হাওয়া: ‘মিথে’র মোড়কে খুনোখুনি আর ঘোর লাগা এক সিনেমা

আসলে সমুদ্র কেমন যেন, এই ‘কেমন যেন’ একটা ভাব আছে সিনেমাটিতে।

আহসান কবিরআহসান কবিরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2022, 03:48 PM
Updated : 2 August 2022, 03:48 PM

বহুদিন সমালোচনার আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া বাংলা সিনেমার বাঁকবদল কিংবা একালের হাওয়া হতে পারে ‘হাওয়া’।

মূলত ‘পরাণ’র সফলতার সময়ে একটি গান (‘তুমি বন্ধু কালা পাখি আমি যেন কী?’,সুরকার ও গীতিকার হাশিম মাহমুদ) নির্ভর ট্রেলার সারাদেশে যে আলোচনার জন্ম দেয়, সেই আলোচনার ডানায় ভর করে মানুষের মনে যে আগ্রহের জন্ম হয়, সেই আগ্রহের রঙ মাখানো সিনেমা ‘হাওয়া’।

বাঙালির খুব ভালো করে জানা চাঁদ সওদাগর কিংবা মনসা’র ঘটনা প্রভাবিত সাধারণ চোখে খুনোখুনির এক সিনেমার নাম হাওয়া! শেষদিকে পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে আটটা খুন আর গালি বর্ষণের এক সিনেমার নাম ‘হাওয়া’। প্রতীকী ‘নারীর ক্ষমতায়ন’, নারীকে দাবিয়ে রাখার পুরুষ প্রবৃত্তি আবার একই সাথে প্রতিশোধপরায়ণ এক নারীর হিংস্রতার গল্প হাওয়া!বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে নির্মিত এক সিনেমার নামও হাওয়া! চোখ ধাঁধানো ফটোগ্রাফি আর ভিন্নমাত্রার অভিনয় সমৃদ্ধ একালের এক সিনেমার নাম হাওয়া।

সমুদ্রযাত্রা বা সমুদ্রকেন্দ্রিক সারা পৃথিবীতে অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জগতবিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্রের বহুল পঠিত উপন্যাস শ্রীকান্ত, বাংলা সিনেমা ‘গাঙচিল’ (পরিচালনা রুহুল আমীন, অভিনয়ে বুলবুল আহমেদ, অঞ্জনা ও আহমদ শরীফ), ইংরেজি সিনেমা ‘লাইফ অফ পাই’ কিংবা কোরিয়ান ছবি ‘সি ফগ’র মতো বাংলাদেশে ২০২২ এর সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসা সিনেমার নাম হাওয়া। তবে এই সিনেমা তার নিজের মতো, সেলুলয়েডের কবি মেজবাউর রহমান সুমনের দুর্দান্ত নির্মাণ!

সিনেমায় দেখানো হয়েছে মাঝ সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া আটজন জেলের গল্প। প্রথম ভাগ হচ্ছে ধীর গতির, ডায়ালগে কিছু গালি আর হাস্যরস ছাড়া কোনো টানটান উত্তেজনা নেই। ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’র নায়ক সান্তিয়াগোর জালে যেমন ধরা পড়েছিল এক বিশাল মাছ, তেমনি ধীর গতির গল্প যাত্রায় হঠাৎ করে ‘নয়নতারা’ বোটের চান মাঝির জালে ধরা পড়ে এক মেয়ে। সিনেমার ইব্রাহিম (ইবা) প্রথমে দেখে এটি বড় এক মাছ, পরে বোঝা যায় এটা সুন্দর এক মেয়ে। বোটের সবার মাঝে এক চাঞ্চল্য ভর করে। এই চাঞ্চল্য আর আর প্রচুর মাছ পাওয়ার আশায় মাঝ দরিয়ায় দুই নৌকার জেলেদের মদ কিংবা গাজা সহযোগে ‘পিনিক’ ফোটা গান-‘তুমি বন্ধু কালা পাখি’ দর্শকদের নিয়ে যায় ভিন্ন উত্তেজনায়!

