নজরুলকে নিয়ে ‘ইয়ার্কি’?

‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির সঙ্গে পুরো বাঙালি জাতির ভাবাবেগ জড়িয়ে আছে। এ আর রহমান যেভাবে সুর করেছেন, তার সঙ্গে গানটির ইতিহাস, পরিপ্রেক্ষিত এগুলো একেবারেই মেলে না। তিনি গানটিকে আধুনিক করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষমেশ এই বিখ্যাত গানটির একটি বিকৃত রূপ সামনে এসেছে। গানটি নিয়ে যা করা হয়েছে, তা দুঃখজনক।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 13 Nov 2023, 03:33 PM
Updated : 13 Nov 2023, 03:33 PM

যেসব বাংলা গান আমাদের সব প্রেরণার উৎস, সেগুলোরই একটি ‘কারার ঐ লৌহকপাট’। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গানটি শোনার পর যে কারও মনেই উথলে ওঠে বাঁধ ভাঙার ডাক, রক্তে জেগে ওঠে অধিকার আদায়ের দাবি। কিন্তু এই অসাধারণ গানটিকে সম্পূর্ণ ভেঙেচুরে, ভিন্ন সুরে চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছেন ভারতের অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এ আর রহমান। যে কোনও গানের মূল স্রষ্টার কথা ও সুর পরিবর্তন এবং বিকৃতি করা অপরাধের সামিল। পুরনো সুরে নতুনত্ব আনা যায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তা বিকৃত হয়ে যাবে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই পুরনো গানগুলোকে নতুনভাবে উপস্থাপন করছে। ফলে পুরনো গানগুলো বর্তমান প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কোনও পরিচিত গানের সুরটা ঠিক রেখে কেউ যদি যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চায় সেটা করতেই পারে। কিন্তু সেই পরীক্ষা করতে গিয়ে যদি সুরটা ধ্বংস হয়ে যায়, সেটা নিঃসন্দেহে আপত্তিকর। এই গানটির সঙ্গে পুরো বাঙালি জাতির ভাবাবেগ জড়িয়ে আছে। এ আর রহমান যেভাবে সুর করেছেন, তার সঙ্গে গানটির ইতিহাস, পরিপ্রেক্ষিত এগুলো একেবারেই মেলে না। তিনি গানটিকে আধুনিক করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষমেশ এই বিখ্যাত গানটির একটি বিকৃত রূপ সামনে এসেছে। গানটি নিয়ে যা করা হয়েছে, তা দুঃখজনক।

‘পিপ্পা’ নামের যে হিন্দি চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে কেন্দ্র করে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে বলে চিহ্নিত করেছেন নির্মাতারা। যদিও এই চলচ্চিত্রের কাহিনীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা নিয়েও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সেটি ভিন্ন আলোচনা, কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে নজরুলের গানটির আসল সুর বদল করায়। কবি নজরুল ইসলামের পরিবারও অভিযোগ করেছে, তাদের কাছ থেকে গান ব্যবহারের অনুমতি নেয়া হলেও যেভাবে সুর বদল করা হয়েছে, সেই অনুমতি তারা দেননি। এ ব্যাপারে কবি-পরিবার নিশ্চয়ই আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।

প্রশ্ন উঠেছে, এ আর রহমানের মতো একজন বিখ্যাত সুরকার এ কাজটি কীভাবে করলেন? এটা কি কেবলই অজ্ঞতা? নাকি উদাসীনতা? তিনি ‘বন্দে মাতরম’ কিংবা ‘জয় হো’ সৃষ্টি করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য’ কবিতায় সুর দিয়েছেন। সেগুলোয় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তবে তিনি কেন নজরুলের গানটির স্পিরিট বুঝতে পারলেন না? তিনি কি খোঁজ পাননি এই গানের পেছনে রয়েছে কোন দৃপ্ত ইতিহাস? যা আজও রোমকূপে আগুনের নেশা ধরিয়ে দেয়!

