খিলখিল কাজী বলেন, “চুক্তিপত্রে নাকি লেখা রয়েছে কল্যাণী কাজী এবং অনির্বাণ নজরুলের একমাত্র উত্তরসূরি! তা হলে আমরা কারা?”
Published : 15 Nov 2023, 12:44 PM
কবি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ এর সুর বিকৃত করা নিয়ে বিতর্ক-সমালোচনার মধ্যে এবার কবি পরিবারের সদস্যদের দ্বন্দ্ব-মতভেদ প্রকাশ্যে এসেছে। 'পিপ্পা' সিসেমায় ব্যবহার করা গানটির স্বত্ব হস্তান্তর চুক্তি নিয়ে নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন নজরুলের নাতি-নাতনিরা।
নজরুলের দুই ছেলে কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধের দুই ছেলেমেয়ে খিলখিল কাজী ও কাজী অরিন্দম দাবি করেছেন, ‘পিপ্পা’ টিমকে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গান ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার চুক্তির কথা তাদের কাছে ‘গোপন’ রাখা হয়েছে।
এছাড়া ‘পিপ্পা’র সঙ্গে চুক্তির সময় উপস্থিত থাকা নাতি কাজী অনির্বাণের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি 'এড়িয়ে যাচ্ছেন' বলে অভিযোগ তুলেছেন খিলখিল।
এর আগে গানের চুক্তিপত্র দেখে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করার পক্ষে কথা বলেছিলেন কাজী অনিরুদ্ধের মেয়ে অনিন্দিতা কাজী।
নজরুলের পুত্রবধূ প্রয়াত সংগীত শিল্পী কল্যাণী কাজী ২০২১ সালে গানটি অবিকৃত রেখে ‘পিপ্পা’ টিমকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন, সে সময় তার সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে কাজী অনির্বাণ। সেই অনুমতি কেবল মৌখিক ছিল না। ‘যাবতীয় নিয়ম মেনে’ করা সেই চুক্তিপত্র অনির্বাণের কাছে বলে দাবি করেছেন তার বোন অনিন্দিতা।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগানো শতবর্ষী গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ নিয়ে এ বিতর্কের সূচনা সোশাল মিডিয়ায় 'পিপ্পা'র গানটি প্রকাশের পর থেকে।
রাজাকৃষ্ণ মেনন পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক হিন্দি সিনেমা ‘পিপ্পা’র জন্য নজরুলের ওই গানটির নতুন কম্পোজিশন করেন অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।
কিন্তু শ্রোতাদের অনেকের অভিযোগ, এ আর রহমানের হাতে পড়ে গানটি থেকে বিদ্রোহই হারিয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মহলের মানুষেরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, সমালোচনায় সরব হয়েছেন সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা। কবি পরিবারের সদস্যরাও বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেননি।
সমালোচনা-বিদ্রুপের মুখে ক্ষমাও চেয়েছে গানটি ব্যবহার করা সিনেমা 'পিপ্পা'র নির্মাতা-প্রযোজকরা। সোমবার এক বিবৃতিতে প্রযোজনা সংস্থা রায় কাপুর ফিল্মস দাবি করেছে, তারা কবির পুত্রবধূ প্রয়াত কল্যাণী কাজী ও তার পুত্র কাজী অনির্বাণের কাছ থেকে গানের স্বত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় নিয়ম মেনেছেন। লিখিত চুক্তি করে এবং চুক্তি মেনে তারা গানটি ব্যবহার করেছেন।
নজরুলের প্রয়াত দুই ছেলে কাজী সব্যসাচীর মেয়ে খিলখিল কাজী, মিষ্টি কাজী ও বাবুল কাজী বাংলাদেশের নাগরিক। আর দ্বিতীয় ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের পরিবারের বসবাস কলকাতায়।
অনিরুদ্ধের স্ত্রী সংগীত শিল্পী কল্যাণী কাজীও মারা গেছেন চলতি বছরে। অনিরুদ্ধ-কল্যাণীর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে কাজী অনির্বাণ, কাজী অরিন্দম থাকেন কলকাতায়, আর অনিন্দিতা কাজী নিউ জার্সি প্রবাসী।
নজরুলের নাতি-নাতনিদের মধ্যে দুই চাচাতো ভাইবোন খিলখিল কাজী এবং কাজী অরিন্দম মুক্তি পাওয়া ‘পিপ্পা’ সিনেমা থেকে ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি সরিয়ে নেওয়া পক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন। এছাড়া গানের স্বত্ব হস্তান্তর নিয়েও তাদের ক্ষোভ রয়েছে।
নিজেদের মতামত ও ক্ষোভের কথা তুলে ধরতে বৃহস্পতিবার কলকাতায় খিলখিল ও অরিন্দম সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন।
আনন্দবাজার অনলাইনকে অরিন্দম বলেন, “এই বিষয়টা নিয়ে বিভিন্ন মতামত ঘুরছে। আমি চুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমরা সংবাদ সম্মেলনে পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু কথা বলতে চাই। এর ফলে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যাবে।’”
‘কারার ওই লৌহ কপাট’ এর স্বত্ব হস্তান্তর নিয়ে কবে প্রথম জানতে পারেন- এই প্রশ্নে খিলখিল বলেন, “আমার কিছু জানা ছিল না। আমি তো গত ১০ নভেম্বর প্রথম ব্যাপারটা জানতে পারি এবং পরের দিন কলকাতায় এসেছি।“
খিলখিল অভিযোগ করেন, “চুক্তিপত্রে নাকি লেখা রয়েছে কল্যাণী কাজী এবং অনির্বাণ নজরুলের একমাত্র উত্তরসূরি! তা হলে আমরা কারা?’’
