণ। এর আগে কোনো সিনেমা সিনেপ্লেক্সে টানা পাঁচ মাস চলেনি।
শরীফুল রাজের রাজত্বের ভিত গড়ে দেয় পরাণ। তার এক মাস পরই মুক্তি পায় হাওয়া। মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত হাওয়া বাংলা সিনেমার সুদিন ফেরার স্বপ্ন দেখায়। চঞ্চল চৌধুরী-শরীফুল রাজদের দেখতে হলে দর্শকদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায় অনেক দিন পর। পরাণ আর হাওয়া সমানতালে চলতে থাকে দেশের সিনেমা হলে। নতুন সিনেমা মুক্তি পেয়েও টিকতে পারে না এই দুই সিনেমার দাপটের কাছে।
দেশের বাইরে থেকেও আসতে থাকে ভালো খবর। আমেরিকার বক্স অফিস টপচার্টে ৩০ এর মধ্যে উঠে আসে হাওয়া। আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ভালো ব্যবসা করে পরাণ-হাওয়া। কলকাতায় মুক্তি পাওয়া হাওয়া নিয়ে চলছে রীতিমতো উন্মাদনা। ইংগিত দিচ্ছে বাংলাদেশের সিনেমার নতুন বাজারের।
পরাণ-হাওয়ার সাফল্য দেখে একের পর এক সিনেমা মুক্তির ঘোষণা আসতে থাকে। আশীর্বাদ, লাইভ, বীরত্ব, অপারেশন সুন্দরবন, বিউটি সার্কাস, হৃদিতা, যাও পাখি বলো তারে, বসন্ত বিকেল, দেশান্তর, কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া, হডসনের বন্দুক, পায়ের ছাপ, কাগজসহ বেশ কিছু সিনেমা মুক্তি পায়।
সিয়াম-নুসরাত ফারিয়ার অপারেশন সুন্দরবন আর জয়া আহসানের বিউটি সার্কাস ছাড়া বাকি কোনো সিনেমায় আসতে পারেনি আলোচনায়। এই দুটি সিনেমা নিয়ে আলোচনা হলেও তা দর্শকের মন ভরাতে পারেনি। ফলে পরাণ-হাওয়ার উপচে পড়া দর্শক দেখা যায়নি অপারেশন সুন্দবন আর বিউটি সার্কাসের বেলায়।
পরাণের সফলতার পর অক্টোবরে মুক্তি পাওয়া রায়হান রাফি-শরিফুল রাজ জুটির দামাল সিনেমাটিও যতটা আলোচনায় ছিল, ততটা দর্শক টানতে পারেনি।
১২ মাসে মুক্তি পেয়েছে ৫০ সিনেমা- ছিটমহল, তোর মাঝেই আমার প্রেম, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২, মাফিয়া- ১, মুখোশ, শিমু (মেইড ইন বাংলাদেশ), গুণিন, লকডাউন লাভ স্টোরি, জাল ছেঁড়ার সময়, গলুই, শান, বিদ্রোহী, বড্ড ভালোবাসি, পাপ পুণ্য, আগামীকাল, বিক্ষোভ, তালাশ, অমানুষ, পরাণ, দিন- দ্য ডে, সাইকো, কার্নিশ, যা হারিয়ে যায়, হাওয়া, আশীর্বাদ, ভাইয়ারে, লাইভ, বীরত্ব, অপারেশন সুন্দরবন, বিউটি সার্কাস, ঈশা খাঁ, হৃদিতা, যাও পাখি বলো তারে, রাগী, জীবন পাখি, বসন্ত বিকেল, রোহিঙ্গা, দামাল, কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া, দেশান্তর, ভাঙন, মেইড ইন চিটাগং, ও মাই লাভ, হডসনের বন্দুক, জয় বাংলা, ৭১ এর একখণ্ড ইতিহাস, পায়ের ছাপ, কাগজ, মেঘ রোদ্দুর খেলা ও বীরাঙ্গনা ৭১।
এরমধ্যে পায়ের ছাপ ও কাগজ মুক্তি পেয়েছে গত শুক্রবার। হল সংখ্যা আর প্রথম কয়েক দিনের ফলাফল হতাশারই। বলা যায়, ৫০টি সিনেমার মধ্যে ব্যবসা করেছে মাত্র দুটি সিনেমা। আলোচনায় আসতে পেরেছে আরও তিন-চারটি। বাকিগুলো চলচ্চিত্রের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
চলচ্চিত্রের হতাশার গল্পের বিপরীতে আশার গল্প বলেছে ওয়েব সিরিজ। মহামারী দর্শককে ঘরমুখো করার পাশাপাশি পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে। তাকদীর ও মহানগর দিয়ে দেশীয় ওয়েব সিরিজের সঙ্গে দর্শকের সখ্য বাড়লেও তা অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে এ বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত কাইজার, সিন্ডিকেট, বোধ ও কারাগার।
তাকদীর, মহানগর দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজের দর্শক তৈরি হয়েছিল। ২০২২ সালে ওপার বাংলায় দর্শক বাড়িয়েছে কাইজার, সিন্ডিকেট ও কারাগার। সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পীদের প্রশংসা করতে দেখা গেছে। চঞ্চল চৌধুরী হয়ে উঠেছে আস্থার আরেক নাম।
তবে চলচ্চিত্রের জন্য ২০২২ সাল ছিল যতটা আশার, ততটাই হতাশার। দুটি সিনেমা হারিয়ে যাওয়া ‘হাউজফুল’ শব্দটি ফিরিয়ে আনলেও বাকিগুলো পথ খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে গেছে।