সিনেমার মাঝ বিরতির পর দর্শক বুঝতে পারে মেয়েটার আগমনের হেতু। সে মৎস্য কন্যা, নাকি মনসার কোনো রূপ, সেটা স্পষ্ট না। মেয়ের (গুলতি) সংলাপে জানা যায়, মাছ থেকে মানুষ হয়ে আসার কেচ্ছা অনেক! এই মেয়ের জবানিতে আরও জানা যায়, সে মাছ থেকে মানুষ হয়ে এসে অনেক মানুষ দেখে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল! সবাই ধরে নিয়েছিল সে বোবা। চান মাঝি তাকে নিরালায় ডেকে নিতে চাইলে সে বাধা দেয়। চান মাঝি গুলতি নামের অসহায় এই মেয়েটার প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারে না। অন্যদিকে ইঞ্জিন রুমের মিস্ত্রি যে আলাদাভাবে মাছ বিক্রির প্রতিবাদ করে, চান মাঝি যাকে দেখতে পারে না, মেরে ফেলতে চায়, তাকে ভালো লেগে যায় মেয়েটার অর্থাৎ গুলতির। মাঝ সমুদ্রে ভাসতে থাকা, ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়া আর তেল ফুরিয়ে যাওয়ার দুঃসময়ে গুলতির প্রতি নজর থাকে সবার। তবু চিরাচরিতভাবে দোষ দেওয়া হয় নারীকে, নয়নতারা বোটের সব অমঙ্গল নাকি ওই নারীর কারণেই। যে গালি তাকে বারবার দেওয়া হয়, সেটা উল্লেখ না করাই ভালো।

গুলতির চরিত্রটা হয়ত পরাবাস্তব, হয়ত রূপক কিংবা সেই আদিম বিশ্বাসের অথবা প্রচলিত বাংলা লোক সিনেমায় বহুবার দেখানো ধারণা- সাপ থেকে বা মাছ থেকে মানুষ হওয়া যায়! এই সিনমার গুলতি তেমনই। কিন্তু সে আসে চান মাঝিকে খুন করতে। গুলতির ভাষ্যমতে, চান মাঝি আগে ডাকাত ছিল, সে গুলতির বাবাকে হত্যা করেছে। নয়নতারা বোটের সবাই কি ডাকাত বা চানমাঝির সহযোগী ছিল? তাহলে একের পর এক আটজনকেই নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হল কেন? চান মাঝি যে দুজনকে খুন করে (ইবা ও নাগু) তার বাইরে তিনজনের খুনও অতিপ্রাকৃতিকভাবে দেখানো হয়েছে, যা স্পষ্ট না। চান মাঝিসহ আরও দুজনের খুন সাপের কামড়ে! গুলতি এখানে মনসার রূপক? নাকি প্রতিশোধ স্পৃহাটাই আসল?

মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত হাওয়া মুক্তি পেয়েছে ২৯ জুলাই ২০২২ এ। এই সিনেমার অসাধারণ দিক হচ্ছে এর চিত্রায়ন ও অভিনয়। মেজবাউর রহমান সুমন ও ক্যামেরার কবি কামরুল হাসান খসরুকে অভিবাদন। নোঙর ফেলার দৃশ্য, যা জল ভেদ করে তলে গিয়ে ঠেকে, বিদ্যুৎ চমকানো বা বাজ পড়ার দৃশ্য, সমুদ্রের বৃষ্টি কিংবা জলের মাতম, সকাল বা রাতের সমুদ্রের রূপ অদ্ভুত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ক্যামেরায়। এই সিনেমা দেখে বের হওয়ার পরে চিত্রায়নের এই মূর্চ্ছনা লেগে থাকবে চোখে।

সিনেমাটির আরেক সুন্দর দিক হচ্ছে অভিনয়। চান মাঝির চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয়। পান খাওয়া, গুলতি চরিত্রের রূপদানকারী নাজিফা তুশির হাতধরা, সবাইকে সাহস দিতে গিয়ে জানতে চাওয়া ‘ভয় পাচ্ছিস’- এমন অনেক কিছুতে চঞ্চল ছিলেন দারুণ সপ্রতিভ। ইবা বা ইব্রাহিম চরিত্রেও দারুণ অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ। পরাণ সিনেমা দেখে অনেকেই রাজের অভিনয়ের ভক্ত হয়েছেন, যা এই সিনেমাতেও বজায় রেখেছেন তিনি। আরেক দুর্দান্ত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন খান। তার অভিনয়ও মনে রাখবে মানুষ। মনে রাখবে সুমন আনোয়ারকেও। দারুণ অভিনয় করেছেন তিনি। এছাড়া সোহেল মণ্ডল, রিজভী রিজু, মাহমুদ হামান এবং বাবলু বোসও নিজ নিজ চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। নাজিবা তুশিকেও সাধুবাদ জানাই। ইজা,ই রকাস, পারকাস চরিত্রগুলোও দুর্দান্ত।