খিলখিল বলেছেন, সংবাদ সম্মেলনে তার দাদুর গানের বিকৃতির প্রতিবাদ করার পাশাপাশি এই চুক্তিপত্রের সত্যতা নিয়েও কথা বলবেন তারা দুই ভাইবোন।
“অনির্বাণের সঙ্গে আমরা অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছে। যা ক্ষতি হয়েছে, পরিবারের তরফে ওকে তার দায় নিতেই হবে।“
প্রযোজনা সংস্থা রায় কাপুর ফিল্মসের লিখিত ‘ক্ষমা প্রার্থনায়’ সন্তুষ্ট নন খিলখিল। কেবল একটি বিবৃতি দেওয়াকে ‘দায় সারা’ হিসেবে দেখছেন নজরুল পৌত্রী।
“এইভাবে তো দায় সারা যায় না। রহমানের কোনো গান নিয়ে কেউ এ রকম করলে উনি কি এত সহজে ছেড়ে দিতেন? আমরা চাই, হয় গানটিকে ছবি থেকে মুছে দেওয়া হোক, আর যদি রাখতেই হয়, তা হলে মূল সুরকে অনুসরণ করে গানটিকে তৈরি করা হোক,” বলেন খিলখিল।’
এদিকে কাজী অনির্বাণ আনন্দবাজারকে বলেছেন, তার ভাই অরিন্দম এবং চাচাতো বোন খিলখিলের সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।
তাহলে কি সম্মেলনে তিনি থাকবেন না? অনির্বাণ বলেন, “আমি কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। তাই উপস্থিত থাকব কী না, সেটা এখনই বলতে পারছি না।”
এর আগে গান প্রকাশের পর গানটি বিকৃত করার অভিযোগ এনে গানের ক্রেডিট থেকে তার পরিবারের নাম মুছে ফেলার দাবি তুলেছিলেন অনির্বাণ।
অনির্বাণের ভাষ্য ছিল, “আমরা বুঝতে পারিনি যে রহমানের মত একজন শিল্পী এতটা অসংবেদনশীল হতে পারে; গানটিকে হত্যা করতে পারে। প্রতিবাদ হিসেবে, আমি চলচ্চিত্রের ক্রেডিট লাইনে 'বিশেষ ধন্যবাদ'-এ আমাদের পরিবারের নাম চাই না।”
তিনি বলেন, ২০২১ সালে তার মায়ের (কল্যাণী কাজী) মৃত্যুর আগে তিনি সুর-কথা না বদলে গানটি ‘রিক্রিয়েট’ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সে সময় পিপ্পা টিম গানটিকে নিজেদের মত করে ব্যবহার করার ইচ্ছার কথা জানায়। তাই গানটা তৈরি হয়ে গেলে একবার শোনাতে বলেছিলেন তার মা। কিন্তু তারা কিছুই শোনায়নি।
“রহমানকে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই জানতে চাই, তাকে কে অধিকার দিল গানটি বিকৃত করার। স্বত্ব দেওয়ার সময় তো সুর বদলের কথা বলা হয়নি। কী রকম একটা করে দিয়েছে গানটাকে! একটা গ্রামীণ সংগীতের মতো, ভাটিয়ালির মতো করে দিয়েছে। অনেক সস্তা করে দিয়েছে।”
নিউ জার্সি প্রবাসী কবি নাতনি অনিন্দিতা ফেইসবুকে লিখেছেন, “দাদুর 'কারার ওই লৌহ কপাট' গানটির সুর বিকৃতি ঘটিয়েছেন বিশিষ্ট গীতিকার সুরকার শিল্পী এ আর রহমান। গোটা বিশ্ব জুড়ে বিতর্কের ঝড়, তোলপাড়। আমার মা কল্যাণী কাজী, যার বেঁচে থাকাই ছিল নজরুলকে নিয়ে, নজরুলকে ঘিরে, নজরুলকে তিনি ধারণ করেছিলেন। তিনি ২০২১ সালে গানটি অবিকৃত রেখে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানতে পারি। কিন্তু এর পরিণতি এমন হবে, তিনি মৃত্যুর পরেও ভাবতে পারেননি বোধ হয়।’’
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, প্রচুর টাকার বিনিময়ে নাকি গানটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফেইসবুক পোস্টে তারও উত্তর দিয়েছেন অনিন্দিতা।
অনিন্দিতা বলেছেন, “সে ক্ষেত্রে ২০২১ সালে কী এগ্রিমেন্ট হয়েছিল, সেটা জানা খুব প্রয়োজন, তা হলে সব বিতর্কের অবসান হবে। এবং যারা এগ্রিমেন্ট-এর বিপক্ষে গিয়ে এই কাজটি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।’’
নজরুলের গান বিতর্কে পিপ্পা নির্মাতাদের ‘ক্ষমা’ প্রার্থনা
এ আর রহমান ‘গর্হিত অপরাধ’ করেছেন: খিলখিল কাজী
‘লৌহ কপাট’: এবার চুক্তিপত্র নিয়ে প্রশ্ন কবির পৌত্রীর
‘কারার ওই লৌহ কপাট’: এ রহমানের সমালোচনায় হৈমন্তী, অজয় ও অনির্বাণ