রায় কাপুর ফিল্মস দাবি করেছে, তারা যাবতীয় নিয়ম মেনে, স্বত্ব নিয়ে গানটি সিনেমায় ব্যবহার করেছেন।
Published : 14 Nov 2023, 11:20 AM
কবি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ এর সুর বিকৃত করা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে তুমুল সমালোচনা-বিদ্রুপের মুখে অবশেষে ক্ষমা চেয়েছে গানটি ব্যবহার করা সিনেমা 'পিপ্পা'র নির্মাতা-প্রযোজকরা।
মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্স-এ সোমবার এক বিবৃতিতে প্রযোজনা সংস্থা রায় কাপুর ফিল্মস দাবি করেছে, তারা কবির পুত্রবধূ প্রয়াত কল্যাণী কাজী ও তার পুত্র কাজী অনির্বাণের কাছ থেকে গানের স্বত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় নিয়ম মেনেছেন। লিখিত চুক্তি করে এবং চুক্তি মেনে তারা গানটি ব্যবহার করেছেন।
তবে এ আর রহমানের সংগীতায়োজনে গানটি যদি কারো 'ভাবাবেগে আঘাত দিয়ে থাকে অথবা অনিচ্ছাকৃত পীড়া দিয়ে থাকে', সেজন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়েছে সিনেমা টিম।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগানো শতবর্ষীগান ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ নিয়ে এ বিতর্কের সূচনা সোশাল মিডিয়ায় পিপ্পার গানটি প্রকাশের পর থেকে।
রাজাকৃষ্ণ মেনন পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক হিন্দি সিনেমা‘পিপ্পা’র জন্য নজরুলের ওই গানটির নতুন কম্পোজিশন করেন অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।
কিন্তু শ্রোতাদের অনেকের অভিযোগ, এ আর রহমানের হাতে পড়ে গানটি থেকে বিদ্রোহই হারিয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মহলের মানুষেরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, সমালোচনায় সরব হয়েছেন সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা। কবি পরিবারের সদস্যরাও বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেননি।
কাজী নজরুলেন নাতি নাতনিরা সুরকারের এই উদ্যোগকে ‘গর্হিত অপরাধ’ বলে বর্ণনা করেছেন। গানটি বিকৃত করার অভিযোগ এনেছেন তারা; গানের ‘ক্রেডিট লাইন’ থেকে কাজী পরিবারের নাম মুছে ফেলারও দাবি জানিয়েছেন।
এছাড়া নজরুল ইসলামের পরিবারের অভিযোগ হল, তাদের কাছ থেকে গান ব্যবহারের অনুমতি নেওয়া হলেও যেভাবে সুর বদল করা হয়েছে, সেই অনুমতি তারা দেননি।
নজরুল ভক্ত অনুরাগীদের ক্ষোভের মুখে সোমবার বিবৃতি আসে 'পিপ্পা' সিনেমার অন্যতম প্রযোজক সিদ্ধার্থ রায় কাপুরের পক্ষ থেকে।
বিবৃতিতে বলা হয়, " 'কারার ঐ লৌহকপাট' গানটিকে ঘিরে বর্তমান আলোচনার প্রেক্ষিতে পিপ্পা সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক এবং সংগীত সুরকাররা স্পষ্ট করতে চান যে, এই পরিবেশনার পেছনে আন্তরিক শৈল্পিক প্রচেষ্টা আছে। এবং কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার থেকে স্বত্ব নেওয়ার পর শিল্পের খাতিরে কেবল গানটি তৈরি করা হয়েছে। নজরুল ইসলাম ও তার সৃষ্টির প্রতি আমাদের মনে গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ-সংগীত ও রাজনীতিতে তার অবদান অপরিসীম।"
রায় কাপুর ফিল্মসবলেছে, " কাজী নজরুল ইসলামের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী ও তার পুত্র কাজী অনির্বাণের কাছ থেকে গানের স্বত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় নিয়ম মানা হয়েছে। গান রিমেক করার মূল উদ্দেশ্য হল এর ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো। সিনেমায় এই গান তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই সব মানুষদের দেশের, স্বাধীনতা ও ন্যয়বিচার আদায়ের সংগ্রামের অনুভূতির কথা মাথায় রেখে।"
মূল গানটি নিয়ে শ্রোতাদের আবেগকে 'পিপ্পা' টিম'সম্মান করে' জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা মূল গানটি ঘিরে শ্রোতাদের আবেগকে সম্মান করি। শিল্প যেহেতু ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে আমাদের পদক্ষেপ যদি কারও আবেগে আঘাত করে থাকে বা অনিচ্ছাকৃত কষ্টের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।"
কবি পরিবারের ক্ষোভ-অভিযোগ
নজরুলের নাতি অনির্বাণ কাজী গানটি বিকৃত করার অভিযোগ এনেছেন; গানের ক্রেডিট থেকে তার পরিবারের নাম মুছে ফেলারও দাবি জানিয়েছেন।
অনির্বাণের ভাষ্য, “আমরা বুঝতে পারিনি যে রহমানের মতো একজন শিল্পী এতটা অসংবেদনশীল হতে পারে; গানটিকে হত্যা করতে পারে। প্রতিবাদ হিসেবে, আমি চলচ্চিত্রের ক্রেডিট লাইনে 'বিশেষ ধন্যবাদ'-এ আমাদের পরিবারের নাম চাই না।”
তিনি বলেন, ২০২১ সালে তার মায়ের (কল্যাণী কাজী) মৃত্যুর আগে তিনি সুর-কথা না বদলে গানটি রিক্রিয়েট করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই সময় তারা গানটিকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করার ইচ্ছার কথা জানায়। তাই গানটা তৈরি হয়ে গেলে একবার শোনাতে বলেছিলেন তার মা। কিন্তু তারা কিছুই শোনায়নি।
“রহমানকে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই জানতে চাই, তাকে কে অধিকার দিল গানটি বিকৃত করার। স্বত্ব দেওয়ার সময় তো সুর বদলের কথা বলা হয়নি। কী রকম একটা করে দিয়েছে গানটাকে! একটা গ্রামীণ সংগীতের মতো, ভাটিয়ালির মতো করে দিয়েছে। অনেক সস্তা করে দিয়েছে।”
নজরুলের নাতনি, প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী কল্যাণী কাজীর কন্যা অনিন্দিতা কাজীর ভাষ্য, তার বোধহয় ভাবতেও পারেননি গানের পরিণতি কি হতে চলেছে।
নিউজার্সি প্রবাসী কবি নাতনি অনিন্দিতা লিখেছেন, “দাদুর 'কারার ঐ লৌহকপাট' গানটির সুরবিকৃতি ঘটিয়েছেন বিশিষ্ট গীতিকার সুরকার শিল্পী এ আর রহমান। গোটা বিশ্ব জুড়ে বিতর্কের ঝড়, তোলপাড়। আমার মা কল্যাণী কাজী, যার বেঁচে থাকাই ছিল নজরুলকে নিয়ে, নজরুলকে ঘিরে, নজরুলকে তিনি ধারণ করেছিলেন... তিনি ২০২১ সালে গানটি অবিকৃত রেখে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানতে পারি। কিন্তু এর পরিণতি এমন হবে, তিনি মৃত্যুর পরেও ভাবতে পারেননি বোধ হয়।’’
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, প্রচুর টাকার বিনিময়ে নাকি গানটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফেইসবুক পোস্টে তারও উত্তর দিয়েছেন অনিন্দিতা।