‘হাওয়া’ সিনেমার আবহ সংগীত করেছেন রাশিদ শরীফ সোয়েব এবং গানের সঙ্গীতায়োজন করেছেন ইমন চৌধুরী। আবহ সংগীত কিংবা সাউন্ড এর ব্যবহারও ভালো লেগেছে। তুমি বন্ধু কালা পাখি গানের জন্য ইমন চৌধুরী ও গায়ক এরফান মৃধা শিবলুকে হ্যাটস অফ স্যালুট। ভালোবাসা এই সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ব্যান্ড ‘মেঘদল’কেও।

বিশেষ দ্রষ্টব্য

এ সিনেমার কিছু দৃশ্য আপনাকে অন্যভাবে ভাবিয়ে তুলবে। যেমন- সমুদ্রের বাতাসের মধ্যে বিড়ি বা সিগারেট ধরানো। ম্যাচ ও বিড়ি নেওয়া হয় গেঞ্জির ভেতরে, চঞ্চল এভাবে বিড়ি ধরিয়ে তাক লাগিয়ে দেয়। তামাক খাওয়া নাসিরুদ্দিন খান বিড়ি বা গাঁজা নিয়ে সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দেয় আবার ভুস করে উঠে এসে সেই বিড়িতে টান দেয়। তার বিড়ি বা গাজার আগুন জল নেভাতে পারে না, ঠিকই সেখান থেকে ধোঁয়া বের হয়! আবার যখন নাসিরউদ্দিনের হাত থেকে বাঁচতে গুলতি তার অণ্ডকোষে লাথি মারে, তখন সেখানকার ব্যথার আগুন নেভাতে বরফের ব্যবহারও দর্শকদের এক ধরনের ভাবনায় ফেলে দেয়।

যখন খাবার স্বল্পতা তখন আপনি কীভাবে বাঁচবেন? সেই সমাধানও আছে হাওয়া সিনেমায়। আপনি মাছের জন্য রাখা বরফ তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারেন। খেতে পারেন মাছের ভিন্ন ধরনের রেসিপি। ছবিতে প্রাণ বাঁচাতে চঞ্চলরা তাই খেয়েছেন। পৃথিবী বিখ্যাত গল্প খরগোশের একটা রূপক আছে হাওয়া সিনেমাতে। চঞ্চল একটা পোষা পাখি (শালিক নাকি ময়না?) নিয়ে নয়নতারা বোটে ওঠেন। বোট দিক হারিয়ে সাগরে ভাসার সময় পাখিটা ছেড়ে দেন চঞ্চল নিজেই এবং বলেন যদি তীর কাছে হয় পাখিটা ফিরবে না। যদি তীর কাছে না হয় পাখিটা ফিরবে আবার। পাখিটা ফিরে এলে বোটে মাছ থাকা সত্ত্বেও চঞ্চল সেটা ফ্রাই করে লোভনীয় ভঙ্গিতে খান! খরগোশ গল্পের বিখ্যাত দম্পতি বাসা ছেড়ে বহুদূর যাওয়া আগে পোষা খরগোশটাকে নিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন। পরে খাবার টেবিলে স্ত্রী স্বামীকে বললেন, সুস্বাদু যে মাংস খাচ্ছ সেটা আমাদের প্রিয় পোষা খরগোশের!

প্রিয় কিছুকে হয়ত এভাবেই জলাঞ্জলি দিতে হয়। আসলে সমুদ্র কেমন যেন। এই ‘কেমন যেন’ একটা ভাব আছে সিনেমাটিতে। শুরুতেই ক্যানভাসারের (অভিনয় করেছেন ইকবাল) জবানিতে বলে দেওয়া হয় -‘সমুদ্রে কিন্তু কোনো সাইন্স খাটে না’! ঠিক তেমনিভাবে এই সিনেমার ধুন্দুমার জনপ্রিয় হওয়া গান-‘তুমি বন্ধু কালাপাখি আমি যেন কী’ এর সুরকার ও গীতিকার হাশিম মাহমুদের জীবন এখন কোনো ‘সাইন্সের’ মধ্যে নেই। প্রার্থনা করি, হাওয়া যেন দারুণ ব্যবসা সফল হয়। আশা করি, এই সিনেমার পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, গানের শিল্পী অর্থাৎ হাওয়া টিম হাশিম মাহমুদকে নিয়ে একদিন এই সিনেমাটা দেখবেন! হাওয়া হয়ে ঊঠুক লাখো দর্শকের ভালোবাসার সমুদ্র!