নজরুল লিখিত এই গানটির নাম ‘ভাঙার গান’। যা তাঁর ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের একেবারে শুরুতেই রয়েছে। যে গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল প্রকাশের পর থেকেই। দ্রুত বাজেয়াপ্ত করা হয় গ্রন্থটি। নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। যা জারি ছিল প্রায় আড়াই দশক। ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ।

তবে তারও আগে ১৯২২ সালের জুনে মাসে ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভাঙার গান’। সেই সময় চিত্তরঞ্জন দাশ কারাবন্দি। দেশবন্ধুর কারাবরণের পরে ১৯২১ সালে তাঁর পত্রিকা ‘বাঙ্গলার কথা’র জন্য ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ কবিতা হিসেবে লেখেন নজরুল। কবি-বন্ধু মজফফর আহমেদের স্মৃতিকথায় আছে, চিত্তরঞ্জন-পুত্র লেখা চাইতে এলে কয়েক মিনিটে কবিতাটি লিখে দেন নজরুল। এর পরে হুগলি জেলে বন্দিদশায় সুর বসিয়ে অমর গানটির সৃষ্টি নজরুলের। সেই গানে নজরুল আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘লাথি মার, ভাঙ রে তালা!/ যত সব বন্দী-শালায়-/ আগুন জ্বালা,/ আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি!’ এই ডাক সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে জেগে ওঠা দেশপ্রেমের তরঙ্গকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতে এই কবিতাসম্বলিত গ্রন্থ নিষিদ্ধ হওয়ার ১০০ বছর পরে এই নভেম্বরে গানটির অমর্যাদায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্য একটি বড় আঘাত।

একেবারে যৌবনের শুরু থেকেই বাংলার কাব্য জগতে নজরুল ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবেই এক ‘রকস্টার’! মাত্র ২২ বছরের এক তরুণের কলম সেদিন রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল বিপ্লবীদের। খোদ চিত্তরঞ্জন না হলে জেলের ভিতরে বসে গেয়ে ওঠেন ‘কারার ঐ লৌহকপাট’!

এক শ বছরেরও বেশি সময় আগে লেখা গানটি আজও একই রকম ‘জীবন্ত’। এই গানের যে তীব্রতা, সেটাই এর মূল স্পিরিট। যে দুর্দম চেতনার কথা বলে এই গান, তা যেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঙালির ইতিহাসকে ধারণ করে রেখেছে। সেই গানকে এমন মিহি রোম্যান্টিক মেজাজে এ আর রহমান কেন ব্যবহার করলেন, তা ভেবে ওঠাই দুষ্কর। এ গান তো যেন-তেন কোনো গান নয়! তাঁর রিসার্চ টিম হদিশ দিতে পারেননি এমন বিখ্যাত এক গানের?

একথা বলা বাহুল্য যে, নজরুল এক অবিশ্বাস্য জনপ্রিয় কবি। তাঁর জনপ্রিয়তা শুধু অক্ষুণ্ন নয়, উত্তরোত্তর বাড়ছে। নজরুল আমাদের রক্তের ভেতরে মিশে রয়েছেন আলোয় উদ্ভাসিত এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টির উত্তরাধিকার হয়ে। কবি লিখেছিলেন, ‘রাজার বাণী বুদ্‌বুদ্, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র।’ সেই সমুদ্র বাঙালির চেতনায় জেগে রয়েছে এই অন্ধকার সময়েও। তাই তো ক্রমশ আত্মবিস্মৃতির পথে হেঁটে চলা বাঙালি আজও তবে তাঁর প্রিয় নায়কের অপমানে প্রতিবাদের আগুনে জ্বলে উঠেছে। ১৯৪৯ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল’। এই অমোঘ উচ্চারণেই ধরা আছে বাঙালির কাছে নজরুলের আসল ছবিটা। গত কয়েক দশকে আমূল বদলেছে বাঙালি। কিন্তু তার নজরুল-প্রেম এতটুকুও বদলায়নি।

কাজী নজরুলের গান বাংলা ও বাঙালির অতি প্রিয় সম্পদ। হৃদয় নিঃসৃত প্রেম ও ভালোবাসায় ঘেরা এ সম্পদ। এই সম্পদ ও আবেগকে নিয়ে ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’র নামে খেলা করা এ আর রহমানের উচিত হয়নি। ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি শুনলে আজও রক্তে আগুন জ্বলে ওঠে। প্রতিবাদের মশাল হাতে এগিয়ে চলার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। যুগে যুগে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে এই গান পরিণত হয়েছে আমাদের প্রতিবাদের ভাষা। এই গানের বিকৃতি কোনো যুক্তিতেই সমর্থন করা যায় না। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত।