আন্তঃব্যাংক লেনদেনে সুদ হার সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে।
Published : 01 Aug 2022, 01:33 AM
মহামারীর ধাক্কা সামলে ওঠার পথে ঋণ প্রবাহ বাড়লেও আমানত সেভাবে বাড়েনি, এর মধ্যে ডলারের বাজারের অস্থিরতা সামলাতে গিয়ে নগদ টাকার সংকটে পড়ছে কোনো কোনো ব্যাংক; যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে।
ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে এক দিনের জন্য ধার করা অর্থের সুদের গড় হার বা কলমানি রেট জুলাইয়ের শেষে এসে ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছে। অথচ এক বছর আগে তা ছিল ২ শতাংশ; গত ডিসেম্বরে ছিল ৩ শতাংশের ঘরে।
আর ৭ দিন বা তার চেয়ে বেশি সময়ের জন্য ধার নিতে ব্যাংকগুলোকে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুণতে হচ্ছে। ব্যাংক খাতের এই তারল্য সংকট আমানতের সুদ হারকেও বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন বলছেন, গত কয়েক মাস ধরেই তারল্য কমছে ব্যাংক খাতে।
বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করছেন এভাবে: আমদানির চাহিদা বাড়ায় ব্যাংকগুলোকে ডলার কিনতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। গত ১৩ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে।
ডলারের দাম বাবদ বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা এই সময়ে ব্যাংকগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। সেই ডলার দিয়ে ব্যাংক গ্রাহকের আমদানি বিল পরিশোধ করেছে।
কিন্তু গ্রাহক সাধারণত তাৎক্ষণিকভাবে ওই ডলারের দাম শোধ করেন না। আমদানি বিলের বিপরীতে ব্যাংকে একটি ঋণ তৈরি করা হয়, যা গ্রাহক পরে শোধ করেন।
সেলিম আরএফ হোসেন বলছেন, ব্যাংক খাতের অতিরিক্ত তারল্য এভাবেই ধীরে ধীরে কমে গেছে। এর মধ্যে আবার বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে, সরকারও ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করেছে। অথচ আমানতের প্রবৃদ্ধি সেভাবে হয়নি।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার রেপো শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে ব্যাংকগুলোর এখন বেশি সুদ দিতে হচ্ছে।
আবার ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীদের সুদ দিতে হচ্ছে মূল্যস্ফীতির হারের ওপর হিসাব করে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় আমাদের সুদ হারও বাড়ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক আমানতের সুদ হার ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করেছে।
সব মিলিয়ে পুরো ব্যাংক খাতেই সুদহার বেড়ে গেছে বলে সেলিম আরএফ হোসেনের ভাষ্য।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুন শেষে দেশে ব্যাংক খাতে তারল্যের (নগদ টাকা ও অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট মিলিয়ে) পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা, এ বছর মে মাস শেষে তা কমে ৪ লাখ ২৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা হয়েছে।
এর মধ্যে নগদ টাকার পরিমাণ (অতিরিক্ত তারল্য) গত বছরের জুনের শেষে ছিল ৬২ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এ বছর মে মাস শেষে তা কমে ২১ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ‘ধারাবাহিকভাবে ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার যোগন দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রি করায়’ তারল্য কমেছে।
আমানতের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদন বলছে, গত মে শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অথচ গত বছরের মে মাসে তা ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ ছিল।
অন্যদিকে গত জুন শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ, আর সার্বিক ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ।
গত বছরের জুন শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ; সার্বিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমি ১১ শতাংশ।
অস্থির ডলার বাজারে মানি এক্সচেঞ্জে ক্রেতা কম
জুলাইতে আমদানি ৬ বিলিয়নে নেমেছে, ডলার সংকটে ‘কিছুটা স্বস্তি’: সালমান
আন্তঃব্যাংকেও সর্বোচ্চ দরে ডলার
গত অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে। অর্থবছর শেষে সরকার ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ধার নেয় ব্যাংক খাত থেকে।
ওই সময়ই ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রোপো হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশে উন্নীত করে।
তারল্যে টান পড়ায় আগের চেয়ে বেশি সুদে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজার থেকে অর্থ ধার করে চাহিদা মেটাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
স্বল্প সময়ের জন্য একদিন (ওভার নাইট) থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত এবং ৯০ দিনের জন্য মেয়াদী হিসাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে টাকা ধার (ঋণ) করতে যে সুদ দিতে হয়, সেই হারকে বলে কলমানি রেট।
ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী দৈনিক নগদ জমার হার (সিআরআর) অনুপাত নির্ধারিত মাত্রায় রাখতে দ্রুত অর্থ সংগ্রহের উৎস হচ্ছে কলমানি বাজার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত গত এক বছরের কলমানি বাজারের সুদহার পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে এই সুদ হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে।
সুদহারের সঙ্গে বাড়ছে ধার নেওয়া অর্থের পরিমাণও। গত বছরের ২৯ জুলাই কলমানিতে লেনদেন হওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। আর এ বছর ২৮ জুলাই কলমানিতে লেনদেন হয়েছে ৫ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। ৫ জুলাই এই পরিমাণ ৯ হাজার ৫২৪ কোটি টাকায় ওঠে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন সুদহার না বাড়িয়ে তো উপায় নেই। নগদ চাহিদা মেটাতে কলমানিতে সুদহার ৬ শতাংশে উঠেছে। আগামীতে আমানতের সুদহার আরও বাড়লে অশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।”
ব্যাংকাররা বলছেন, তারল্য সংকট বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে কলমানি বাজারে বড় ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ কমে যাওয়া।
আগে যেসব ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত আমানত থাকত, তারা স্বল্প সময়ের জন্য কলমানি বাজারে টাকা খাটিয়ে মুনাফা পেত। কিন্তু ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের সুদ হার বেশি পাওয়ায় ব্যাংকগুলো সেদিকে টাকা খাটাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৮ জুলাই ৯১ দিন মেয়াদী ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোর ইল্ড (মুনাফার হার) ছিল শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ।
এর এ বছরের ২৮ জুলাই একই মেয়াদের ট্রেজারি বিলে ইল্ড হার ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশের মধ্যে উঠেছে।
তারল্য সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডলার কিনতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর কিছু টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে আসছে এটা ঠিক, কিন্তু বাজারে তারল্য প্রবাহ ঠিক রাখতে অর্থের যোগান দেওয়া অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে কয়েকটি ঋণ প্যাকেজ ও পুনঃঅর্থায়ন তহিবলও চালু করা হয়েছে।”